পর্ণব। বেলডাঙা। ৩ অগাস্ট, ২০২০।#
বেলডাঙ্গা স্টেশনের তিন নম্বর লাইনে চেন দিয়ে বাঁধা আছে শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন। তাই ঘাড়ে সাইকেল তুলে রেলব্রীজ পেরনোর মুখে চোখে পড়ল এক নম্বর প্লাটফর্মের বাইরে সার সার কাঁচের চুরির দোকান ফাঁকা পড়ে আছে বকরীদের আগের দিন। খোঁজ করছিলাম চীনেদের পাড়া। এক ছেলে বলল, ও সেই ইংরেজরা ?
চীন থেকে যখন করোনা ছড়িয়েছে আর আম্রিকায় যখন এত মানুষ মরছে আর গালোয়ানে যখন ইন্ডিয়ান আর্মি দু’গোলের বদলায় দশ গোল দিচ্ছে, সেই চীনা পণ্য বয়কট করার শোরগোলের মধ্যে পৌঁছে গেছিলাম বেলডাঙার ছাপাখানা মোড়ে। সেখানে এক চুল ব্যবসার অফিস চিনিয়ে দিলেন পাশের চা-দোকানদার, যিনি নিজেই মাঝপথে আমায় দাঁড় করিয়েছিলেন বিদেশি সন্দেহে। অফিসে স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙি পরা এক দল যুবক জানলা দিয়ে দেখেই কানাকানি শুরু করেছিল। ভিতরে গিয়ে পরিচয় দিতে আরো ব্যস্ত হয়ে কথাই বলতে চাইলনা। বাইরের চা-দোকানি অবশ্য বলেছিলেন, এদেশে করোনা ধরা পড়ার আগেই সব পালিয়েছে। বুঝলাম বেলডাঙার বিদেশনীতি বেশ গোলমেলে।
রেজিনগর পেরিয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে মুর্শিদাবাদ ঢোকার মুখে বেলডাঙার বাজার গমগম করাই সম্বৎসরের চেনা ছবি। দক্ষিণের জেলাগুলিতে কেউ বেলডাঙা চেনে গামছার টানে, কেউ তার বাজারদর চেনে লঙ্কার মার্কেটে। যদিও বেলডাঙা খ্যাত গামছা বেলডাঙায় তৈরি হয়না। আকাশের মুখ ভার ভ্যাপসা গরমের দিনে ব্রিটিশ আমলের পুরনো বন্ধ চিনিকলের বিষন্ন চিমনির ছোঁয়াচরোগে যেন গোটা বাজার মুখ কালি করে বসে আছে। একটা মাত্র বিরিয়ানির দোকান খোলা। রেডিমেডের দোকানে দু একটা খরিদ্দার। লালগোলা ধরে কলকাতা হয়ে বাইরে কাজ করতে যাওয়া মিস্ত্রি-লেবারদের মুখে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, চিনিকলটা খোলা থাকলে কি আর আমাদের বাইরে কাজ করতে যেতে হত?
বেলডাঙা থানার ছ’সাতটা গ্রাম – বেগুনবাড়ি, মির্জাপুর, হরেকনগর, মঝঝিমপুর, দেবকুন্ড, কাজীসাহা জুড়ে প্রায় লাখখানেক মানুষ চুলের ব্যবসার সাথে জড়িয়ে। বেশিরভাগ স্থানীয় মানুষই এককথায় বলেন, ২০০০ সালের পর থেকে এখানে এই ব্যবসার শুরু। ব্যবসার গোঁড়া মেদিনীপুরে। ভগবানপুর, চন্ডীপুরে। সেখানে কাজ করতে যেয়েই এ কারবার বেলডাঙায় নিয়ে আসে কেউ কেউ।
এববছর চাষের হাল বেহাল। এক বুক পানিতে পাট কাটতে হয়েছে। মালিক তাড়িয়ে দিলে, সরকার সবাইকে বাড়ি যাও বলে, ছেলেরা এই বসে আছে। গোটা পঞ্চাশ চা দোকান শুধু কাজীশা(সাহা) গ্রামেই। মাঠে মুনিশের দাম নেই। লোকালে যা দু’একটা কাজ পাওয়া যাচ্ছে রাজমিস্তিরিদের। একশো দিনের কাজ একশো দিনের নাকি? ও তো নেতার কাজ। চা দোকান জুড়ে তুমুল হৈচৈ। তাতে খানেক আমার সাইকেলে বেরিয়ে পড়ার ফাঁদফায়দা নিয়ে নানারকম চেনাজানা। চা সিগ্রেট। বিদেশি লোকের মেহেমানি করতে কসুর নেই কারো।
চীনাদের এখানে থেকে ব্যবসা করতে হয় কেন? পরিবার নিয়ে থাকে? সারাবছর থাকে? নাকি জিম্মি করে রাখা হয়? এমন হাজার কৌতুহলের মুখে রাস্তার ধারে কাঁটাঘরে ছেলেবেলা থেকে এ কারবার জানা ম্যানেজার জাহিরুল বলছিলেন, ওদের টাকা কত জানেন? চেকনোট দিয়ে এই গোটা ঘর ভরে রাখতে পারে। বউ বাচ্চা কেন, যা লাগবে তা’ই এনে দিতে হবে। টাকা দিলে। এখন তো অনেকেই (মানে) চীনারা সব চলেই গেছে। তবু কয়েকজনের সাথে দেখা হয়ে যাবে দেখবেন। আপনার মত সাইকেল নিয়ে যাবে এখান দিয়ে বিকেলের দিকে।
