অমিত মাহাতো, ঝাড়গ্রাম, ২৭ ফেব্রুয়ারি#
রাত্রি সাড়ে সাতটা নাগাদ আমাদের বাস ঢুকল দুর্গাপুরে। স্ট্যান্ডে ঢোকার আগে সকলকে নামিয়ে দিতে আমরা পড়লাম ফ্যাসাদে। ফ্যাসাদ বলতে থাকব কোথায় এই চিন্তা। নেপাল বলল, এ হল শিল্পাঞ্চল। হোটেলে উঠলে আর আমাদের কেউ বেকার বলে ভাববে না — এত চড়া রেট। অর্থাৎ আমাদেরকে রাতটা কাটাতে হবে কোনোমতে স্টেশনে বা বাইরে। সেই মতো বাসস্ট্যান্ডকে বাঁদিকে রেখে ডানদিকে উত্তর-পূর্বে রাস্তা বরাবর হাঁটা লাগালাম। দু-তিন মিনিট। ইস্টিশনের চাতাল তখনো ভরে ওঠেনি। স্থির হল, এখানেই রাতটা কাটাব। তার আগে কিছু খেতে হবে। বাঁকুড়াতে সেভাবে খাওয়া না হওয়ায় খিদেটা সওয়ারি হয়েছে আমাদের সাথেই। সন্ধ্যের শেষ বাস হওয়ায় তার ওপর ইঞ্জিনের ঢাকনায় বসে শরীরও টালমাটাল, প্রায় বিপর্যস্ত অবস্থা। সকালের খাওয়া।
সারাদিনের ট্রেনজার্নি বাসজার্নি শেষে পৌঁছলাম। বাসস্ট্যান্ডের ভেতরে কাতারে কাতারে জয়দেবগামী মানুষ। মানুষের পেছনে মানুষ এবং বাসের পেছনে বাস। লাইন বরাবর। দেখলাম, দুর্গাপুর জয়দেব মেলা কমিটি মাত্র পঁচিশ টাকার বিনিময়ে হাজারো পুণ্যার্থীর স্নানে যাওয়ার জন্য বাসের ব্যবস্থা করেছেন। বাস চলবে রাত এগারোটা অবধি। তারপর আবার ভোর চারটে থেকে। ইচ্ছে করছিল এই সুযোগে জয়দেব ঘুরে আসি। কিন্তু আমরা তো এসেছি, বেকারত্ব ঘোচানোর পরীক্ষায়। আমি সে পরীক্ষার্থীর পথসঙ্গী। স্ট্যান্ডের লাগোয়া সারি সারি হোটেলের একটিতে ঢুকে পড়লাম রাতের খাবারের জন্য। বাড়িতে থাকলে ভাতই খেতাম। এ হোটেলে ভাত মিললেও আমরা খাবো রুটি। নেপাল দরদাম করে খাবারের অর্ডার দেয়। রুটি তিনটাকা পিস। পাঁচটি পনেরো। এবং সবজি তরকারি কুড়ি টাকা প্লেট। আমাদের ঝাড়গ্রামে রুটি ও সবজি কুড়ি টাকার মধ্যে হয়ে যায়। এখানে পঁয়ত্রিশ টাকা। প্রায় দ্বিগুণ।
কিন্তু করার তো কিছু নেই। খেতে হবে। খেয়ে এসে দেখি, স্টেশন সংলগ্ন পুরো চাতাল ভরে গেছে মানুষে। যে যার লোটাকম্বল বের করে বিছিয়ে দিয়ে প্রত্যেকেই এখন ঘুমোনোর তালে। প্ল্যাটফর্মের বেরোনোর মুখের কোনায় আমরা আমাদের আসন পাতলাম। মাথার সামনে ব্যাগ আর জুতো রেখে। এ ঘুম নিশ্চিন্তের নিশিযাপন না হলেও কিছু করার নেই। আমার ডানপাশে গেরুয়া বসনধারী পুরুলিয়ার এক বাবাজি। ভাষার আঞ্চলিকতায় জমে উঠল আলাপ। উনি যাবেন কাল সকালে। রাতটা এখানে কাটিয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, বিশ্রাম নিচ্ছেন? ‘হ্যাঁ বাবা, চলতে চলতে তো এতকাল চলে এলাম।’ প্রস্থানের পথ হওয়ায় আমাদের মাথা বরাবর পায়ের শব্দ। এ শব্দ জয়দেবমুখো। রাত বাড়তে বাড়তে এখন এগারোটা। দেখছি বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন মানুষ। বিভিন্ন পোশাক আশাক। বিভিন্ন তাদের বাচনভঙ্গী। হাঁটাচলাও আলাদা। আমাদের বাঁদিক ডানদিক সামনে পেছনে একটুক্ষণ শরীরটাকে গড়াতে চাইছে সকলেই। তারপর সময় এলেই যে যার গন্তব্যে চলে যাবে। তারপর হয়তো আমাদের মতোই হিসেব কষতে বসবে — কত খরচ হল, কত জমা আছে। ঘর পৌঁছানো যাবে তো ইত্যাদি ইত্যাদি।
পায়ের দিকে জায়গা করে নিল তিনজনের একটি কালানদার গোষ্ঠী, যাদের কাজ গ্রামে গ্রামে খেলা দেখানো। ওরা ওদের ঘরে ফেরার ট্রেনটি ধরতে পারেনি। বাড়ি বীরভূম জেলার সিউড়ি সদরের ভেতরের কোনো এক গ্রামে। মকরের জন্য ওরা ফিরছে ঘরে। পরিবারও সে আশায় রয়েছে। ওদের একজনের বয়স তিরিশ হবে বোধহয়। ওই দলের প্রধান। সুরেশ কালানদার। বিয়ে করেছে। বাল-বাচ্চা আছে। ওদের কথার মধ্যেই আধা ভোজপুরী আধা হিন্দি মেশানো। নিজেদের মধ্যে ওই ভাষায় ভাব বিনিময় করছে। একটা আলাদা টান। একটা আলাদা মাটি। সুরেশ কালানদারের সাথে কথা বলে জানলাম, ওদের পূর্বপুরুষ বিহারের ভাগলপুরের কোনো অঞ্চল থেকে এদেশে এসেছিলেন, গরু ছাগল বাগালির জন্য। আর ফেরেননি। এখন সেসব পেশা নেই। ওরাও জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ, যেমন বুকের ওপর টিউবলাইট ভাঙা এবং ছাতিতে ভারী পাথর রেখে খেলা দেখানো এইসব করে জীবনধারণের উপায় খুঁজে নিয়েছে। এ সত্যিই কষ্টকর।
আরও কষ্টকর, সকালবেলা যখন শৌচকর্মের জন্য স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণে চলা শৌচালয় ব্যবহার করতে হল। পায়খানা সাত টাকা, ব্যাগ রাখলে আট। ভাবা যায়! হাওড়া স্টেশন বা কলকাতায় পাঁচ টাকা দিয়ে স্নান অবধি হয়ে যায়। এখানে সব দ্বিগুণ। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। নেপালের কথামতো — এই নাহলে শিল্পাঞ্চল!
Leave a Reply