কুশল বসু, কলকাতা, ৩০ এপ্রিল#
তাইওয়ানের জনজাগরণ একটি বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
মাসখানেক আগে তাইওয়ানের ছাত্র যুবরা পরিষেবা ক্ষেত্রে চীনা পুঁজির আগ্রাসন মেনে নেওয়া চুক্তির বিরুদ্ধে সংসদ দখল করে নিয়েছিল। এবার পরমাণু শক্তির বিরুদ্ধে অবরুদ্ধ হল রাজধানী তাইপেই। আন্দোলনের চাপে পড়ে তাইওয়ানের কুওমিনতাং সরকার ঘোষণা করল, প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে আসা দেশের চতুর্থ পরমাণু চুল্লিটির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অন্য তিনটি চুল্লি পুরনো, ২০১৮ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সেগুলি ডি-কমিশন করার কথা।
তাইওয়ানে পরমাণু চুল্লির বিরুদ্ধে জনবিক্ষোভ অনেকদিনের। ২০১১ সালের ফুকুশিমা পরমাণু বিপর্যয়ের পর এই বিক্ষোভ আরো তীব্রতা পায়। ২০১১ সালের মার্চ মাসে প্রায় ২০০০ মানুষ বিক্ষোভে সামিল হয়। সংখ্যাটা প্রত্যেক বছর বাড়তে থাকে। বিশেষ করে তৈরি হতে থাকা চতুর্থ পরমাণু প্রকল্প লুঙমেন পরমাণু প্রকল্পের বিরুদ্ধে। ২০১৩ সালে জনজাগরণের তাইওয়ানে পরমাণু বিরোধী প্রতিরোধেও বান আসে। ফুকুশিমা বিপর্যয়ের তৃতীয় বর্ষে মার্চ মাসে বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ দেখায় আটষট্টি হাজার মানুষ। মে মাসে রাজধানী তাইপেই-তে বিক্ষোভ হয়। উল্লেখ্য তাইওয়ানও ভূমিকম্প প্রবণ দেশ, এবং চতুর্থ পরমাণু প্রকল্পটিতে ভূমিকম্প রোধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতরা জানান, ফুকুশিমার মতো কোনও ৭ মাত্রার পরমাণু বিপর্যয় হলে গোটা তাইওয়ান দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। শাসক কুয়োমিনতাং সরকার দেশজোড়া বিরোধিতার মুখে পড়ে লুঙমেন প্রকল্প নিয়ে গণভোটের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেই গণভোটের বিলটির অন্যায় বয়ান দেখে পরমাণু প্রতিবাদীরা এই বিলের বিরোধিতা করে। উল্লেখ্য, তাইওয়ানের গণতন্ত্রীকরণের আন্দোলন আর পরমাণু প্রতিরোধী আন্দোলনের পুরনো একটা যোগসূত্র ছিলই। আগস্ট মাসে ণ্ণমায়েরা তাইওয়ান ভালোবাসে’ নামে একটি সংগঠনের ডাকে পরমাণু চুল্লির বিরুদ্ধে একটি কনভেনশন হয়।
২০১৪ সালের মার্চ মাসে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার মানুষ তাইওয়ানের বিভিন্ন শহরে পরমাণু চুল্লির বিরুদ্ধে পথে নামে। কেবল রাজধানী তাইপেই-তেই নামে ৫০ হাজার মানুষ। উল্লেখ্য দেশটির মোট জনসংখ্যা আড়াই কোটির মতো।
২২ এপ্রিল লিন ই-সিউং নামে এক জনপ্রিয় নেতা লুঙমেন প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার দাবি নিয়ে অনশনে বসেন। তাঁর দাবির মধ্যে আরো ছিল, গণভোটের আইনটির পরিবর্তন। ২৭ এপ্রিল রাজধানী তাইপেই-এর মেন স্টেশনের কাছে চংচিয়াও ইস্ট রোড অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষ। দাঙ্গা পুলিশ মাঠে নেমে জলকামান দেগে এই প্রতিবাদ ভঙ্গ করে। প্রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং-এর সামনেও জড়ো হয়ে হাজার হাজার মানুষ। অবশেষে ২৮ এপ্রিল সরকার ঘোষণা করে, চতুর্থ পরমাণু চুল্লিটির ণ্ণকাজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে’। তখন অনশন ভঙ্গ করেন লিন।
অনশন ভেঙে একটি বিজ্ঞপ্তি লিন বলেন, আর অনশন করার মানে নেই, কারণ সরকার প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে আসা পরমাণু প্রকল্পটির কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। তবে তিনি সরকারকে সমালোচনা করে আন্দোলনকারীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সরকার লিখেছে ণ্ণকাজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে’। কিন্তু ণ্ণনির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে’ লেখা উচিত ছিল, কারণ কাজ বন্ধ করার কথা বলা মানে ভবিষ্যতে কাজ আবার শুরু করা যেতে পারে। এছাড়া ৭২ বছরের লিন আন্দোলনকারীদের বলেন, বাকি তিনটি পুরনো পরমাণু চুল্লি যাতে ২০১৮ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়, সেটা দেখার দায়িত্ব তাদের। তিনি আরও বলেন, তাইওয়ান যেন একটি সার্বভৌম গণতন্ত্র হিসেবেই থাকে, তাও দেখা দরকার। উল্লেখ্য, লিন তাইপেই চার্চ, যেখানে তিনি থাকেন, সেখানেই অনশনে বসেছিলেন।
লিন বলেন, সম্প্রতি বাণিজ্য চুক্তি থেকে পরমাণু শক্তি, সরকারের সমস্ত কাজই জনগণের বিরোধীতার সম্মুখীন হচ্ছে। একে তিনি জনজাগরণ আখ্যা দেন। তিনি আরও বলেন, জনক্ষমতার জন্য হয়ত আরো অপেক্ষা করতে হবে, কিন্তু আপাতত মানুষ তাদের প্রতিবাদের ক্ষমতা বাড়ানোতে জোর দিক। গণভোট আইনের সংস্কার, মুক্ত-অর্থনীতি এলাকার বিশেষ আইনের বিরোধিতা, সংবিধান সংস্কারের জন্য জনসম্পর্কের আহ্বান, স্থানীয় স্তর থেকে উচ্চতম স্তর অবধি জনপ্রতিনিধিদের পরমাণু বিরোধী শপথ গ্রহণ প্রভৃতি বিষয়ে জনপ্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন লিন।
Leave a Reply