কথা না বাড়িয়ে সোজা এই কাজীশা গ্রামে এসে অত্যুৎসাহীদের সৌজন্যেই কয়েকজন মহাজনের সাথে কথা হল। মগরেবের আজানের আগে কয়েক তাড়া টাকা নিয়ে বসে আছেন। লেবার দের পেমেন্ট দিতে হবে। বস্তা বস্তা বাঁধা আছে হকারদের থেকে কিনে নেওয়া, নুটি বাঁধা পড়ে যাওয়া ঝরে যাওয়া সাদা কালো খয়েরি চুলের আঁটি।
হকাররা লোকালে, আশেপাশে জেলায় এমনকি বিহার, ইউ পি, উড়িষ্যা, নেপালে গিয়ে ব্যবসা করেন। এখন লকডাউনের সময় থেকে আর যেতে দিচ্ছেনা। নেপালের সাথে ঝামেলা, তাই সেখানেও যেতে দিচ্ছেনা। এসব দূর দূর দেশে ওনারা সাইকেল নিয়ে কিছু লাড্ডু, সোনপাপড়ি, পাঁপড়, আচার, থালাবাটি যাহোক একটা কমদামী শখ আহ্লাদের জিনিসের বদলে মাথা ছানা- ঝরা চুল সংগ্রহ করে দেশি মহাজনের কাছে বিক্রি করেন। ভালো মাল অর্থাৎ বেশি লম্বা ও পরিষ্কার চুল পেলে বড় মহাজন ধরার বাজি অবশ্য সবাই ধরতে চান। কেননা ব্যবসাটাই জুয়ো খেলার মত। মোসলমানের বুকে জোর আছে। তাই এই ব্যবসাটা ধরেছে- বলছিলেন আশপাশ থেকে জড়ো হয়ে যাওয়া মুরুব্বি গোছের কয়েকজন। এই ধরেন, এক কেজি কাঁচা মাল হকারদের থেকে কিনে নেব কেজি প্রতি বাইশশ’ থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে। সাইজ অনুযায়ী। আট-দশ ইঞ্চি থেকে দু-তিন ফুট। দু-তিন ফুটের চুল পঞ্চাশ হাজার বা তারও বেশি দামে কেনেন বিদেশিরা। সবই নাকি উইগ বা পরচুলা তৈরিতে লাগে। তিন হাজার টাকার মাল কিনলে তাতে আরও – ছাড়ানো, ফার্স্ট কাঁটা, ধোয়া, শ্যাম্পু, শুকোনো, আবার কাঁটা করা, দু নম্বর কাঁটা, গার্ডার বাঁধা, ছাঁটা এরকম নানা রকম কাজের জন্য লেবারদের দিতে আরো এক হাজার টাকা। সেটা আবার আমি বড় মহাজনের কাছে বিক্রি করব কেজি প্রতি দশ থেকে কুড়ি হাজারে। তারা সব এক্সপোর্টের মাধ্যমে বাইরের পার্টির সাথে ব্যবসা ধরে। কেউ কেউ বাড়িতেই ভাড়ায় রাখে বিদেশি ক্লায়েন্টদের। পথে দুজন মঙ্গোলীয় ধাঁচার চেহারার মানুষকে বাইকে যেতেও দেখেছি সত্যি। চা দোকানেও অনেকে বলছিলেন, চীনের লোকেরা অধিকাংশ চলে গেলেও অন্যান্য দেশের যেমন মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়ার কয়েকজন রয়ে গেছে। ওদের ভিসা পাসপোর্ট সব কাগজপত্র রেখে দিলে কী হবে? বিদেশের সাথে কারবার। পেমেন্ট না করে ধাঁ হয়ে গেলে? এমন ঝাড় খেতে হয়েছে কাউকে কাউকে, যে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তে হয়েছে, দেশছাড়া হতে হয়েছে কতজনকে।
চুল ছাড়ানো-ধোয়া-শুকনোর কাজ প্রথমে বাড়ির মেয়েরাই বেশি করেন। কাঁটা ঘর ভাড়া নিয়ে ছেলেরা কাটা ছাঁটা বাঁধার কাজ করেন বেশি। এসব কাজে কেজিতে একশ টাকার এদিক ওদিক মজুরি। দিনে অন্তত পাঁচশ টাকার কাজ করার টার্গেট থাকে সবার। সকাল সাতটা থেকে বিকেল তিনটে অবধি সাধারণত কাজ করেন লেবাররা। কাল ঈদ, তাই বেশি করে কাজ সেরে নিচ্ছেন সকলে। নইলে বিকেলের মধ্যে কাজ সেরে স্নান সেরে নেন সবাই। নোংরা কাজ তো।
এই গুঁড়ো টুকরো চুলে পেট খারাপ হয়না?- শুনে সবাই হাসাহাসি করে বলছিলেন, বরং ভালো হয়ে যায়। সব রোগ সেরে যায়। যে মেয়ের বাচ্চা হয়না, তার পেটে গেলেও বাচ্চা হয়ে যায়। মহাজনের বউ ধমক দেওয়ায় সম্বিত ফিরে মহাজন এবার বলেন, এসব কাগজে লিখে লাভ নেই। আর কথাও নেই। কোত্থেকে কী হবে। এই এখানে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে কেন ? বিদেশি লোক থাকছে কেন? তখন পুলিশ আসবে, বি এস এফ আসবে, নেতারা আসবে … এবার চলে যান।’
দেশ খুঁজতে মানে মানে বেরিয়ে পড়া গেল তারপর।
Suman mondal says
mandalarjun2345678@gmail.com