আজ বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে কয়েক পা এগোতে দেখি একজন ফলওয়ালা ভ্যানে করে ফলের ঝুড়ি নিয়ে চলেছেন, পেছনে পেছনে একজন ভদ্রলোক প্রায় তাড়া করে তাঁকে দাঁড় করালেন। পেয়ারা, জামরুল, তালশাঁস, ফলসা আর কিছু মনমরা লিচু। আমিও ফল কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এমন সময় নজরে এল সামনেই রাস্তার ধারে একটি অল্পবয়সি ছেলে কাকে যেন খুব ধমকাচ্ছে। ভালো করে ঠাহর করে দেখি একটি অল্পবয়সি বউ, খালি পায়ে লাল ছাপা শাড়ি পরে ফুটপাথে বসে আছে, নিথর মুখে। কথাবার্তা কিছুক্ষণ খেয়াল করে বুঝলাম ওরা স্বামী-স্ত্রী। দুজনেরই বয়স কুড়ির কোঠায়। ছেলেটি বলছে,
— ঘরে চল বলছি। রাস্তার মধ্যে নৌটঙ্কি করা হচ্ছে? খুব খারাপ হয়ে যাবে বলছি। আশেপাশে লোকজন সব দেখছে।
সত্যিই, চারদিকে কিছু লোকজন দূর থেকে ব্যাপারটা দেখছে। আমিও প্রথমে একটু ইতস্তত করছি, ভাবছি — এগিয়ে যাওয়াটা উচিত হবে কি-না। তারপর মনে হল, মেয়েটার হাব ভাব দেখে, কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কেবল দর্শক হয়ে থাকব? সমস্যাটা ওদের ঘরোয়া হলেও একবার যখন রাস্তায় এসে পড়েছে, হয়তো রাস্তার লোকেদের সাহায্য করা উচিত।
একটু এগিয়ে গিয়ে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম,
— কী হয়েছে বাবা? ওকে এত ধমকাচ্ছ কেন? কী করেছে ও?
— আর বলবেন না মাসিমা। ঘরে একটু কিছু হলেই ও এরকম বেরিয়ে পড়বে রাস্তায়। বলছে ঘরে আর ফিরবে না। ওকে কত ভালোভাবে বোঝাই। কিছুই বোঝে না। খুব রাগ।
বউটি তখন বলছে, তোমরা ঘরে যাও না চলে। আমি কী করব সে তোমায় দেখতে হবে না। আমি আর তোমাদের ঘরে যাচ্ছি না। জিজ্ঞেস করলাম, ঘরে আর কে আছে? ছেলেটি বলল,
— ওই তো আমার মা দাঁড়িয়ে আছে। সারাদিন খেটেখুটে ঘরে আসি। এসে তো এই কাণ্ড। মা একটু কিছু বললে ও রেগেমেগে চেঁচাবে। কিছু বুঝতে চায় না। আগেও দু-একবার বেরিয়ে পড়েছে। তারপর একবার মরতে গিয়েছিল।
জানতে চাইলাম,
— তুমি কি ওকে মেরেছ?
— কিছুতেই যখন বুঝছে না, একটা চড় মেরেছি। অমনি উনি বেরিয়ে পড়লেন।
বউটির কাছে গিয়ে মাথায় একটু হাত রাখি। ওর বরকে বলি,
— তুমি কিন্তু একদম মারবে না। বোঝাতে না পারলেই এত রাগ হল যে ওর গায়ে হাত দিলে? ও তো তেমনি রাগ করে বেরিয়ে পড়ল। রাগের বশে ঝোঁকের মাথায় কিছু করা ভালো না। তোমাদের কি ভালোবাসার বিয়ে? কতদিন বিয়ে করেছো?
— হ্যাঁ, আমরা নিজেরা বিয়ে করেছি। একবছর হল।
— একবছরেই ভালোবাসা শেষ? এখন আর কেউ কাউকে ভালোবেসে কিছু বোঝাতে পারছ না? এই রকম মারধোর-রাগারাগি! এক কাজ করো। ওকে ওর মা-বাবার কাছে দিয়ে এসো।
মেয়েটি ততক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। শাশুড়ি একটু দূর থেকে বেশ রাগী রাগী মুখ করে সব দেখছেন। মেয়েটি বলল,
— আমি মা-বাবার কাছে যাব না। ওই ঘরেও ফিরব না।
— তাহলে কোথায় যাবে? কী করবে?
— যা খুশি করি। তাতে কার কী?
— না গো মেয়ে। এটা তুমি ঠিক করছ না। যদি এই সংসারে বনিবনা না হয় তবে মা-বাবার কাছে যাও, ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে কিছু করো, নিজে কিছু কাজ করো। জীবনটা নষ্ট করবে কেন?
