অমিতাভ সেন, ১০ জুন#
চলা আর থামায় দেখার একটা তফাৎ — চলার দেখাগুলো সহজেই কাছে চলে আসে, থেমে থাকলে দূরে তাকিয়ে দেখতে হয় বেশি।
নার্সিং-হোম থেকে এসে উঠেছি ক্যান্সার হাসপাতালে — ভালো হাসপাতাল। বাড়ি থেকে ট্যাক্সিতে এসেছি। ডানদিকের ফুসফুসের অনেকটা কাটা-ব্যথা আছে। বাসে উঠলে কষ্ট হত। তার চেয়ে বড়ো কথা ট্যাক্সিতে চড়ায় অসুবিধা নেই। ভালো হাসপাতালে ভালো কেবিন — বিরাট ঘর, অ্যাটাচড বাথ, রুগির সঙ্গে রুগির বাড়ির লোক থাকার জন্য আলাদা আলাদা খাট-বিছানা, চেয়ার, দেরাজ, টেবিল, টি.ভি. কী নেই। ফ্যান –এসি দুটোই আছে। আমার অভ্যাস নেই বলে এসি বন্ধ রেখেছি, তাছাড়া আমি শীতকাতুরে। কাঁচের বন্ধ জানলা দিয়ে বাইরের বাগান-গাছ, পুকুর-রাজহাঁস চমৎকার দেখা যাচ্ছে। আমি বেডের ওপর বসে খসখসিয়ে লিখছি। কোথাও বাধছে না। হাজার হাজার টাকার ওষুধ লাগবে। তাও আটকাবে না। আমার বন্ধু আর আত্মীয়দের সংখ্যা অনেক, আমার প্রতি তাদের ভালোবাসাও প্রচুর। তাছাড়া তাদের আর্থিক সঙ্গতিও আছে আমাকে সাহায্য করার।
লিখতে লিখতে মনে পড়ে গেল ক-বছর আগে বিদর্ভে তুলো চাষিদের আত্মহত্যার খবর পড়তে গিয়ে পি.সাইনাথের লেখায় এমন খবর পাওয়া গিয়েছিল — নিঃস্ব চাষিদের চিকিৎসার জন্য জমি বিক্রি করতে গিয়ে এমন অনটনে পড়তে হয়েছিল যে আত্মহত্যার করা ছাড়া তাদের উপায় ছিল না। মন্থন পত্রিকায় তখন এই লেখার অনুবাদ করেছিল মণিদীপা — তাতে এমনও দেখা গেছে যে এখানকার বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অসুস্থ হলে শহরে কোনো বড়ো ডাক্তারখানার যেতে চায় না — সেখানে রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার টাকা জোগাড় করতেই তারা ফতুর হয়ে যায়। তাই গাঁয়ের হাতুড়ে ডাক্তার বা সস্তার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার সাহায্যে তারা যদ্দিন টিকে থাকে। অতদূরে না গিয়ে কাছাকাছিও দেখা যায় — আমাদের শহরতলি থেকে যারা গতরে খাটতে শহরে এসে ঢোকে এমন ঠিকে কাজের লোক বা মিস্ত্রি — যাদের অনেকেই আমাদের চেনা — তাদের নিজেদের আত্মীয়-পরিজনদেরও টাকার এমন অভাব যে তাদের পক্ষে কঠিন অসুখের খরচ সাপেক্ষ চিকিৎসা চালানো সম্ভব হয় না — এসব আমরা নিয়মিত দেখতে পাই। আমাদের দেশে এরকম লোকই তো বেশি। সেই হিসেবে আমার প্রাপ্তি কি বেশি হয়ে যাচ্ছে?
এইরকম একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছে বেশ কিছুদিন। কিন্তু মানুষ বাঁচার চেষ্টা করবে না? নিজের সামর্থকে জানা আর সকলের সাথ দিয়ে খানিকটা বাড়িয়ে নিয়ে এই চেষ্টায় কীসের খেদ? খেদ কিন্তু বেড়ে গেল আজ এখানে খাবার দেবার সময়। ডিমের ঝোলে দুটো ডিম। একটা তুলে নিতে বললাম। সিস্টার বললেন, দুটোই থাকে। বললাম, একটা নষ্ট হবে যে। সিস্টার হেসে বললেন, নিয়ম নেই। নষ্ট করেই খেতে হল একটা, আরেকটা ডিম পড়ে রইল এক প্রাইমারি স্কুলের বালক-বালিকাদের ফাঁকি দেওয়ার দায় নিয়ে। তেহট্টের গ্রামের স্কুলে গিয়ে আমি দেখেছি মিড-ডে মিলের ডাল-আর ঝিঙে আলুর তরকারির অন্যায্য দেড়মাসের দীর্ঘতার পরে একটা দিনের একটা ডিম কেমন হাসিতে মুখ ভরিয়ে দেয় বাচ্চাগুলোর, আমাদের বিভিন্ন বর্গের মানুষদের নিজেদের পর্দা ফাঁক করে ওই দেখাটা জরুরি বলে আমার মনে হয়েছিল।
এখন সে সব দেখার প্রতিক্রিয়া আরও বাজছে। এইমাত্র আয়া-মাসি ‘আপনার ফল’ বলে আপেল দিয়ে গেলেন দরজার ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে — আমি খেতে পারব না বলার আগেই — ওনার সময় নেই — তাছাড়া এখানে তো নষ্ট না করার কোনো নিয়ম নেই। আমি দেখছি, আমার অসুখ শুধু শরীরে নয়, আমার শরীর ছাড়িয়ে অনেক দূর। এখন নিজেকে বাঁচানোর এই চেষ্টায় এভাবে অসুখ সারবে, সারবে না।
Leave a Reply