অমিতাভ সেন, কলকাতা, ৩০ এপ্রিল#
সকাল সাড়ে সাতটায় চা বিস্কুট খেয়েছিলাম। এখন সাড়ে নটা। বেজায় খিদে পেয়ে গেছে। গাঙ্গুলীপুকুর বাসস্টপের উলটো দিকে, যেখানে জনস্বাস্থ্যের জন্য ‘এখানে আবর্জনা ফেলা নিষিদ্ধ লেখা বোর্ডের তলায় সবচেয়ে বেশী আবর্জনা আর চায়ের ভাঁড়ের স্তূপ শহীদনগর কলোনির অধিবাসীদের ঠাট্টা করছে, সেখান থেকে পশ্চিমদিকে একটু এগোলেই কালাদার চায়ের দোকান। দোকানে ঢুকে ঘুগনি আর একটা কোয়ার্টার পাউণ্ড পাঁউরুটির অর্ধেক দিতে বলে টেবিলের সামনে বেঞ্চিতে বসতে বসতে খেয়াল করলাম, দোকানে উপস্থিত সকলেই বেশ বৃদ্ধ। তিনজনের মাথা ভরা পাকা চুল আর টার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাদা জামাকাপড় দেখে মনে হল ‘কাল রজনীতে ঝড় হয়ে গেছে রজনীগন্ধা বনে’. সত্যিই কাল ঝড় হয়েছে। প্রচণ্ড কালবৈশাখী ঝড় সঙ্গে ঘূর্ণি যা আগে একসঙ্গে কখনো হয়নি। খবরের কাগজের হিসেবে প্রায় আয়লার ঝড়ের গতিতে। গাছ উপড়ে পড়েছে, রাস্তা বন্ধ হয়েছে, গাড়ি আটকে যাওয়ায় লোকজন বাড়ি ফিরতে নাজেহাল হয়েছে, বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বহু জায়গা অন্ধকারে ডুবে গেছে আর তার উপর বৃষ্টির জল। সেই জল এখন জমে আছে কালাদার দোকানের সামনে। সেখানে ফেলা কয়েকটা ইটের টুকরোয় পা দিয়ে দিয়ে এখানে এসে উঠেছি।
সেই তিন বুড়ো আমার সামনে ও পাশে হাতে চায়ের গ্লাস ও সিগারেট নিয়ে গপ্পে মেতেছে। সকলেই বাঙ্গাল ভাষায় কথা বলছে। আমার আরেক পাশেই গেরুয়া পাঞ্জাবী পরা আরেকজনও বয়স্ক, মাথার পাকা চুলের কলপ উঠে লাল কালো সাদা তিন রঙ্গা ঝাঁপানো চুল নাড়িয়ে তিনিও চা খেতে খেতে বৃদ্ধদের সঙ্গে কথা বলছেন। আমার মুখোমুখি বসা প্রথম বৃদ্ধই বক্তা — এঁর চেহারা খুব চোখা, কপালের কাটা দাগ কোন অঘটনের সাক্ষী। তিনি বলছেন গেরুয়া পাঞ্জাবীকে, ‘ ওই দিকে একটা খাল আসিল না, ওর পাশে একটা ডোবা ছিল, তোরা দ্যাখস নাই, ওই ডোবার পাশে সবুজ একটা মাঠ ছিল, ছোট দ্বীপের মত , ওখানে আমরা আড্ডা বসাতাম। একখান ছবিও আসে আমাদের উনিশশো একান্ন-বাহান্ন সালে তোলা। সাদা কালোয় ফটো, এখনো কী সুন্দর আসে’. দ্বিতীয় বৃদ্ধ পকেটের থেকে পয়সা বার করতে করতে কালাদাকে জিজ্ঞেস করে ‘ সিগারেটের দাম কত রে?’ – ‘৬টাকা’ – ‘ওরেব্বাবা, এত দাম!’ তৃতীয় বৃদ্ধ একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলে ‘তুই সিগারেট খাওয়া ছাড়ান দে’. প্রথম জনের গলা শোনা যায় ‘এই যে শহীদনগর খেলার মাঠ। ওখানে ধীরেনবাবু দুটো প্লট কইর্যা বেচ্যা দিতে ছিল। মাঠে খুঁটি পোঁতা। আমি আর ঐ বাবলুর দাদা আসিল না, আরও দুইজন সোজা গিয়া খুঁটি তুইল্যা ফ্যালাইয়া দিসি। কেউ টুঁ শব্দটি করে নাই’. গেরুয়া পাঞ্জাবী বলে ‘আপনেরা সইলেন বইল্যাই তো অহনও মাঠখান আসে’. প্রথম বৃদ্ধ বলেন, ‘সে তো আর কেউ জানে না, ওই আমরা চারজনই জানতাম। সেও ৫৩-৫৪ সালের কথা, তহনকার একখান ফটোও আসে। শহীদনগরের ৫০ বছর পূর্তির সময় ডিসপ্লে করেসিল। তার মধ্যে আমার ছবিও আসে।’
