অমিত মাহাতো, ঝাড়গ্রাম, ২৮ আগস্ট#
সোনামুখীর জঙ্গলে কাঠকুড়ূনি দলের ছবি শমীক সরকারের তোলা। ২১ জুন।
মাস্টারডাঙায় প্রথম রাতটা কাটল নিরুপদ্রবে, সকাল বেলা রৌদ্র ঝলমল দিন দেখে আমরা যারপরনাই খুশি, আজ আমাদের জঙ্গলে বেড়ানোর প্রথম দিন, মানসদা
সকাল বেলা চলে গেল, আমরা চান সেরে সকালের খাবার খেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম, প্রথম গেলাম জ্ঞানেন্দ্র বারুই-এর বাড়ি, খুঁজে পেতে একটু অসুবিধা হল, তবে উনি তিনখানি সাইকেল জোগাড় করে দিয়ে বললেন — আপনারা দূর কলকাতা থেকে এসেছেন তাই মেয়েদের সাইকেল দিয়ে বেড়ানোর ব্যবস্থা করে দিলাম, মেয়েদেরকে মিষ্টি খাবার কিছু দিলেই হবে। হাজার হোক ইস্কুলের সাইকেল তো!
মন সায় দিল। এতো উত্তম প্রস্তাব। সকালবেলা যখন জ্ঞানেন্দ্র বারুই-এর বাড়ির উঠোনে দাঁড়ালাম — দেখলাম এই পরিবারের সকলই মাটি নির্ভর কাজে হাত লাগিয়েছে, মাঠটি লাঙল দেয়া, জ্ঞানেন্দ্র বারুই-এর ছোটো মেয়েকে জিজ্ঞেস করতে জানাল, জুনুর বীজ পুঁতছে, জুনুর — অর্থাৎ জনার বা ভুট্টা। জঙ্গলের রাস্তা বাতলে দিলেন উনি; সেইমতো আমরা যাত্রা শুরু করলাম।
মাস্টারডাঙার মাঠ হয়ে শাল জঙ্গলের রাস্তায় উঠলাম। সাবধানী চোখে এগিয়ে যাচ্ছি, জঙ্গলে রয়েছে রেসিডেন্সিয়াল দাঁতাল-এর একটি দল, কখন তার সামনে পড়ি এই যা। তবে ভালো কথা, মুখোমুখি পড়তে হয়নি, প্রায় এক ঘন্টা রাস্তা গেছি — রোদ হারিয়ে গেলো। বৃষ্টি নামলো, দাঁড়ালাম, জঙ্গল-এর ভেতর থেকে শাল গাছ কাটার শব্দ আসছে, ফলে বন কমছে।
পথে পড়ল একদল শিকারী, হাতে বল্লম, লাঠি তির ধনুক। জিজ্ঞেস করলাম, বনে এখন শিকার করার মতো কী আছে?
দলটির প্রধান জানাল, ময়ুর বুনো শুওর বনমুরগী খরগোস। ওদের মুখে শুনলাম – ময়ুর-এর সংখ্যা দারুনভাবে কমে যাচ্ছে, বুনো শুওর হাতির পায়ে পায়ে আসে, বনমুরগী তেমন দেখা যাচ্ছে না।
এই যে দল বেঁধে শিকার দিনের পর দিন — তার ফলে বন্যপ্রাণ এর ভারসাম্য কমছে। আদিবাসী সমাজে অবশ্য শিকারের জন্য গিরা বা ডাক দেয়া হয়, এবং বছরে দু-বার শিকার হয় বাকি সময় হয়না, এই জঙ্গল-এ সে নিয়ম মানা হয় না। আমরা রানী গ্রাম কীভাবে যাব? ওরা বলতে পারলো না।
পথে দেখা হল কাঠ কুড়ন মেয়েদের একটি দলের সাথে। ওরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে; ওরা ধানসীমলা যাবে, রাস্তা ভুল করেছে। আমাদের আসার পথটি ছিল ওই পথ। ওরা কাঠের বোঝা মাথায় নিলো। দেখলাম শীর্ণ কিশোরী মেয়েটির মুখে হাসি, যদিও ওদের খালি পা সস্তার শাড়ি, মাথায় কাঠের বোঝা। এই কাঠ যাবে সোনামুখী বাজার, খাবার দোকানে। তবেই ওদের ঘরে যাবে আহার, সস্তার মোটা চাল, বুনো শাক, কন্দ। ওদের না দেখলে ভাবা যাবে না … কি সামান্য চাহিদা এবং এই জঙ্গলের ওপর নির্ভর করে ওরা।
এবার চৌরাস্তা পেলাম। বামদিকে মোড় নিলাম, পৌঁছে গেলাম রানী গ্রামে। সে কথা পরে। এই গ্রামে ঢোকার মুখে পেলাম বাঁধ, বাঁধের নীচে চাষজমি। বীজতলা ফেলার কাজ চলছে। আবার বৃষ্টি নামলো। এবার মুষলধারায়, ছাতার তলায় দাঁড়িয়েও ভিজলাম। ফেরার পথ ধরলাম। একটি ছোটো গ্রাম ভীমারা, বেলডাঙা চক, একটি ছোটো পার্ক, মুসলো, সোনামুখী বাজার হয়ে আবার বেঁশের ব্রীজের রাস্তা ধরে মাস্টারডাঙায় ফিরলাম।
Leave a Reply