ইতিমধ্যে ক্রমশ আরও বেশ কিছু পুরুষ ও মহিলা এগিয়ে এসেছেন। একজন অবাঙালি বৃদ্ধ এসে ছেলেটিকে বললেন,
— আওরত কো উপর কভী হাথ না উঠানা। ও বহুত খারাব কাম হ্যায়। উসকো ঘর লে যাও, পেয়ারসে সমঝাও। ও বহুত পেয়ারি লড়কি হ্যায়।
‘পেয়ারি লড়কি’ তখন আশপাশের কারো কথাই কানে নিচ্ছে না, পারলে ছুটে চলে যায় ওখান থেকে। আমি মরীয়া হয়ে বলি,
— তবে কি তুমি থানায় যাবে?
— হ্যাঁ, তাই যাব।
— থানা-পুলিশ কি খুব ভালো জায়গা? আর রাস্তাতেই বা কোথায় থাকবে? জানো তো কত বিপদ?
কথায় কথায় জানা গেল মেয়েটির বাপের বাড়ি সিঙ্গুর, মানে হুগলি জেলায়। ওর বাবা-মা, এক দাদা, আর দুটো বোন আছে। নিজের পছন্দে, বাড়ির অমতে বিয়ে। তাই বাপের বাড়িতে ও ফিরতে চায় না।
কিছু মহিলা তখন মেয়েটিকে বোঝাচ্ছেন, তুমি এখন ক-দিন বাপের বাড়ি ঘুরে এসো। তুমি যাও, ওর বাড়িতে খবর দাও। ছেলেটি মোবাইল বাড়িতে ফেলে রেখে এসেছে। তখন মেয়েটিকে বলা হল ঘরে গিয়ে চটি পরে গোছগাছ করে মা-বাবার কাছে যাও, বরের সঙ্গে।
ওদিকে ততক্ষণে শাশুড়ি-মা মুখ খুলেছেন,
— ও কি ঘরসংসার করার মেয়ে? যা মুখ, যা চাল-চলন। বাড়ির উঠোনে আশেপাশে কত মানুষজন, এই বউ মাথায় গায়ে কাপড় রাখবে না, বড়োদের সম্মান করতে জানে না। নিজের মাকে পর্যন্ত যা-তা বলে, বাড়িতে একটু বসতে পর্যন্ত দেয়নি। ঘরের খাবার-দাবার ফেলে দেয়।
এক ভদ্রলোক বললেন, সে হয়তো খাবার পচে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই ফেলে দিয়েছে। অত দোষ ধরতে নেই। নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসে বোঝান, মানিয়ে নিন।
শাশুড়ি-মা বললেন, আমিই কি সারাদিন ঘরে থাকি? পাঁচবাড়ি খেটেখুটে কাজ করে ঘরে ফিরি, এসে যদি ঘরের বউয়ের এমন চাল-চলন দেখি, মাথার ঠিক থাকে? কিছু তো বলিই না, যদি ছেলেকে বলি, ও চেঁচিয়ে পাড়ামাত করবে, ‘ছেলের কান ভাঙাচ্ছো?’
মেয়েটি বলছে, কারো কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার, আমি খুব খারাপ, তাই আমাকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছে। ভালো তো, তোমরা ঘরে থাকো।
যাই হোক, ছেলেটি দেখলাম একটু নরম হয়ে বউকে হাত ধরে ঘরের দিকে নিয়ে গেল। একটু দূরে শিবনগরে ওরা থাকে। এদিকে শাশুড়ি তখন ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায় বসে পড়েছেন। ‘সবাই তো আমাকেই দুষছেন, তাহলে, মুখ খুলি? জানেন আমি নিজে গিয়ে কালীঘাটে ওদের বিয়ে দিয়েছি। ওর বাবা-মাও ছিল, একটা শাঁখা-পলা পর্যন্ত দেয়নি। সব আমরা খরচ করে বিয়ে দিলাম। বাড়িতে এসে বউ বলল, ‘মামনি রান্নাবান্না আমিই করব’। তাই হল, সংসার পুরো ওকে ছেড়ে দিলাম, চাবি দিয়ে দিলাম। এখন আমিও কাজে যাই, সারাদিন বাইরে বাইরে থাকি। ছেলেও সারাদিন খেটেখুটে ঘরে ফেরে। একটু তো যত্ন-আত্তি করবে? তা-না। উনি মাথায় কাপড় দেবেন না, জোরে জোরে কথা বলবেন। এসব কি ভালো দেখায়?’
