জনআন্দোলনের কথা ‘এই ধরনের ফ্যাসিস্ট উন্নয়ন আমাদের দেশকে নয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজ এবং নয়া উপনিবেশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ঈশ্বর ভারতকে বাঁচান।’ ‘সারা পৃথিবী আমাদের এই অহিংস প্রতিবাদের সাক্ষী। এটা চলবে।’ |
সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, কলকাতা, ২৮ মার্চ#
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তথা মন্ত্রীসভা গত বছর ঘোষণা করেছিল, কুডানকুলাম সংলগ্ন গ্রামগুলির মানুষের ‘ভয় দূর না করে’ পরমাণু চুল্লি চালু করবে না তারা। কিন্তু সে সবের তোয়াক্কা না করে ১৯ মার্চ মন্ত্রীসভা কুডানকুলাম চুল্লির কাজ চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এর কয়েকদিন আগে থেকেই কুডানকুলামের পরমাণু বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাতে শুরু করেছিল সরকার। তিরুনেলভেলি জেলাশাসক আন্দোলনের নেতা উদয়কুমার, পুষ্পরায়ন, জেসুরাজ, শিবসুব্রমানিয়াম, এবং ফাদার জয়কুমার-কে ডাকাডাকি শুরু করে, কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য।
১৯ মার্চ কুদানকুলাম থেকে শিবসুব্রমানিয়াম সহ ৯ জন পরমাণু বিরোধী কর্মী এবং প্রায় ২০০ গ্রামবাসীকে গ্রেপ্তার করা হয় কুডানকুলামের চুল্লির আশেপাশের জায়গাগুলি থেকে। কিন্তু চুল্লির একটু দূরের গ্রাম ইদিন্থাকারাই, যা আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে বাকি নেতৃত্ব থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। গ্রেপ্তার হওয়া পরমাণু বিরোধী কর্মীদের ওপর ধারা ১২১, ১২১এ, এবং ১৫৩এ দেওয়া হয়, যেগুলি দেশদ্রোহিতার অভিযোগ।
কুডানকুলাম পরমাণু চুল্লির আশেপাশের এলাকা, ইদিন্থাকারাই
আন্দোলনের সমর্থনে ও সরকারি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ২৩ মার্চ ভগৎ সিং-এর
জন্মদিনে (যা রাষ্ট্রীয়ভাবেও শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়) দিল্লি,
কলকাতা, পুনে, হায়দরাবাদ, ব্যাঙ্গালোর সহ সারা দেশে ২২টি শহরে
অনশন অবস্থান হয়। এতে জন আন্দোলনের কর্মীরা অংশ নেয়।
দিল্লিতে সমাজকর্মী সন্দীপ পাণ্ডে অনির্দিষ্টকালীন অনশনে বসেন।
কলকাতাতে বারো ঘন্টা অনশন অবস্থান হয় ২৩ মার্চ (ডানে নিচে)।
গ্রাম সহ গোটা তালুকে ১৪৪ ধারা জারি করে তামিলনাড়ু সরকার। তিনজন ডিআইজি, দশজন এসপি কে নিয়ে তামিলনাড়ু পুলিশের যৌথ অধিকর্তা (এডিজিপি) নিজে কয়েক হাজার পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী নিয়ে এসে কুডানকুলামের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলি ঘিরে ফেলে। দিল্লির পরমাণু বিরোধী কর্মীরা সাংবাদিক সম্মেলন করে বলে, কুডানকুলামকে ‘পরমাণু নন্দীগ্রাম’ বানাতে চাইছে সরকার।
এদিকে ইদিন্থাকারাইতে পাঁচ হাজার গ্রামবাসী পরিবৃত হয়ে ২০ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালীন অনশনে বসে এস পি উদয়কুমার সহ ১৫ জন পরমাণু বিরোধী কর্মী (৮ জন পুরুষ, ৭ জন মহিলা)। তাদের নির্দিষ্ট দাবি ছিল, ১) গ্রেপ্তার হওয়া কর্মীদের এক্ষুণি মুক্তি ২) তামিলনাড়ু মন্ত্রীসভার সবুজ সংকেত প্রত্যাহার ৩) ভূতত্ত্ববিদ, জলবিশারদ, এবং সমুদ্রবিজ্ঞানীদের দিয়ে কুডানকুলাম চুল্লির নিরাপত্তার নিবিড় পরীক্ষা ৪) ভারত রাশিয়া সরকারের মধ্যে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাক্ষর হওয়া গোপন পরমাণু দায়বদ্ধতা চুক্তি প্রকাশ করা, এবং ৫) প্রকল্পের ৩০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে থাকা মানুষকে নিয়ে ‘নিরাপত্তা ও সরে যাওয়ার মহড়া’ আয়োজন করা। উল্লেখ্য, নিরাপত্তা মহড়া ছাড়া পরমাণু চুল্লিতে জ্বালানি সংযোগ বেআইনি, দেশি ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী। গত ২০১১ সালের আগস্ট মাসে এই নিরাপত্তা মহড়া আয়োজন করতে গিয়েই আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল কুডানকুলাম পরমাণু কর্তৃপক্ষ।
ওই ব্যাপক পুলিশি ব্যবস্থার মধ্যে, কয়েকমাস পর এই প্রথমবারের জন্য কুডানকুলামের চুল্লিতে কয়েকশ’ অস্থায়ী কর্মী এবং ইঞ্জিনিয়ার ঢোকে কাজকর্ম চালানোর জন্য। ২১ মার্চ থেকে সরকার আশেপাশের গ্রামগুলিকে অবরুদ্ধ করতে শুরু করে। প্রথমে বন্ধ করে দেওয়া হয় পানীয় জল সরবরাহ। শিশুদের জন্য দুধের সরবরাহ বন্ধ করা হয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোনো সাংবাদিককে ঢুকতে দেওয়া হয় না। শেষে বন্ধ করা হয় যানবাহন, বাস চলাচল।
২১ মার্চ তিরুনেলভেলি জেলা পুলিশ সুপার উদয়কুমারকে ফোন করে আত্মসমর্পন করতে বলেন। উদয়কুমার পালটা বলেন, ইদিন্থাকারাই এসে হাজার পনেরো লোককে একসাথে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে। পরদিন নাগেরকয়েল শহরে উদয়কুমারের স্ত্রীর পরিচালিত একটি মাধ্যমিক স্কুলে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় কিছু দুষ্কৃতি। স্কুল বাস, চেয়ার থেকে শুরু করে বারোটি কাঁচের বইয়ের আলমারি ভাঙচুর করা হয়।
২২ মার্চ চেন্নাই হাইকোর্ট আদেশ দেয়, কুডামকুলামে গ্রামবাসীদের দুধ, জল, বিদ্যুৎ প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ অবিলম্বে চালু করুক সরকার।
২৭ মার্চ জেলাশাসক এবং পরমাণু বিরোধী আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকে জেলাশাসক রাধারামপুর তালুকের কিছু অঞ্চল থেকে মানুষের জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সম্মত হয়। তারপর আন্দোলনকারীরা অনির্দিষ্টকালীন অনশন ভঙ্গ করে এবং গ্রেপ্তার হওয়া সঙ্গীসাথীদের মুক্তির দাবিতে রিলে অনশন শুরু করে। উদয়কুমার বলেন, ‘সারা পৃথিবী আমাদের এই অহিংস প্রতিবাদের সাক্ষী। এটা চলবে।’
Leave a Reply