বিকর্ণ, ২৫শে জানুয়ারী,২০১৫সূত্র আস্থাভারতী, গ্লোবাল সিকিউরিট, ডেইলি নয়া দিগন্ত, বিগ থিঙ্ক ওয়েবসাইট-গুলি।#
ভারত বিভাজন করে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু্টি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়ে, ১৯৪৭ সালে, রেডক্লিফ মানচিত্র বিভাজন থেকেই উদ্ভব হয় এই ছিটমহলের। এক দেশের ভূখণ্ড রয়ে যায় অন্যদেশে।
মোট ১৬২টি ছিটমহলের মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল আছে বাংলাদেশে, আবার বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল আছে ভারতে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতের ছিটমহলে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা ৩৭ হাজার। আর বাংলাদেশের ছিটমহলে ১৪ হাজার। মোট ২৪,২৬৮ একর জমির মধ্যে ভারতবর্ষের ১৭,১৫৮ একর ও বাংলাদেশের ৭১১০ একর। বাংলাদেশের যে ছিটমহল ভারতের মধ্যে আছে তাদের অধিবাসীদের অধিকাংশই মুসলিম। ভূখণ্ড ভারতের হলেও সবকিছু কেনাবেচা হয় বাংলাদেশি টাকায়। কোচবিহারে কোচ রাজাদের রাজ্যের কিছু অংশ রাজ্যের বাইরে বিভিন্ন থানা — পঞ্চাগড়, ডিমলা, দেবীগঞ্জ পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, লালমণিরহাট, ফুলবাড়ি ও ভূরুঙ্গামারিতে অবস্থিত ছিল। ভারতভাগের পর ওই আটটি থানা পূর্বপাকিস্থানের অন্তর্ভূক্ত হয়, আর কোচবিহার যুক্ত হয় পশ্চিমবঙ্গের সাথে। স্বাধীনতার এতদিন পরও উন্নয়নের ছিঁটেফোটা লাগেনি এই মানুষগুলোর জীবনে। মানুষের জীবন কাটে বিএসএফ বা বিডিআর-এর কড়া নজরদারিতে।
লালমণিরহাট জেলার পাটগ্রাম থানা সদর থেকে ১৭ কিমি দূরে অবস্থিত ভারতীয় ভূখণ্ডে সবচেয়ে বড় বাংলাদেশী ছিটমহল দহগ্রাম আঙ্গারপোতা। ভারতীয় ভূখণ্ডে এটি একটি বাংলাদেশী ইউনিয়নও বটে। বেসরকারী হিসেবে এখানকার জনসংখ্যা ১৫ হাজারের মত, যাদের মধ্যে ২০০-২৫০ পরিবার একেবারেই ভূমিহীন। এরকমই ছিটকরলা, ৩ কিমি ভারতীয় ভূখণ্ড দিয়ে বিচ্ছিন্ন। ভারতীয় ভূখণ্ড না পেরিয়ে ছিটকরলা যাওয়ার কোনও উপায় নেই।
ছিটমহল অঞ্চলের এরকম বিচিত্র অবস্থানের কারণ হিসেবে ইতিহাসে এইরকম উপকথা চালু আছে যে কোচবিহারের মহারাজা আর রংপুরের ফৌজদারদের মধ্যে দাবা অথবা পাশা খেলার বাজি হিসেবে ব্যবহার হত এইসব গ্রামগুলি। পরে একসময়ে খেলা বন্ধ হয়ে গেলেও কোন অঞ্চল কার দখলে থাকবে তার কোনও নির্দ্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি। পরে ১৭১১ থেকে ১৭১৩ সালের মধ্যে কোচবিহার মহারাজা ও মুঘল সম্রাটদের মধ্যে এক চুক্তির ভিত্তিতে মুঘলরা কোচবিহারের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল নিজেদের অধীনে নিয়ে নেয়, যদিও মুঘলরা সেই অঞ্চলের প্রধান বা সেনাপ্রধানকে স্থানচ্যূত করেনি। একইসঙ্গে মুঘল সৈন্যরা কোচবিহারেই জমি নিয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করে, যদিও তারা মুঘল সম্রাটদের প্রতিই অনুগত ছিল। তখনও দুই অঞ্চলের সীমানা তৈরি করার মতো কোনো তাগিদ দেখা দেয়নি। উপমহাদেশে তখন এত ছোটো ছোটো স্বাধীন করদ রাজ্য ছিল যে