বিলাস শতপথি, কোচবিহার, ৩ আগস্ট#
ঘটনাটা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের মে মাসে। বাবার মনে হচ্ছিল মাঝে মাঝে হার্টের একটা করে বিট মিস হচ্ছে। জেনারেল ফিজিসিয়ানকে দেখানোর পর ওনার পরামর্শ মতো মেডিসিন-এ এমডি এক ডাক্তারবাবুকে দেখানো হয়, তিনি ইসিজি এবং ২৪ ঘন্টার হোলটার মনিটর করতে বলেন। সেইসব পরীক্ষা করার পরেও হৃদযন্ত্রের সেরকম কোনো ত্রুটি ধরা পড়েনি, কিছু বয়সজনিত সমস্যা ছিল, যেটা ৭১ বছর বয়সে অস্বাভাবিক নয়। এরপর কিছুদিন সব ঠিকঠাক চলছিল।
হঠাৎ জুন মাসের ২৫ তারিখ সকাল থেকে বাবার মাথা ঘুরতে শুরু করে, তার তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে বাবা একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পরেন। সাথে এটাও ভয় হয় যে যেহেতু হার্ট বিট মিস হচ্ছিল, তাই হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনাও থাকতে পারে। বিকেলের দিকে বাবাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করাই। সেখানে চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপির পর ২ আগস্ট যখন ওখান থেকে বাবাকে বাড়িতে আনি তখন বাবার দু-পায়ের শক্তি চলে গিয়েছে। সেই নার্সিংহোমের ডায়াগনসিস ছিল vertigo-c-spondylosis peripheral neuropathy। ওখানে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, ১৫ দিনের ওষুধ দেওয়া হয়েছে, খেলে ঠিক হয়ে যাবে। ১৫ দিন পর অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকায় ওই নার্সিংহোমে বাবাকে দেখা এক নিউরো ফিজিশিয়ানের কাছে রিপোর্ট ও প্রেসক্রিপশন নিয়ে গেলে তিনি বলেন ওই ওষুধ খেলে শরীর আরও খারাপ হবেই। নতুন ওষুধ ও টেস্ট লিখে দিলেন (২৪/০৭/২০১৫)। ওষুধ খেয়ে কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় বাবাকে কোনোরকমে ওনার চেম্বারে নিয়ে যাই। এবারে তিনি বলেন যে বাবার তীব্র পার্কিনসনের সমস্যা হয়ে গিয়েছে আর অবশ্যই টেস্টটা করিয়ে আনতে হবে।
এবারে সেই ওষুধ খেয়ে বাবার হিক্কা উঠতে শুরু করে (মিনিটে প্রায় ১৫-২০টা) তারপর খাওয়াদাওয়া বন্ধ। আর যে টেস্টটা করতে বলেছিলেন সেটা এখানে, শিলিগুড়িতে এমনকী কলকাতায় খোঁজ করেও পেলাম না যে কোথায় হয়। আবার গেলাম ওনার কাছে। তিনি বললেন যে ওষুধ খেয়ে যদি খারাপ হয় তাহলে ওষুধ বন্ধ আর ওই টেস্টটা হয় ব্যাঙ্গালুরুর নিমহান্সে (NIMHANS), বুঝলাম এখানে আর কিছু হবে না। এরপর গেলাম আর এক জেনারেল ফিজিসিয়ানের কাছে। তিনি বললেন গরম আর ডিহাইড্রেশনের কারণে এরকম হচ্ছে। ঘরে এসি মেশিন লাগাতে হবে। সাথে দুটো করে ইনজেকশন দিলেন, একমাস দিতে হবে।
আমাদের কাছে এসি-র মতো মহার্ঘ্য বিলাসিতা অযৌক্তিক, কিন্তু অসুস্থ মানুষের আত্মীয়দের কাছে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার চেয়ে ডাক্তারবাবুকে অন্ধবিশ্বাস করে রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব সারিয়ে তোলার প্রচেষ্টা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। বাবার শরীর খারাপ হয়েই চলল। ধীরে ধীরে বসে থাকা বন্ধ হল। এরপর শুয়ে থাকা অবস্থায় পাশ ফেরা বন্ধ হল, কোনো মতে বাবাকে তুলে ধরলে সারা শরীর জুড়ে কম্পন। এবারে হাতের নাড়াচাড়া বন্ধ হল। প্রাকৃতিক কাজকর্ম এমনকী স্নান ও বিছানাতেই প্লাস্টিক পেতে নিয়ে করাতে হত। বাবা একসময়ে গ্লাস ধরে জলও খেতে পারতেন না, স্ট্র দিয়ে খেতেন অল্প অল্প করে।
