সম্রাট সরকার, মাজদিয়া গ্রাম, মদনপুর, ৫ অক্টোবর#
আমাদের চাষ-আবাদের গ্রাম। নাম মাজদিয়া। শিয়ালদা-রানাঘাট রেলপথে পড়ে মদনপুর স্টেশন। কল্যানী ছাড়িয়ে। রেলস্টেশনের পশ্চিমপাড়ে তিন কিমি হাঁটলেই পড়বে বয়সা বিল। বহুকালের বিল। এই বিলের পূর্বপাড়ে আমাদের গ্রাম মাজদিয়া। ছোটোবেলায় আমরা খেত-ফসল, জমি-জিরেত, বিলের কালো জল, মাটির বাড়ি — এসবের মধ্যেই বড়ো হয়েছি। আমাদের গ্রামের চাষ আবাদের প্রধান কেন্দ্র বয়সা বিল। বর্ষায় জল বাড়লে মাছ-কাঁকড়া গেঁরি-গুগলি, শীতের মাঝামাঝি জল নেমে গেলে সর্ষে, ধান, পাটের চাষ। প্রধানত গঙ্গার উপচানো জল সরাটি, চাঁদামারি এইসব গা-গঞ্জ পেরিয়ে চলে আসে বয়সার বিলে। বিলের ওপরের দিকে জমি আবাদের জন্য একদম উপযুক্ত জায়গা। সেই চাষের মাঠে কিছু পাখি — যা আমি গত তিন বছর ধরে দেখে আসছি, তাদের কথা এখানে জানাবো।
ইয়েলো ওয়াটেলড ল্যাপউইং — বাংলায় প্রায় সব ল্যাপউইংকেই হোটিটি বলে। বয়সা বিলের পূর্বপ্রান্তে বিলের লাগোয়া জমিগুলোতে বর্ষার মাঝামাঝি থেকে শুরু করে শীতের মাঝামাঝি অবধি দেখেছি গত দু-বছর ধরে। তবে খুব নিয়মিত বলব না। মনে হবে স্থানীয়ভাবে মাইগ্রেট করে। সবচেয়ে কম দুটো থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ দশটা পর্যন্ত সংখ্যায়। তবে মজার কথা, সবসময় জোড় সংখ্যায় থাকে। গায়ের রঙ হালকা বাদামী। পেটটি সম্পূর্ণ সাদা। মাথায় একটি সুন্দর কালচে বাদামী টুপি আছে। সর্বোচ্চ দশটির দলটিতে কোনো বাচ্চা দেখিনি। অর্থাৎ কাছাকাছি কোথাও ওদের বাসা আছে, এটা সম্ভব নয়। আমি নিজেও এরকম বাসা চাক্ষুস করিনি। এরা খোলা মাটিতে সামান্য কিছু ঘাস ইত্যাদি জড়ো করে তার মধ্যে ডিম পাড়ে।) পুরুষ পাখিটির মাথাটা একটু বড়ো আর চারকোনা ধরনের। অর্থাৎ ওপরদিকটা একটু থ্যাবড়ানো — তাছাড়া স্ত্রী পাখির সঙ্গে কোনো অমিল নেই। বয়সা বিলের শুকনো চাষের জমি, বিশেষ করে যে জমিগুলো সদ্য চষা হয়েছে অথচ চারা লাগানো হয়নি, সেইসব জমিতে ওদের খুব বেশি বসতে দেখেছি। সাধারণভাবে এরা খুব সতর্ক। মাটির রঙের সাথে ওদের গায়ের রঙ প্রায় মিশে যাওয়ায় হঠাৎ করে খুঁজে বার করা মুশকিল।
এরা মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলে, যেটা এদের দোসর রেড-ওয়াটেলড ল্যাপউইং — তাদের স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। এদের ডাকটাও রেড-ওয়াটেলডদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একটাই শব্দ, টেনেক্ট-ইট। মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে পোকা জাতীয় খাবার খায়। তবে কেঁচো খেতে দেখিনি। ইয়েলো-ওয়াটেলড ল্যাপউইং-এর ব্রিডিং সিজন বা সন্তান জন্মের মরশুম সাধারণভাবে মার্চ থেকে মে মাস। অর্থাৎ বর্ষার আগেই এই পাখিটির ব্রিডিং শেষ হয়ে যায়। শুনেছি খোলা মাটির ওপর কিছু খড়কুটো জড়ো করে তিন থেকে চারটি ডিম পাড়ে। ডিমগুলো এমনই রঙের যে মাটির সঙ্গে একদম মিশে থাকে। তবে ডিম থেকে বাচ্চা হওয়ার হার বেশি নয়। কারণ বাসাটি খোলা মাটিতে হওয়ার কারণে ডিম নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা বেশি। একমাস ধরে ডিমে মা/বাবা তা দেয়। বাচ্চা খুব তাড়াতাড়ি খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে পরিচিত হয়। সারা ভারতবর্ষেই বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া যায়। তবে আমাদের রাজ্যে এখনও অবধি আমার পুরুলিয়ার বড়ন্তি বাঁধের ধারে এবং আমাদের বয়সা বিলের ধারে এদের স্বচক্ষে দেখেছি। দূরে কোথাও পরিযায়ী হয়ে চলে যাওয়ার ঘটনা শুনিনি। তবে বর্ষার সাথে সাথে এরা স্থানীয়ভাবে বাসস্থান পরিবর্তন করতে পারে। যদিও তা গবেষণার বিষয়। অন্যান্য ল্যাপউইং ও প্লোভারদের মতো কখনো গাছের ডালে বসে না। কখনও এরকমও হয়েছে যে কিছুক্ষণ ধরে নজর রাখার পর, হয়ত বিরক্ত হয়ে মাঠের পাশ্ববর্তী নয়নজুলি পেরিয়ে পাশের চাষের মাঠে চলে গেলো কিন্তু ঘন্টা খানেক বাদে আবার ফিরে এসেছে।
Leave a Reply