বঙ্কিম, ৩০ ডিসেম্বর#
আমাদের চাচু, ভাতশালা গ্রামের ইলাহী মারা গেলেন, ১২ ডিসেম্বর ২০১২ বুধবার ভোরবেলায়। একটা গাড়ির ধাক্কায়। চাচু রোজকার চা পানের পর অতি ধীর পায়ে এবরো খেবরো রাস্তার ধার দিয়ে তাঁর কুঁড়ের দিকে ফিরছিলেন। লরিটি ব্যাক গিয়ারে চালিয়ে বড়ো রাস্তায় ওঠার মুখে চাচুকে ধাক্কা দেওয়াতে তিনি রাস্তার ধারে পড়ে যান। চোয়াল ভেঙে রক্ত ঝরতে শুরু করে, লরির লোকেরা তাঁকে একটা চাদর ঢাকা দিয়ে পড়ি কি মরি পালিয়ে যায়। লরিটি সকালে সকালে গ্রামের রাস্তা মেরামতের কাজের জন্য ফেলে গেল ইঁট, আর নিয়ে গেল চাচুর মতো এক সত্তর ঊর্দ্ধ বৃদ্ধের প্রাণ। গ্রামের সবাই ছুটে এল, ধরাধরি করে চাচুকে তুলে আনল আয়ুবের দাওয়ায় — হাসপাতালে নেওয়া হল না — অভিযোগ জানালো হল না। লরির খোঁজ পাওয়া গেল, কনট্রাকটরের সাথে মিটিং হল, মিটমাট হল হাজার পঞ্চাশ টাকায় — সে টাকা অবশ্য আজও পাওয়া যায়নি।
চাচু এই গ্রামেরই চাচু। তাঁর পরিবারে কেউ নেই — পরিবারও নেই, এই গ্রামেরই — এলাকারই একজন। ২০ বছর বয়সের জোয়ান ইলাহী বক্স বিহার মুলুক ছেড়ে বাংলায় চলে আসেন। পারিবারিক ঝামেলা ঝঞ্ঝাট গণ্ডগোলের জেরে বউ ছেলে শ্বশুর বাড়িতে পড়ে থাকে। তিনি বাংলায় এসে বসবাস শুরু করে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ভাতশালা গ্রামের দক্ষিণপাড়ায়। প্রথমে, ওহাবদের জায়গাতে কিছু বছর; তারপর রাবেয়ার পুকুর ধারের এই কুঁড়েতে। রাস্তার ধারের সেই কুঁড়ে ঘরের পুব ও পশ্চিম দিকে মাটির দেওয়াল; উত্তর দিকে হাতখানিক মাটির দেওয়ালের ওপর মশারির নেট টাঙানো। দক্ষিণে একটা দরজা, এক টুকরো দেওয়াল। সাড়ে ছয় ফুট লম্বা চাচু সেখানে মাথা নিচু করে ঢুকে শুয়ে পড়ে থাকতেন। কুঁড়েঘরের একধারে রাস্তার অপর দিকে পুকুরের পাড়ে বিস্তৃত ধানখেত। সকলের সাথেই চাচুর খুব ভাব ছিল। ছেলেছোকরার দল তাঁর কুঁড়ের ধারে আড্ডা জমাত সকাল-সন্ধ্যা যখন তখন।
চাচু যৌবনে লেপ সেলাইয়ের কাজ করতেন। তাঁর হাতের সেলাই দেখবার মতো। এলাকার ঘরে ঘরে তাঁর হাতের তৈরি লেপ রয়েছে। আয়ুবরাই শেষ দিকে তাঁর দেখভাল করত, খেতে দিত। এলাকার কিছু দরদি মানুষও তাঁকে মাঝে মধ্যে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করত। বৃদ্ধ অসমর্থ হয়ে গেলে একটি চোখে দেখতে না পাওয়ায় চাচু মাঝে মধ্যে ভিক্ষা করতেন। আবার সেই পয়সা থেকে গায়ের কচিকাঁচাদের এটা ওটা কিনে খেতে দিত। যৌবনে যখন প্রচুর খাটতে পারতেন, তখন রোজগার করতেন ভালোই। সে সময় নিজে যেমন খেতেন, আর গ্রামের ছেলেপিলেদের নিজে হাতে তৈরি করে খাওয়াতেন। দীর্ঘ ৫০ বছর এ গ্রামে থাকতে থাকতে গ্রামেরই একজন হয়ে — ‘একাই’ ছিলেন চাচু। পরবাসে তাঁর জন্য সযত্নে এক কবর খোঁড়া হল, প্রায় শ-চারেক মানুষ কবরস্থানে জমায়েত হয়ে ইলাহী বক্সকে শেষ শ্রদ্ধা জানাল।
আজও গ্রামে ঢোকার মুখে রাস্তার ধারে চাচুর কুঁড়েঘরটা সুন্দর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে …।
Leave a Reply