এর মধ্যে একদিন ইনজেকশন কিনে ফেরার পথে কী মনে হতে ডাঃ অনির্বাণ দত্তের চেম্বারে কথা বলার জন্যে ঢুকে গেলাম। অনির্বাণদা স্কুলে আমার ২-৩ ক্লাস সিনিয়ার ছিলেন, এখন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক। উনি আমাকে রিপোর্টগুলো নিয়ে আসতে বললেন। সেই রিপোর্টগুলোর সাহায্যেই প্রথম চিকিৎসা শুরু হল ৭ আগস্ট। ৭ দিন পর ওনার পরামর্শে বাড়িতে পোর্টেবেল এক্স-রে মেশিন নিয়ে এসে কোমরের এক্স-রে করা হলে দেখা যায় L5 আর L6-এর মধ্যে যতটা জায়গা থাকার কথা তার চেয়ে অনেক কম আছে। এরপর চিকিৎসা চলতে থাকে, বাবা ধীরে ধীরে চিকিৎসায় সাড়া দিতে থাকেন। সেপ্টেম্বর মাসে আবার উঠে বসতে পারেন। অক্টোবর মাসে উঠে দাঁড়াতে পারেন, আমাকে ধরে অল্প স্বল্প হাঁটাহাঁটিও করতে শুরু করেন। পুজোর সময়ে বাইরে বারান্দা পর্যন্ত একা একাই হেঁটে যেতে পারছিলেন। বাবা আজকের দিনে সম্পূর্ণ সুস্থ, অনির্বাণদার পরামর্শ মতো ফিজিওথেরাপি চলছে।
ডাঃ অনির্বাণ দত্তের কথা :
প্রথমে যখন তুমি এসেছিলে তখন আমি পেশেন্টকে দেখিনি। রিপোর্ট যা পেয়েছিলাম যে পেশেন্ট হাঁটতে পারছে না সঙ্গে সিভিয়ার ভার্টিগো ছিল। মেইনলি আমাদের তো সিম্পটমের ওপরেই চিকিৎসা করা হয়। এবারে সেক্ষেত্রে প্রথমে আমি যেটা দেখেছি যে যাতে রিলিফ হয় সিম্পটমগুলো । পেশেন্টের বয়সও একটু বেশি, এবারে ডায়াগনসিস তখন যা ছিল, ঘাড়ে একটা ছিল স্পন্ডিলোসিস সঙ্গে কোমরেও, আর এখানে যে নিউরো সার্জেন দেখেছিলেন উনি বলেছিলেন নার্ভের একটা সমস্যা হচ্ছে পেরিফেরিয়াল নিউরোপ্যাথি। এবারে তখন যে সিম্পটম ছিল সে দেখেই চিকিৎসা করা হয়েছিল এবং আগের যে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ চলছিল সেগুলো বন্ধ করতে বলে দিয়েছিলাম। কারণ সেগুলো খেলে আরও অসুবিধা হচ্ছিল — এগুলো তোমার বাবা তখন বলছিলেন।
এবার তারপরে ট্রিটমেন্ট আরম্ভ করার পর আস্তে আস্তে ইমপ্রুভমেন্ট হয় এবং প্রথম থেকে যে চিকিৎসা করা হয় তা প্রধানত ব্যথার জন্যে আর মাথা ঘোরার জন্যে দেওয়া হয়েছিল। তারপর ওটা কিছুটা ইমপ্রুভমেন্ট হওয়ার পর নার্ভের যে সমস্যা ছিল তার জন্যে ওষুধ দেওয়া হয়। তারপর সেই ওষুধটাও বন্ধ করে দেওয়া হয় মাস তিনেক পর, তখন সমস্যা কিছুটা কমের দিকে। তারপর এখন যেগুলো চলছে সিম্পটমেটিক-এ বলতে পারো। বমির টেন্ডেন্সিছিল, তার জন্যে একটা ওষুধ দেওয়া হয়েছে আর কোমরে ব্যথা বলছেন, তার জন্যে একটা ওষুধ দেওয়া হয়েছে। আর যেহেতু পেশেন্ট আগের থেকে অনেক ভালো আছেন, তাই তোমাকে আর বলিনি নতুন করে কোনো ওষুধ চালু করার জন্যে। এর মধ্যে তো দুবার এসেছিলেন আমার কাছে আর হেঁটেই এসেছিলেন চেম্বারে, যেখানে আগে হাঁটতেই পারছিলেন না, সেখানে তো হেঁটেই এসেছেন। আমি তো সেরকম সমস্যা আর দেখছি না। এখন মাঝেসাঝে সিম্পটম পাল্টাবে। আর আমরা ওরকম গাইডলাইন বলতে পারব না, কী দেখে কী দিয়েছিলাম, পেশেন্টের যেরকম সমস্যা থাকে সেভাবেই চিকিৎসা করা হয়। আমাদের সেরকম কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। পেশেন্টযেরকম ফিল করবে সেরকমভাবেই আমাদের চিকিৎসা।
Leave a Reply