ঘুগনি পাঁউরুটি খেতে খেতে আমার তো চক্ষু চড়কগাছ – এরা সব জ্যান্ত ইতিহাস – যেসব সালের কথা বলছে সব আমার জন্মেরও আগে। আমারও তো বয়স কম হল না। দাড়ি সব পেকে গেছে, মাথা জোড়া টাক, আমাকে অবশ্য এই বৃদ্ধেরা পাত্তা দিচ্ছে না – সেদিনের ছোকরা ভাবছে বোধহয়। আমি শুনছিলাম, কোন কাউন্সিলর বাবু কে শিখণ্ডী খাড়া করে এই উদ্বাস্তু কলোনির জমি প্লটকে প্লট বেচে দেওয়া হল। সে বাবু ‘ গুডম্যান হইলে কই হইব, ওসব গুডম্যান কোন কামের নয়, পার্টির পক্ষে ভালো’. দ্বিতীয় বৃদ্ধ উঠিউঠি করছিলেন। প্রথমজন বললেন, ‘প্রবীর তুই জল মরলে বাইর অ’. দোকানের সামনে জমা জলের দিকে তাকিয়ে স্বভাবে গম্ভীর কালাদাও হেসে ফেলল, ‘ও তো মরতে মরতে বিকাল হইয়া যাইব’. দ্বিতীয় বৃদ্ধ তৃতীয় জনকে হাত ধরে জলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেলেন। দুজনেরই হাতে বাজারের থলে। একজনের প্লাস্টিকের থলে থেকে কুমড়ো আর ঝিঙে উঁকি মারছে । তৃতীয়জনের হাঁটার বেশ ঝামেলা আছে। প্রথম বৃদ্ধ বললেন, ‘হেই তোরা হাত দ্যাখাইয়া গাড়ি থামাইয়া রাস্তা পার হ’. তারপর কালাদাকে বললেন ‘অর পায়ে অপারেশান হইসে। ‘ বলতে বলতে তিনিও উঠে গেলেন। আর ওঠা মাত্র গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা বয়স্ক মানুষটি লাফ মেরে উঠলেন ‘অফ এতক্ষণে সিগারেট ধরানো গেল। আমি হেসে বললাম ‘আপনার থেকে কত বড় ওরা?’ বললেন ‘অনেকটা’. আমি বললাম ‘বয়স কত হবে এঁদের? ৭৫-৮০’? হুঁ বলে সিগারেটে তিনি কষে টান দিতেই প্রথম বৃদ্ধ আবার এসে হাজির ‘দ্যাখ কেমন ভুল হইসে’. বলে দোকানের মেঝে থেকে মাছের থলেটা তুলে নিলেন। আড়চোখে দেখই গেরুয়া পাঞ্জাবি হাত ঘুরিয়ে চট করে সিগারেট লুকিয়ে ফেলেছেন। প্রথম বৃদ্ধের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে পরে গেল তিনি বলছিলেন ‘আরে কাল রাতে যা ঝামেলা হইসে। ঝড়ে কারেন্ট চইল্যা গেল। বউ তো কিছু করতে পারে না শুইয়া আসে। আমি তিনখান মোমবাতি জ্বালাইয়া কোনরকমে খাওয়া সারসি, ওখানেই হাত ধুইয়া সব ফেলাইয়া রাইখ্যা মশারিতে গিয়া ঢুকসি। তাও ভাল, কাল গরমটা কম আসিল।’ ক্যা জানে ওনার বউ হয়ত অসুস্থ। ঘরে গিয়ে উনি হয়তো মাছ কাটতে বসবেন। একটা বড় শ্বাস নিয়ে কালাদাকে পয়সা মিটিয়ে উঠে পড়লাম।
Leave a Reply