শমীক সরকার, কলকাতা, ১৫ অক্টোবর#
হংকং-এর ছাত্রছাত্রীদের পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্রের আন্দোলন এখনও চলছে, ইদানিং তা ‘অকুপাই’ বা দখল আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। ৩১ আগস্ট হংকং-এর রাজনৈতিক শাসক চীনের দেওয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, হংকংবাসী তাদের শাসককে (চিফ এক্সিকিউটিভ) নির্বাচন করতেই পারে, কিন্তু চিফ এক্সিকিউটিভ পদে যে দাঁড়াবে, তাকে হংকং-কে ভালোবাসতে হবে। সেই ভালোবাসার পরিমাপ করবে ১২০০ সদস্যের একটি কমিটি, যার সদস্যরা হংকং-এর ব্যবসায়ী এবং চীনপ্রেমিকদের প্রতিনিধি। কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন নিয়ে ভোটে দাঁড়াতে পারে ২-৩ জন, তাদের মধ্যে সে শাসক হবে, তা ভোট দিয়ে ঠিক করার হক রয়েছে হংকং-এর সাধারণ জনগণের।
বলাই বাহুল্য, এই শর্তাধীন সার্বজনীন ভোটাধিকার পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র নয় এবং হংকংবাসী, বিশেষত গণতন্ত্রের আন্দোলনকারীরা তা মানতে চায়নি। ক্লাস বয়কট করে আন্দোলনে সামিল হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এবং হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের যেমন সংগঠন রয়েছে, হংকং-এর হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরও সংগঠন তৈরি হয়েছে ২০১১ সালে, যার ইংরেজি নাম স্কলারিজম। এই সংগঠনের নেতা জোশুয়া উওং, বয়স মাত্র আঠারো। ২০১২ সালে নৈতিকতা ও জাতীয়তাবাদের নয়া বিষয় সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হলে তার প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এই সংগঠন।
২১ সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস বয়কট করেছিল, আর হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস বয়কট শুরু করে ২৬ সেপ্টেম্বর এবং আন্দোলনে নয়া জোয়ার আসে। টিম মেই রোডের কেন্দ্রীয় সরকারি অফিস লাগোয়া সিভিক স্কোয়ারে রাত সাড়ে দশটায় সময় বেড়া টপকে ঢুকে পড়ে জোশুয়া উওং-এর নেতৃত্বে শ’খানেক ছাত্রছাত্রী — ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল, সিভিক স্কোয়ার একটি পাবলিক জায়গা এবং সেটাকে বেদখল করেছে সরকার — তা সরকারের দখলমুক্ত করা। ঘন্টা দুয়েক পরে তাদের জোর করে বের করে দেয় পুলিশ, এবং টিম মেই রোড জমায়েত মুক্ত করে। প্রায় ৭৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং বেশিরভাগকে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হলেও জোশুয়া উওং-কে প্রায় চল্লিশ ঘন্টা আটকে রাখে পুলিশ।
কিন্তু আন্দোলন থেমে থাকে না। হংকং-এর অকুপাই আন্দোলন ২৮ মে থেকে টিম মেই রোড দখল করার ডাক দেয়। ওইদিন সন্ধ্যেবেলা পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে শুরু করে নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর। হংকং জনমানসে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। হাজার হাজার হংকংবাসী ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এবং জমায়েত করে অবরুদ্ধ করে দেয় আরো দুটি ব্যস্ত এলাকা — কজওয়ে বে এবং মংকক। দখল আন্দোলন চলতে থাকে।
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে হংকং-এর শাসকরা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনার কথা বলে। এই শাসকদের খুব ঘনিষ্ঠ এবং চীন ঘেঁষা কিছু সংগঠন (ভয়েস অব লাভিং হংকং প্রভৃতি) দখলকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু করে ৩ অক্টোবর। হংকং-এর যে এলাকায় অবরোধ চলছিল, সেটা ব্যবসা এলাকা। এখানে কাজ-ধান্দায় আসা লোকেদের অসুবিধা হচ্ছিল এই দখলের জন্য। তবে দখল আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করে, পুলিশের নীরব সম্মতিতে তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে অপরাধীদের গুপ্ত সংগঠন ‘ট্রায়াড’। এই এলাকায় ওই ট্রায়াডেরও কিছু ব্যবসাপাতি চলে, তাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দখল আন্দোলনের জন্য। চীন ঘেঁষা দুটি সংগঠন — ভয়েস অব লাভিং হংকং এবং কেয়ারিং হংকং পাওয়ার অকুপাই আন্দোলনের বিরুদ্ধে মিছিল শুরু করে।
হংকং-এর সরকার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ১০ অক্টোবর কথা বলতে চাইলে অকুপাই আন্দোলন আস্তে আস্তে গুটিয়ে যেতে শুরু করে। কিন্তু ১০ তারিখে সরকার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা বাতিল করে দেয়। ফলে ফের সরকারি নিষেধ অমান্য করে হাজার হাজার আন্দোলনকারী ফিরে আসে, এবারে পাকাপোক্ত তাঁবু হাতে করে। আট লেনে হারকুট রোড বরাবর শতাধিক তাঁবু পড়ে। ১৪ অক্টোবর পুলিশ এবং মুখোশধারী কিছু লোক বলপ্রয়োগ করে তাঁবু তুলে দেয়। বেশ কিছু প্রতিবাদী গ্রেপ্তার হয়। ১৫ তারিখে ফের কেন্দ্রীয় সরকারি অফিস সংলগ্ন একটি রাস্তা দখল করতে গেলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে বলপ্রয়োগ করে অবরোধ হটিয়ে দেয়।
ছাত্রছাত্রী এবং দখল আন্দোলনকারীদের এই আন্দোলন নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে চললেও, এই আন্দোলনের অন্যতম বড়ো একটি দিক হলো অহিংসা — এবং তা ঘোষিতভাবে। হংকং সমাজের মধ্যবিত্তদের এই আন্দোলনের নিজস্ব সংগঠনটিও যথেষ্ট মজবুত। আন্দোলন সংগঠনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ইন্টারনেট এবং মোবাইল মিডিয়া। হংকং-এর মিডিয়াও কমবেশি এই আন্দোলনের পক্ষে। আন্দোলনের পক্ষে মার্কিন ব্রিটিশ দানবিক মিডিয়াগুলোও।
Leave a Reply