সেভাবে সীমানা নির্ধারণ করাও কঠিন ছিল। একইভাবে কোচবিহারের সেই নির্ধারণ না হওয়া অঞ্চলগুলি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন থাকার কারণেও সুনির্দ্দিষ্ট সীমানার প্রয়োজন দেখা দেয়নি, কারণ অঞ্চলগুলি নামেমাত্রই মুঘলদের অধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে মুঘলদের থেকে ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে চলে গেলেও, ইতিহাস বলছে, ১৮১৪ সালে কোচবিহার রাজ্যের মধ্যেই কিছু ছোটো ছোটো বিন্দুর মত অঞ্চল দেখে তারা বিস্মিত হয়। কারণ নির্ণয় করতে না পেরে মানচিত্র প্রস্তুতির সময় কালির ছিটে বা ওইজাতীয় কোনো দুর্ঘটনা বলে মনে করে তারা।
১৯৪৭ সালের পর মুঘলদের অংশ পূর্বপাকিস্তানের সাথে জুড়ে যায় আর আরো ৬০০-র কাছাকাছি স্বাধীন করদ রাজ্যগুলি কোচবিহারের মতো ভারতবর্ষের অংশ হয়ে যায়। এবারে ওই সীমানা নির্ধারন করার কাজটা যে খুব সহজ ছিল এমনটা নয়, কিন্তু অনেকের মতেই স্যর র্যাডক্লিফের আরও দায়িত্ব সহকারে কাজটা করা উচিত ছিল। ব্রেন্ডন আর হোয়াইট (Brendan R. Whyte) এর লেখা পেপার “An historical and documentary study of the Cooch Behar enclaves of India and Bangladesh” এ লিখেছিলেন “ ১৯৪৭ নাগাদ র্যাডক্লিফকে ফিরজ খান লাহোরে যেতে নিষেধ করেন,কারন তিনি জানতেন র্যাডক্লিফের পক্ষে শিখ ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়কে সমানভাবে সন্তুষ্ট করা সম্ভবপর হবে না। দ্য স্টেটস্ম্যান এ বিষয়টির অসারতা সম্পর্কে লেখা হয় ‘ভারতের সীমানা নির্ধারনের কাজটা স্যর সিরিল হয়তো লন্ডন বা সুদূর আলাস্কা থেকেও সম্পন্ন করতে পারতেন। সম্ববত তার উচিত ছিল পাইলট হিসেবে একজন এস্কিমোকে নেওয়া তাহলে নিশ্চই কোনও দল, কোনও পক্ষ থেকেই আর কোনও আপত্তি আসতো না’”।
এবারে ওই অনির্ধারিত অঞ্চলগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে ১৯৫৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী জওহরলাল নেহেরু ও পূর্বপাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মহঃ ফিরোজ খান নুনের মধ্যে প্রথম সীমানা নির্ধারণ চুক্তি হয়। কিন্তু সমস্যা বাধে ১২ নং ইউনিয়ন দক্ষিন বেরুবাড়ি নিয়ে। স্যর রেডক্লিফের আঁকা ম্যাপ অনুযায়ী ওই অঞ্চল ভারতের ভাগে হয়। আবার লিখিত বয়ান অনুযায়ী তা পূর্বপাকিস্তানের ভাগে আসে। ওই ইউনিয়নের অ-মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠী পূর্বপাকিস্তানের সাথে যেতে অস্বীকার করে। তারপর এক দশকেরও বেশি সময় কেটে যায়, কিন্তু ভারত বা পূর্বপাকিস্তান কোনও দেশই নিজেদের দাবি থেকে সরে এসে সমাধানের কোনো পথ খোঁজার চেষ্টা করেনি। ১৯৫৮-র চুক্তি অনুযায়ী স্থির হয়, অঞ্চলটিকে ২টি প্রায় সমান অংশে ভাগ করা হবে, দক্ষিণভাগ, দুটি ছিটমহল সহ পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে আর উত্তরের অংশ ভারতের সাথে সংযুক্ত হবে। দ্বিতীয়ত, সেই চুক্তিতে এই ছিটমহলের সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টাও করা হয়েছে। যে