মুনিশ, সম্পাদক, নাগরিক পত্রিকা, গুপ্তকাশি, ২৯ জুলাই#
১৬-১৭ তারিখের বিপর্যয়ের পর ২০ জুন আমাদের একটা টিম গিয়েছিল উত্তরকাশী। ওখানকার কিছু গ্রামে আমাদের টিম যায়। গ্রামগুলোর অবস্থা খুব খারাপ ছিল। কিছু লোক গম কাঁচাকাঁচাই খাচ্ছিল। যারা অসুস্থ ছিল, আমরা তাদের চিকিৎসাও করেছি। তারপর আমরা তিনটি টিম বানাই। একটা টিম পিথোরাগড়, একটা টিম পৌরির দিকে আর একটা টিম এই কেদারঘাটির দিকে যায়। এই টিমগুলি সমীক্ষা করে ফিরে আসার পর আমরা বুঝি, ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি কেদারঘাটিতেই হয়েছে। প্রথমে আমাদের ধারণা ছিল, এখানে হাই প্রোফাইল টুরিস্টরা মারা গেছে, তাই মিডিয়া এবং সরকার এই জায়গাটাকে হাইলাইট করছে বেশি। কিন্তু তা সত্যি নয়।
১৩ জুলাই আমরা শ্রমিক-ছাত্র-ডাক্তারদের বিভিন্ন সংগঠন মিলে ‘উত্তরাখণ্ড আপদা রাহাত মঞ্চ’ বানিয়ে গুপ্তকাশী-উখিমঠ-কালিমঠে এসে আমাদের ঘাঁটি তৈরি করি। প্রথমে আমাদের টিমে চারজন ডাক্তার, চারজন সমাজকর্মী এবং একজন মেডিক্যাল ছাত্র ছিল। আমরা তারপর গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে যেতে শুরু করি। বেশি করে সেই সব ঘরগুলোতে আমরা যাচ্ছিলাম, যেগুলোর লোকেরা কেদারনাথ ধামে কাজ করতে গিয়েছিল। কিন্তু আর ফেরেনি। আমরা অসুস্থদের ওষুধ দিতে শুরু করি। প্রথম দুদিন আমরা উখিমঠের কিছু গ্রামে ঘুরছিলাম। উখিমঠ রুদ্রপ্রয়াগ জেলার একটা তহশিল এলাকা। তারপর আমরা কালিমঠ ঘাটির গ্রামগুলোতে কাজ করা শুরু করি। এই কালিমঠ এলাকা আমরা পুরোটাই হেঁটে হেঁটে চড়াই উতরাই ভেঙে গিয়েছি। রাউনলেক নামে এখানে একটা বড়ো বাজার এলাকা আছে। সেখানে আমরা গেছি। ওই জায়গাটার সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর সংযোগের মাধ্যম জুগাসু ব্রিজ। কিন্তু ওর পাশ দিয়েই গেছে এপিসি জলবিদ্যুত কোম্পানির একটা টানেল। তার জন্য ওই ব্রিজটা এই প্লাবনে ভেঙে গেছে। ওখানে যাওয়ার রাস্তাও ভেঙে গেছে। গাড়ি যাচ্ছে না। ওখানে পায়ে হেঁটে পৌঁছানোর পর আমরা মেডিক্যাল ক্যাম্প বসাই। তাতে বহু সংখ্যায় রোগী আমাদের ক্যাম্পে আসে। ওখানকার সেইসব ঘরগুলোতে আমরা গেছি, যেসব ঘরের ছেলেরা কেদারঘাটিতে ওই সময় কাজ করতে গিয়ে আর ফেরেনি এখনো। ঘরের মেয়েরা পাথরে ঠেস দিয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে বসেছিল। আমরা কিছু তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা জবাব দিচ্ছিল না। ওদের চোখের শূন্যতা এবং ভার আমরা ভাঙতে পারিনি। ওদের মধ্যে অনেকেরই শরীর খারাপ থাকা সত্ত্বেও ওরা আমাদের কাছে এসে ওষুধ চায়নি।
আমাদের মনে হয়েছে, এই উখিমঠ তহশীলের গ্রামগুলোর মানুষের জীবন দুই দিক থেকে সামনে যাওয়ার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। এক, সত্যি সত্যিই কেদারঘাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে, ঘরের সক্ষম পুরুষ হারিয়ে যাওয়ার ফলে, দামি খচ্চর খোয়ানোর কারণে বাস্তবেই রাস্তা বন্ধ। দুই, গ্রামের স্কুলে পড়া বাচ্চা ছেলেদের হারিয়ে তাদের জীবনের যাত্রাও থমকে গেছে।
কালিমঠের একটা গ্রামে এক মহিলার সাথে আমাদের আলাপ হয়। নাম আশা দেবী। ওঁর স্বামী ১৬ তারিখ কেদারঘাটিতে মারা যায়। ওইদিনই ওর বাচ্চা মেয়ে জন্মায় ঘরে। কেউ তাকে টিটেনাস বা বিসিজি ইঞ্জেকশন দেয়নি। একদিকে কেদার নিয়ে উত্তরাখণ্ড সরকার এত কথা বলছে, অন্যদিকে এই হাল। আরেকটি গ্রামে একজন মহিলাকে আমরা দেখি, যাঁর বর ফেরেনি কেদার থেকে। অনেকদিন পর পর্যন্ত ওর আশা ছিল, ফিরবে। কারণ গ্রামের লোক এক-দুজন করে বেশ কিছুদিন পর পর্যন্ত ফিরছিল। যখন ও বুঝতে পারে, আর ফিরবে না, তখন সে এতটাই ভেঙে পড়ে যে ওর সাত মাসের বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়ে যায়। তার পর ওর লাগাতার ব্লিডিং শুরু হয়। আমাদের টিমের ডাক্তাররা ওকে কিছুটা শুশ্রূষা করতে সক্ষম হয়। একটি গ্রামে এক ৭৫ বছরের বুড়ির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। তাঁর ছেলে সমেত ১১ জন আত্মীয় মারা গেছে কেদারঘাটিতে। তিনি এমন করে কাঁদছিলেন, আমি আমার ক্যামেরাটুকু তাঁর সামনে বের করে ধরতে পারিনি। আটকে গেছি। একটি গ্রামে এক বৃদ্ধ লোকের পরিবারের ৬ জন কেদারঘাটি থেকে আর ফেরেনি। তার কান্না দেখা যাচ্ছিল না।
কেদারঘাটির দুঃখে ভারাক্রান্ত এই গ্রামগুলোতে সরকার বলে কিছু হাজির নেই। কারো ঘরে ফাটল ধরেছে ভূমিধসে। কারোর ঘোড়া খচ্চর মরে গেছে। কিন্তু তাদের যদি সরকারের কাছ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পেতে হয়, তাহলে উখিমঠ অথবা গুপ্তকাশি আসতে হবে পায়ে হেঁটে। সরকারের তরফে তাদের দুঃখ দুর্দশা সহানুভূতির সঙ্গে শোনার জন্য কেউ নেই। সরকারি মেশিনারি পুরোপুরি ব্যর্থ।
Leave a Reply