ছেলেটি এর আগে আমাকে বলেছে, আমার আর ভাই-বোন নেই। মা আর বউয়ের ঝামেলা মেটাতে যদি মাকে আলাদা কোথাও রাখি, কোনো বিপদ-আপদ হলে, অসুখ-বিসুখ করলে মাকে কে দেখবে? সেই তো আমাকেই ছোটাছুটি করতে হবে। আর মা-ই বা কতদিন বাঁচবে? বউকে কত বোঝাই, তোমার সংসার তো তোমাকে দেখতে হবে। আমার মায়েরও দোষ আছে। অন্যের কথা শুনে বউয়ের দোষ ধরবে। মাঝখানে পড়ে আমার আর মাথার ঠিক থাকে?
সমবেত মহিলাদের মধ্যে থেকে ততক্ষণে নানারকম মন্তব্য — ‘ও, বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে কিছু দেয়নি, তাই রাগ?’ আমিও একজন মেয়ের মা। এইজন্যই আমি আমার মেয়েকে যত পারি জিনিসপত্র দিই, যাতে শ্বশুরবাড়িতে ওর সম্মানটা থাকে’। আর একজন, ‘নিজের মেয়ে হলে কী করতে? ভালোবেসে বুঝিয়ে শুনিয়ে মানিয়ে নিয়ে থাকো না!’ ‘তুমি তো তোমার ছেলেটাকে ভালোবাসো? এত ঝামেলায় পড়ে ও যদি কিছু করে বসে তখন তোমরা কী করবে?’ এক ভদ্রলোক বললেন, ‘মেয়ের বাবা-মায়ের যদি দেবার মতো অবস্থা না থাকে, কিংবা এই বিয়ে তাদের অমতে হয়েছে বলে কিছু জিনিস না দেয়, তবে মেয়েটার কী দোষ? ও তো কত বড়ো ত্যাগ করেছে। নিজের পুরো পরিবার ছেড়ে এসেছে এই সংসারে। এখানে যদি সবাই খালি ওর দোষ ধরে, ভালো না বাসে কেমন করে থাকবে?’
শাশুড়ির সংযোজন, ‘জানেন এই মেয়ের আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল, ৬ মাসও টেকেনি। আপনারা সবাই আমার দোষ দেখছেন তো? আমিও বাড়ি যাব না। এখানেই বসে থাকব।’
ইতিমধ্যে ছেলে ফিরে এসেছে মাকে নিয়ে যেতে। মায়ের কথাবার্তা শুনে রাগে-অসহায়ভাবে যা-তা বলতে থাকে মাকে — আমি মরে গেলে তুমি খুশি হবে তো?
আমরা সবাই মিলে মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেলের সাথে রওনা করে দিলাম ঘর পানে। ওদের পরিচিত এক অল্পবয়সি মহিলা মাকে নিয়ে এগিয়ে চলল। ছেলেটি আমার দিকে করুণভাবে তাকিয়ে বলল, জানেন তো আমি গাড়ি চালাই, নিউ আলিপুরে, ট্রাক চালাতে হয়। এইরকম মনের অবস্থা নিয়ে কী করে কাজ করি?
ওকে সান্তনা দেব কি, আমিই খুব চিন্তায় পড়ে গেছি। তবু বললাম, দেখো, মা আর বউয়ের ঝামেলায় নিজে যথাসম্ভব কম জড়াবে, নালিশ শুনলে সঙ্গে সঙ্গে রেগে গিয়ে কাউকে কিছু বলতে যেও না। বলবে, নিজেদের মধ্যে মিটিয়ে নিতে। কেউ যেন তোমাকে তার পক্ষের বা বিপক্ষের লোক না মনে করতে পারে। আর আশপাশে এমন মানুষজনকে খোঁজো, যারা এসে একটু সু-পরামর্শ দিতে পারে বা নিদেন পক্ষে ঝামেলাটা থামিয়ে দিতে পারে।
ছেলেটিকে দেখে তো মনে হল একটু জোর পেয়েছে লড়বার। বিদায় নিয়ে ফেরার পথে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। এমন তো কত কীই রোজ ঘটছে। একটা হেস্তনেস্ত দুর্ঘটনা ঘটে গেলে দৈনিক কাগজে বা টিভিতে খবর হয়ে যেত, ‘শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে গৃহবধু আত্মঘাতী’ কিংবা ‘মা-বউয়ের অশান্তিতে এক যুবকের আত্মহত্যা’ ইত্যাদি। ঘটনা ঘটার আগে যদি সেটা বন্ধ করা যায়, তবে কি সেটাও খবর হতে পারে?
অমিতা নন্দী, ১৫ মে
Leave a Reply