১৪ এপ্রিল, আব্দুল আহাদ মোল্লা, রাজাবাগান, মেটিয়াবুরুজ#
বর্ধমান জেলার গলসি থানার অন্তর্গত গোহগ্রামে কাঠফাটা রোদ অগ্রাহ্য করে হয়ে গেল বসন্তমেলা উৎসব। স্থানীয় আদিবাসী সমাজের মুখের কথায় আমাদের এখানকার শিবের গাজন। প্রতি বছর চৈত্র মাসের শেষে ২৩ ও ২৪ তারিখ দামোদরের চরে এই গাজনের মেলা বসে। মেলার মূল উদ্যোক্তা গোহগ্রামের সব হিন্দু ও আদিবাসী সৃজনশীল মানুষ। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আমাদের চোখে পড়ে। এরাই তো সেই কবে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে দামোদর নদের চরে বসবাস শুরু করেছিল। এই গাজনের মেলা তাদের ভালোবাসার প্রাণকেন্দ্র।
এখানকার মেলার দুটো দিন খুব আকর্ষণীয় সন্দেহ নাই — রাতগাজন ও দিনগাজন। তার আগে থাকতেই চরের ফুটবল ময়দানে মেলার আয়োজন হয়ে যায়। মেলার চারপাশের ছবিটা তুলে ধরা প্রয়োজন। ফুটবল মাঠের দক্ষিণ ধারে দু-এক টুকরো চাষের উপযোগী জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছে বাঙালরা। পশ্চিমদিকে অনেক পুরোনো বট-অশ্বত্থ গাছ ছাড়াও বাঁশঝাড় আছে দু-এক জায়গায়। উত্তর ধারে আছে মন্দিরের মতো চার দেওয়ালের দালানবাড়ি। তবে এটাই ঠাকুরঘর। কিছুটা জায়গা ছেড়ে তারই সামনে টিনের ছাউনি দেওয়া পাকা আটচালা। এটা বৈঠকখানা। পুবদিকটা ফাঁকা পড়ে আছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য। আর এই ফুটবল মাঠের গা ঘেঁষে সোনালি-রূপোলি বালি ভরা দামোদর নদ।
রাতগাজনের দিন যে কোনো নতুন অতিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে বলবে, আহা কী দেখিলাম, জন্ম-জন্মান্তরে ভুলিব না! রাতগাজনের দিন যারা রামনবমী উপলক্ষ্যে মানসিক বা মানত করে, তারা সারাদিন উপোস করে থাকে। বিকেলবেলা থেকেই ঢাকঢোল বাজতে থাকে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলে তার বেগ আরও বেড়ে যায়। অবশ্য এই বাদ্যি বাজানো হয় দামোদর নদের বাঁধ ছেড়ে অন্য এক পুরোনো মন্দির প্রাঙ্গণে। অনেক ভক্তরা এক টাকা প্রণামী দিয়ে কপালে পাঁঠার রক্তের তিলক নেয়। মানসিক যারা করে, রাত বারোটার পর তাদের লোকেরা জিবের ডগায় শিক ফুঁড়ে সারা রাস্তা নাচতে নাচতে মেলার মন্দিরে হাজির হয়। একে লোকে বলে বাণফোঁড়। এরকম প্রায় সারারাত ধরে মেলা চলে। পরদিন সকাল থেকেই দিনগাজন শুরু হয়ে যায়। সূর্যের প্রখর রোদকে তোয়াক্কা না করে হিন্দু-মুসলমান মানুষ জমায়েত হয় মেলায়। আদিবাসী মেয়েরা খালি পায়ে মেলায় ঘুরে বেড়ায় সকাল থেকে সারাদিন। মেলার খাবার খেয়েই তাদের দিন কাটে। খাবার বলতে জিলিপি, মোগলাই পরটা, রসগোল্লা, ল্যাংচা। আর থাকে বারো ভাজা (কড়াই), ঘুগনি, ভেজিটেবল চপ, আইসক্রিম ইত্যাদি।
মেলার দোকান বলতে মনোহারি জিনিসপত্র, বাচ্চা ছেলেমেয়েদের খেলনা। হরেক মাল দশ টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত। মাটির ঠাকুর বিক্রি হয়। সস্তা গানের বইয়ের দোকানে বিকিয়ে যায় পর্ণ। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল লোহার কাস্তে, হেতের, কোদাল, কড়াই এসব জিনিস বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বাউলগান, লেটোগান আর পরদা টাঙিয়ে সিনেমা দেখার হিড়িক। কেবল রয়েছে যাত্রাপালা আর ফাংশন থেকে বুগি বুগি ড্যান্স।
মদের ভাটিখানায় পুলিশের রেড করা আর জুয়াখেলা বাদ দিলে মেলার আনন্দ মোটেই কম নয়। তবে জুয়াড়িদের আসর রেড করা হয় না কেন কে জানে!
নাগরদোলা, ঘূর্ণিচাকিতে কচিকাঁচাদের হাসিমুখ আর আদিবাসী মানুষের উল্লাসে মাতোয়ারা এই মেলা যে কোনো উৎসবকে হার মানায়।
Leave a Reply