গত শীতে কোচবিহার শহরের অদূরে চাষিরা বাসে যেতে যেতে নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল, মরশুমে আমন ধানের দাম না পাওয়া নিয়ে। খরচ বাড়ছে চাষের, অথচ দাম নেই। একজন চাষি বলে উঠেছিল, এবার থেকে চাষিদের নিজেদের খোরাকির জন্যই কেবল চাষ করা উচিত। আর বাজারের জন্য করতে পারি, যদি সরকার টাকা দেয়।
কেবল বাড়ির জন্য ধান চাষের কথা এবার বোরোর মরশুমে আরও ব্যাপকভাবে শোনা গেছে। এক চাষির কাছে শোনা গেল, এবারে যাওবা বিক্রির জন্য করেছি, সামনে বারে শুধু খাওয়ার জন্যই করব। কেউ কেউ জমি চাষ না করে ফেলে রাখার কথাও বলেছে।
চাষ করে বড়োলোক হওয়ার স্বপ্নে ইতি টানছে ছোটো চাষি, সেকথা হয়তো এখনই বলা যাবে না। কিন্তু বাজারের জন্য চাষের যে দাপট গত কয়েক দশক ধরে দেখা গেছে, তা কমছে। সার, জল, ওষুধ, লেবারের বাড়তি চাহিদা এবং অগ্নিমূল্যের কারণে চাষের খরচ, বিশেষত ছোটো চাষির, হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু জমিটা বিক্রি করে দেওয়ার বদলে অন্যান্য আরও অনেক সম্ভাবনার দিক খুলছে তার কাছে।
সরকারও যে চাষিকে বড়োলোক হওয়ার খোয়াব দেখাতে পারছে, তা নয়। বরং প্রতি বছর সারের ভরতুকি কমিয়ে চলেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে চলেছে। যে কোনো ফন্দি ফিকিরে জমি অধিগ্রহণে লাগাম টানেনি। একশো দিনের কাজের মধ্যে দিয়ে কার্যত চাষে লেবারের দাম বেড়েছে। কোনো উপায়েই ফসলের দামের ওপর মিডলম্যানদের নিয়ন্ত্রণ আলগা করা যায়নি। বিভিন্ন চাষজাত পণ্যের আগাম বাণিজ্য চালানোর সুযোগ করে দিয়ে ফসলের দামের ওপর চাষির নাগাল কমিয়ে চলেছে। সম্প্রতি পঞ্জাব-হরিয়ানার ভূগর্ভস্থ জলে তেজস্ক্রিয় মারণ কণা ইউরেনিয়াম পাওয়া গেছে বলে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ স্বীকার করেছেন। সমাজকর্মীদের অভিযোগ, জমিতে অত্যধিক রাসায়নিক সারের ব্যবহারের কারণে ভূগর্ভস্থ জলে এই তেজস্ক্রিয়তার আবির্ভাব। সব মিলিয়ে, বাজারের জন্য চাষ করে চাষির ‘উন্নত’ হওয়ার আশায় সরকারের কোনো মদত নেই।
এরই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর সাম্প্রতিক হতাশাভরা লিখিত উক্তিতে — ‘… আমার দুশ্চিন্তা, উন্মুক্ত অর্থনীতির সুফল আরও বেশি বেশি করে অল্পসংখ্যক লোকের হাতেই যাবে। আমাদের জনগণের একটা বড়ো অংশ অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উপকারের আওতার বাইরে চলে যাবে।’
Leave a Reply