ছিটমহল যে দেশের সীমানার মধ্যে পরে, তাকে সেই দেশের সঙ্গে যুক্ত করে দেবারও প্রস্তাব রাখা হয়। সেই মত ১১৩টি পূর্বপাকিস্তানে অবস্থিত ভারতীয় ছিট ও ৫৩টি ভারতে অবস্থিত পাকিস্তানী ছিটকে যথাক্রমে পূর্বপাকিস্তান ও ভারতের সাথে অন্তর্ভূক্ত করার প্রস্তাব রাখা হয়। আর সীমানা নির্ধারণে ভারতের যে অতিরিক্ত জমি পুর্বপাকিস্তানের অংশ হবে, তার জন্যে ভারত কোনও ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবে না। তৃতীয়তঃ সীমান্ত নির্ধারণের সব ত্রুটিবিচ্যূতি ঠিক করতে হবে।
যদিও নেহেরু-নুন চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ অংশ পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করা যায়নি ভারতিয় সুপ্রীম কোর্টের একটি মামলার ভিত্তিতে। এই মর্মে মামলা করা হয় যে ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী কোচবিহার রাজ্য যেহেতু ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেই কারণে কোচবিহারে অবস্থিত ছিটমহলও ভারতের অংশ। তাই বেরুবাড়ির দক্ষিণাঞ্চল বা অন্য কোনও ছিটমহল বিদেশি রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। সুপ্রীম কোর্ট সমস্যা সমাধানের জন্যে এই মর্মে রায় দিয়েছিল, সংবিধান সংশোধন করে যত দ্রুত সম্ভব বেরুবাড়ি ইউনিয়ন নং ১২ এবং পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্গত ভারতীয় ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়া শুরু করার জন্যে। সেই মতো ১৯৬০ সালে সংবিধানের নবম সংশোধন ঘটে। এরপরও চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিনিময় সংঘটিত হয়নি। সেই সময়ে দুই দেশের মধ্যে যাতায়াতের জন্যে পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়েও চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু দুই দেশই সম্ভবত ছিটমহলবাসীর কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। উইলহেম সেন্ডেল (WILHELM SCHENDEL) তাঁর লেখা বই “STATELESS IN SOUTH-ASIA: THE MAKING OF BANGLADESH ENCLAVES” –এ এই মর্মে লিখেছিলেন “তারা আইন না ভেঙ্গে পাসপোর্ট তৈরী করতে পারবে না। যেহেতু ছিটমহলের ভেতরে কোনও পাসপোর্ট অফিস নেই, কেউ যদি মূল ভূখন্ডে আসতে চায় তবে অবৈধভাবে বিদেশি রাষ্ট্রে অনুপ্রবেশ করে সেটা পেড়িয়ে তারপর আবার বেআইনিভাবে সেই রাষ্ট্র থেকে নিজের দেশে ঢোকার চেষ্টা করতে হবে। তাকে যদি ঢুকতে দেওয়া হয় শেষপর্যন্ত তবে সে বহু মাইল গিয়ে বাড়ি ফেরার ভিসা যোগার করার জন্যে কনস্যুলেট অফিসে যেতে পারবে। আর যদি ভিসার মেয়াদ পেড়িয়ে গেল। তাকে আবার এই বেআইনি কাজটা পূনরায় করতে হবে। পাসপোর্ট চুক্তি থেকে এই মানুষদের বাদ দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান তাদের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে তাদের দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছে।
