শমীক সরকার, কলকাতা, ৩০ সেপ্টেম্বর, ছবিঃরয়টার ও টুইটার সূত্রে #
আমাদের দেশে যখন সরকার আরেকপ্রস্থ জনবিরোধী পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে, তখন সারা ইউরোপ জুড়েও শুরু হয়েছে নয়া ণ্ণকৃচ্ছসাধন’ ব্যবস্থা। এদেশের মতোই বিদেশেও ণ্ণবাজার অর্থনীতি’কে চাঙ্গা করতে চেয়েই এইসব ব্যবস্থা। তবে আমাদের দেশে কোনও জনবিক্ষোভ দেখা যায়নি, সেসব গড়ে ওঠার জন্য অপেক্ষাও করা হয়নি। সময় নেই, আসন্ন ভোটের কথা মাথায় রেখে সংসদীয় দলগুলির নেতানেত্রীরা প্রেস কনফারেন্স করে জোট ছেড়েছে বা ধরেছে, বনধ্ ডেকেছে, বৈদ্যুতিক চোঙা ফুঁকে সরকারকে গালমন্দ করছে, অথবা ণ্ণসংসদীয় জনপ্রতিনিধি’দের নিয়ে ধর্নার আয়োজন করে ফেলেছে।
যদিও ণ্ণবাজার অর্থনীতি’র সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাবলিক বিরোধী পদক্ষেপ নিতে কোনও দলই কসুর করে না, করার উপায়ও নেই, যদি ক্ষমতার খেলার মাঠে থাকতে হয়। অতি সম্প্রতি তথ্য অধিকার আইনে বেরিয়ে এসেছে, সমস্ত রাজনৈতিক দলের ফান্ডে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো কয়েকশ’ কোটি টাকা করে চাঁদা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি চলছে এই চাঁদার ওপর দাঁড়িয়ে। কংগ্রেস থেকে বিজেপি, সিপিএম থেকে তৃণমূল, সপা থেকে বসপা — কেউই ব্যতিক্রম নয়।
ইউরোপে অবশ্য এই দ্বিচারিতার অধ্যায় শেষ হয়েছে। গত দশকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বারবার বামপন্থী-দক্ষিণপন্থী ক্ষমতা পরিবর্তন হয়েছে, বাজার অর্থনীতির ণ্ণসংস্কার’, জনবিরোধী পদক্ষেপগুলি থেকে মানুষকে বাঁচানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু সরকারি জনবিরোধী পদক্ষেপ থেমে থাকেনি।
২০০৪ সালে স্পেনে ক্ষমতায় এসেছিল বামপন্থী জাপাতেরো সরকার। কিন্তু দিনের পর দিন সে দেশের মানুষের হাল খারাপ হয়েছে। এখন ক্ষমতায় দক্ষিণপন্থীরা। গত বছর ১৫ মে স্পেনের প্রায় ৫০টি শহরে বিক্ষোভ হয়, ণ্ণআমরা রাজনৈতিক দল ও ব্যাঙ্ককর্তাদের হাতের পুতুল নই’ দাবি নিয়ে। সেদিন থেকেই বিভিন্ন শহরের পার্কে তাঁবু খাটিয়ে শুরু হয় ণ্ণঅকুপাই আন্দোলন’। গণতন্ত্রের এক নয়া উপায়ের খোঁজে শতাধিক ণ্ণসাধারণ সভা’ বসতে থাকে বিভিন্ন শহরে। রাজনৈতিক দলগুলির উদ্দেশ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের জমায়েতগুলি থেকে ঘোষণা করা হয়, ণ্ণতোমরা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করো না’। এই আন্দোলন চলাকালীন একটি ভোট হয়, সেই ভোটে দেখা যায়, স্পেনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট নষ্ট করা হয়েছে। বছর দুয়েক আগে ঘটে যাওয়া আইসল্যান্ডের আন্দোলনের অনুসরণে স্পেনের ণ্ণবিক্ষুদ্ধ’-রা আহ্বান করে, নয়া সাংবিধানিক পরিষদ চাই। মাস পেরিয়ে যেতে স্বাভাবিক নিয়মেই সেই জনআন্দোলনে ভাঁটা পড়ে। কিন্তু আন্দোলনের সংগঠন দু’শ-র বেশি ণ্ণসাধারণ সভা’ থেকে যায়, বসতে থাকে নিয়মিত।
এবছর ২৫ সেপ্টেম্বর স্পেনের পার্লামেন্ট ঘিরে ফেলে হাজার হাজার মানুষ। ণ্ণউঠে দাঁড়ানোর মঞ্চ’ নামে একটি জমায়েত ইন্টারনেটে সামাজিক মিডিয়াতে একটি নয়া সাংবিধানিক প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য আহ্বান রাখে। নাম দেওয়া হয়, ণ্ণ২৫ সেপ্টেম্বর সংসদ দখল’। কিন্তু কারা এই আহ্বান রাখল এবং ঠিক কিই বা তারা চায়, সেই বিষয়ে পরিষ্কার চিত্র না থাকা এবং স্বচ্ছতার অভাবের কারণে ওই সাধারণ সভাগুলির মধ্যে খানিকটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়, ব্যাপক বিতর্ক হয়। কিছু সাধারণ সভা এটা সমর্থন করে, কিছু করে না। সমর্থনকারী সাধারণ সভাগুলিকে নিয়ে তৈরি হয় ণ্ণকোওর্দিনেদোরা ২৫এস’, সাধারণ সভার মাধ্যমে তৈরি হয় সম্পূর্ণভাবে অহিংস ণ্ণসংসদ ঘেরাও’ অভিযান। ঠিক হয়, পার্লামেন্টের কাজকর্ম বন্ধ করা হবে না, পার্লামেন্টে ঢুকতে বেরোতে কাউকে বাধা দেওয়া হবে না। ব্যানার থাকে, গণতন্ত্রকে অপহরণ করেছে রাজনৈতিক দল, বাজার, ব্যাঙ্ক, ব্যবসায়ী, আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। ইস্তেহার লিখে দাবি জানানো হয়,
