অমিত মাহাতো, ১৩ ফেব্রুয়ারি#
পনেরোই জানুয়ারি আমার বন্ধু নেপালের কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কে গ্রুপ ডি পদের ইন্টারভিউয়ের ডাক পড়ায় ১৪ জানুয়ারি অর্থাৎ মকরের আগের দিন আমাদের রওনা দিতে হয়। দুপুর দুটো কুড়ি মিনিটের আদ্রা প্যাসেঞ্জারে চড়তে আমাদেরকে খাটকুড়া থেকে খড়্গপুর গামী হতে হয়। খড়গপুর মেদিনীপুর শালবনী গড়বেতা ওনদা গ্রাম বিষ্ণুপুর হয়ে যখন বাঁকুড়া পৌঁছায়, তখন সবে সন্ধ্যে পাঁচটা বাজে। বেরিয়ে এলাম।
বাস রাস্তার গায়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি কীভাবে যাব। আমাদের মতো পথচারী একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, বাসস্ট্যান্ড পশ্চিমে, বাজারের শেষপ্রান্তে। অনেক দূর। হাঁটলে অন্ধকার হয়ে যাবে। ঝুঁকি না নিয়ে বাসস্ট্যান্ড গামী একটি বাসে উঠে পড়লাম। পাঁচ টাকা করে দশ টাকা ভাড়া দুজনের। মাঝে পড়ল কয়েকটি স্টপেজ — মাচানতলা, পেট্রোল পাম্প, মেডিক্যাল হাসপাতাল। আধঘণ্টার ভিড়ে ঠাসা পায়ে পা লাগিয়ে দম কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকা। পৌঁছালাম সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। একজন আমাদের গন্তব্যের বাসের জন্য বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিমে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের সারির দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেখিয়ে দিল। দুর্গাপুর গামী বাস হওয়ায় আমরা প্রায় হুড়মুড়িয়ে উঠলাম। কিন্তু কী কাণ্ড। সব সিট রিজার্ভড। দেখি কারো ব্যাগ, কারো মাফলার, কারো রুমাল, কারো জলের বোতল সিটে বসে দিব্বি আরামে আমাদেরকে যেন বলল — এখানে হবে না, এখানে হবে না। নেমে পড়লাম। স্থির করলাম, পরের বাসে যাব। তার আগে কিছু খেতে হবে, খিদে পেয়েছে খুব।
নেমে শুনলাম, পরে আর কোনো বাস নেই। রাতে তো নেই-ই। সেই ভোর নাগাদ — অপেক্ষা করতে হবে। আবার উঠলাম বাসে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে একটা ফাঁকা জায়গা পেলাম। বাসের ইঞ্জিনের ওপরের ঢাকনাটি। দেখলাম, ড্রাইভারের পেছনের সিটে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বসে আছেন। বাস ছাড়ার আগে বাসটা ভরে উঠল। দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত নেই, যেন তিল ঠাঁই আর নাহি রে। আমাদের বাঁদিক জানলার পরের সিটে বসে রয়েছে একটি পুরো পরিবার। সেই রায়পুর থেকে এই জায়গার দখলীস্বত্ব নিয়েছে তারা। দুর্গাপুরের আগে পর্যন্ত ওদের অবস্থা নট নড়নচড়ন। পেছনের চাপ নিতে নিতে আমি গিয়ে পৌঁছাই একেবারে সামনের কাঁচ বরাবর। ঠিক সেই সময়ই সালোয়ার কামিজ পরিহিতা দুটি মেয়ে ও একজন — পঞ্চাশের ওপর বয়স হবে — বাসে উঠলেন। উঠেই ড্রাইভারের পেছনের সিটে যেখানে দুজনের আরামদায়ক সিট, সেখানে বসেছিলেন যে ভদ্রলোক, সালোয়ার কামিজ পরিহিতা মেয়েটি দাবি করেন, এই সিটটি তার আগে থেকেই রিজার্ভ করা। নিচে কন্ডাকটর থেকে পয়সা নিয়ে কিনেছে। তা শুনে উঠে গেলেন ওই ভদ্রলোক। দাঁড়াবার একটি জায়গা পেয়ে সটান দাঁড়িয়েও পড়লেন। উনিও আমাদের মতো দুর্গাপুর গামী। মহিলাটি চমৎকার তরুণী। ড্রাইভার কিছু বললেন না। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলেন এক ঝলক। আমি পরিষ্কার বুঝলাম, ড্রাইভারের পেছনের সিটটি সংরক্ষিত মেয়েদের জন্যই।
অবশেষে বাস ছাড়ল। বাঁদিক হয়ে ঘুরে আবার ডানদিকে দৌড়তে দৌড়তে হাই রোড ধরল। কন্ডাকটর মাঝে মাঝে হাঁক দিচ্ছে, জয়দেব জয়দেব। এবাস যদিও জয়দেব যাবে না, এ বাস যাবে দুর্গাপুর। তাই জয়দেব গামী মানুষ কিছু কিছু উঠছে বই কি। ভেতরে যদিও তিল ধারণের জায়গা নেই। তবু উঠছে। আজকে এ বাসের পোয়া বারো। ঘণ্টা দেড়েকের এই বাস জার্নিতে অবশেষে বাস ছাড়াল বেলিয়াতোরের জঙ্গল। রাত্রিবেলা এর অন্যরূপ দেখলাম। দেখলাম, রাস্তার গায়ে বিশেষ সাদা টিউবলাইটের আলোর ব্যবস্থা। ভাবছি কেউ হয়তো পুরো রাস্তা সাজিয়ে রেখেছে এইভাবে। কিন্তু না। এ হল পসরা সাজানো। জয়দেব গামী মানুষের জন্য কিছুক্ষণের বিশ্রাম, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদির আয়োজন করেছে রাস্তার গায়ে ফাঁকা দোকান ধাবাগুলো। আজ সেজেছে এভাবে।
দুর্গাপুরের সীমানায় ঢোকার আগে ড্রাইভারের পেছনের সিট ফাঁকা হয়ে গেল। ওখানে সেই দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোক টুক করে বসে পড়লেন। তাতেই আরেক ঝামেলা। অন্য এক মহিলা ওই জায়গাটি ছেড়ে দিতে বললেন। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি। পুরো বাস গরম।
মহিলা — উঠুন, এখানে আমি বসব।
বয়স্ক ভদ্রলোক — কেন উঠব? এ কি তোমাদের বাপ কেলের সম্পত্তি।
মহিলা — ভদ্রভাবে কথা বলুন। মেয়েদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় আপনি শেখেননি।
ভদ্রলোক — বয়স্ক মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলা উচিত, সে শিক্ষা তো তোমারও নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি
দেখি দু-জনেই সমান দাবিদার। সম্মানের।
Leave a Reply