১৯৭১ সালে পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে দুই দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দুই দেশের মধ্যে সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রেখে ওই ছিটমহল সমস্যার স্থায়ী এবং অপরিহার্য্য সমাধান খুঁজতে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিষয় নিয়ে ব্যাপক ভাবে আলোচনা করার পর ১৯৭৪ সালের ১৬ মে একটি স্থলভাগ বন্টন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি ছিটমহলবাসীর যে দেশে আছেন সেই দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করার আলোকেই স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে একইসঙ্গে দুই দেশের জরিপ কর্তাদের ওই অঞ্চলের জমির নিখুঁত বর্ণনা ছাড়াও এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকা সীমানাহীন অঞ্চলগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে একটি দ্রূত একটি সীমারেখা অঙ্কন করার কথা হয়, যেখানে দুই দেশের সৌহার্দের সম্পর্কে যেন চিড় না ধরে। সেই মত স্ট্রিপ ম্যাপ তৈরি হলে, পুরোনো খুঁটি সরিয়ে নতুন সীমানা অনুযায়ী খুঁটি পোঁতার কাজ শুরু হওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে ৩৫.৫ কি.মি অঞ্চল নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। পুরোনো সীমানার খুঁটি তুলতে ভারতের তরফ থেকে আপত্তি জানিয়ে বলা হয়, এর ফলে সীমানা পুরো উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে যার ফলে স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত হতে পারে। এর ফলে প্রক্রিয়া দেরি হতে হতে একসময়ে আবার বন্ধ হয়ে যায়।
তারপর ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সর্দার মনমোহন সিংহ ও শ্রীমতি শেখ হাসিনার মধ্যে প্রোটকল চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও শেষ পর্যন্ত কাজের কাজ কিছু হয়নি।
এখানেই আছে পৃথিবীর একমাত্র তৃতীয় শ্রেণির ছিটমহল ঢাকা খাগড়াবাড়ি #৫১। এই ছিটমহলের চিত্রটি ঠিক কিরকম? ভারতবর্ষের একখন্ড (ঢাকা খাগড়াবাড়ি)যাকে ঘিরে রয়েছে বাংলাদেশের একখন্ড(উপানচৌকি ভজনি), যার বাইরে ভারতের অংশ(বালাপাড়া খাগড়াবাড়ি), তাকে ঘিরে রয়েছে বাংলাদেশ এর মূল ভূখন্ড আর তার বাইরে ভারতীয় মূল ভূখন্ড। এই ছিটমহলের আয়তন ৭০০০ বর্গমিটারেরও কম ১.৭ একরের কাছাকাছি আর এখানে শুধুমাত্র পাটচাষের জমি আছে।
এই তৃতীয় শ্রণীর ছিটমহল ছাড়াও ১০২টি ভারতিয় অ ৭১টি বাংলাদেশী ছিটমহলের ভেতরে ২১টি ভারতীয় ও ৩টি বাংলাদেশী দ্বিতীয় শ্রেণির ছিটমহল আছে।
আবার সীমানা না থাকায় অঞ্চলগুলিতে অপরাধমূলক কাজকর্মের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন রকমের চোরাচালান, বিশেষ করে গোরুপাচার হামেশাই ঘটে থাকে। বিএসএফ বা বিডিআর এর হাতে গুলি খেয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০০-র কাছাকাছি মানুষ প্রাণ হারান।
এখনো ছিটমহলের বাসিন্দাদের গড় আয়, সমীক্ষা বলছে, ১৭ টাকা প্রতিদিন। এভাবেই চলছে তাদের দিন। মানচিত্রের বিন্দুগুলি নিয়ে দুই দেশের টানাপোড়েনও চলছে। এ খেলা চলছে নিরন্তর চলছে।
Leave a Reply