- সরকার, কোর্ট এবং রাষ্ট্রের নেতৃত্বের অপসারণ নয়া সংবিধান, সমস্ত মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণে তৈরি হওয়া
- সমস্ত ঋণের অডিট, এবং সত্যিকারের জনগণের ঋণ এবং ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ঋণ-কে আলাদা করা।
- কেবল জনগণের ঋণ-কেই জাতীয় দায় হিসেবে নেওয়া নির্বাচনের আইন সংস্কার, যাতে তা সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি বাছতে সক্ষম হয়, সেই বন্দোবস্ত করা
- সমস্ত ণ্ণকৃচ্ছসাধন’ অবিলম্বে বাতিল করা
- নয়া রাজস্ব ব্যবস্থা, ধনীদের ওপর বেশি ট্যাক্স, বকেয়া কর মুকুবের ব্যবস্থা বাতিল করা
- সমস্ত রকমের বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ বাতিল করা
- সহনীয়তার ওপর দাঁড়িয়ে, মানবতার উন্নয়নের দিকে তাকিয়ে নয়া চাকরি তৈরি।
পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে মানুষের শান্তিপূর্ণ জমায়েতে ২৫ সেপ্টেম্বর পুলিশ ব্যাপক অত্যাচার চালায়। এমনকি রাবার বুলেটও ব্যবহার করা হয়। বহু প্রতিবাদকারী আহত হয়। এতে দমে না গিয়ে ফের ২৬ সেপ্টেম্বর জমায়েত হয় মানুষ পার্লামেন্টের বাইরে নেপচুনো স্কোয়ারে জমায়েত হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে একটি ণ্ণকৃচ্ছসাধন’-এর বাজেট পেশ হয়। ফের বাইরে জমায়েত হয় মানুষ। পুলিশ জানায় জমায়েতের সংখ্যা সাড়ে চার হাজার, সংগঠকদের মতে তা বহুগুণ বেশি। সারাদিন জমায়েতের পর মাঝরাতে ব্যাপক পিটিয়ে জমায়েত ভাঙে পুলিশ। কিন্তু ওই একইদিন, অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ ইউরোপের অন্যান্য দেশ — পর্তুগাল, গ্রীস এবং ইতালিতেও বাজার-সরকারের জনবিরোধী নীতিগুলির বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশের সংসদ ঘেরাও অভিযান হয়। হল্যান্ড এবং বেলজিয়ামের মানুষ স্পেনের মানুষের সমর্থনে ২৯ অক্টোবর রাস্তায় নামে।
পর্তুগাল এবং গ্রীসের বাজার অর্থনীতিরও বেহাল দশা। গ্রীসে গত বছর তৃতীয় দফার জনবিরোধী ণ্ণকৃচ্ছসাধন’ প্রকল্প আনার পর ব্যাপক জনবিক্ষোভে সরকার পদত্যাগ করেছিল, ভোট হয়েছিল। এবছর মাস কয়েক আগে সেই দু-দফার ভোটে কৃচ্ছসাধনের পক্ষে থাকা একটি দল কোনওক্রমে জয়ী হয়। যাই হোক, গ্রীসের ব্যাপক জন আন্দোলন চলছিলই। পর্তুগালেও গত কয়েকবছর ধরেই চলছে জন আন্দোলন। তবে স্পেনের আন্দোলনের থেকে কিছুটা আলাদা এই গ্রীস ও পর্তুগালের আন্দোলন, এখনও সেখানকার আন্দোলনের মূল সংগঠনগুলি হলো কিছু রাজনৈতিক দল এবং বড়ো বড়ো ট্রেড ইউনিয়ন। সরাসরি ণ্ণসাধারণ সভা’র মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বন্দোবস্ত সেখানে নেই।
শেষ খবর, কৃচ্ছসাধনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নগুলি ইউরোপ জুড়ে প্রতিবাদের বন্দোবস্ত করেছে। ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি প্রভৃতি দেশে। অকুপাই আন্দোলনের সংগঠন ণ্ণঅ্যাডবাস্টার’ পত্রিকা ৩১ অক্টোবর আমেরিকায় সংসদ ভবন ক্যাপিটল হিলের সামনে ণ্ণহ্যালোউইন পার্টি’র ডাক দিয়েছে।
Leave a Reply