সুমিত রায়, শান্তিপুর, নদীয়া#
রাজনৈতিক, দলাদলি, হানাহানি, এসব কিছুকে ছাপিয়ে কিছু মানুষ বইকে আঁকড়ে ধরে, বইকে ভালোবাসে। সে জানে শেখে আর পাঁচটা মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নেয় তার কথা। এরই সঙ্গে সে রেখে দিতে চায় নিজের চিন্তা চেতনার ছাপ এই সমাজে। সেই চিন্তা চেতনার স্ফুরন থেকে বেরিয়ে আসে কিছু নবীন ও প্রবীন লেখকগোষ্ঠী। তখন সে খুঁজে চলে কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো পত্রিকা।
আর তেমনই একটি সাহিত্য পত্রিকা গোরাগাঙনি। এরই মূল প্রতিষ্ঠান নদিয়া জেলার বগুলাতে হলেও, নদীর মতো বহু শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন জেলার মফস্বল অঞ্চলে। আর তার সেই অন্যতম একটি শাখা শান্তিপুর। প্রতি ইংরেজি মাসের প্রথম রবিবার বিকেল চারটে থেকে ছ’টা পর্যন্ত শান্তিপুর কলেজের পাশে শ্রী দীনবন্ধু শিক্ষক মহাশয়ের আম্রকুঞ্জে বসে গোরাগাঙনি-র পাঠচক্র। পাঠচক্রের প্রথমে একটি কর্মশালা, কোনো বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, এবং অবশেষে নবীন ও প্রবীন লেখক গোষ্ঠী তাদের শ্রেষ্ঠ রচনা পাঠ করে। নবীন ও প্রবীনের মেলবন্ধনে আম্রকুঞ্জে সাহিত্যের মুকুলগুলি অপরূপ শোভাবর্ষণ করে।
বর্তমান সমাজের নগ্ন দলাদলি ও লোভের হাতছানি থেকে বেরিয়ে এসে একগুচ্ছ তরুন প্রজন্ম আশ্রয় নিয়েছে গোরাগাঙনির পার-এ। তারা উদযাপন করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মসূচী। যেমন, একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন, নারীদিবস প্রভৃতি। নিজেদের মতো করে তারা সমাজকে মূল্যায়ন করতে শিখেছে। তাদের সে মূল্যায়ন উঠে আসছে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদিতে। সেই লেখার মধ্যে আছে নিরপেক্ষ ও নির্ভীকতা। ষোলোতম পাঠচক্রে তরুন গল্পকার শিবনাথ ঘোষের ‘পিতৃত্বের টান’ ছোটোগল্পের দুটি লাইন।
আমি বিবাহের কারাগারে বন্দী / তার থেকে সুদৃঢ় আমি পিতৃত্বের বন্ধনে বন্দী।
সমস্ত সম্পর্ককে স্বীকার করেও মাতৃত্ব পিতৃত্বের সম্পর্ক যে কত দৃঢ়
পৃথিবীতে মাতা ও পিতার সন্তানের প্রতি যে কত স্নেহ তা এই গল্পের মধ্যে ফুটে ওঠে।
সতেরো তম পাঠচক্রে প্রাবন্ধিক জগন্নাথ প্রামাণিকের সাহিত্য এবং সনাজ (literature and society) নামক প্রবন্ধে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধায়ের পথের পাঁচালি উপন্যাস থেকে এক অপরূপ তথ্য আমাদের সামনে দাঁড় করান —
‘অপু এবং দূর্গা ট্রেনের হুইসল শুনে কৃষিজমি-কে পেছনে ফেলে ট্রেনের দিকে দৌড়চ্ছে।’ কৃষিকে অবজ্ঞা না করে প্রাবন্ধিক আরো উন্নত প্রযুক্তি, অর্থাৎ শিল্পের দিকে আমাদের ইঙ্গিত করেছেন। তিনি ট্রেনকে শিল্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
আঠারো তম পাঠচক্রে দীনবন্ধু বিশ্বাসের অনু কবিতার দুটি চরণ —
‘ষাঁড়্গুলো সব রাস্তায় নেমে মানুষের মতো হাঁটছে,
মানুষগুলো শিং উঁচিয়ে স্বজাতিকে গুঁতাচ্ছে।’ অর্থাৎ পশু হয়েও সে মানুষের মতো রাস্তায় হাঁটছে, নিজের জাতিকে ধ্বংস করছে না। আমরা মনুষ্যজাতি হয়েও নিজের মনুষ্যত্বকে বিকিয়ে দিয়ে নিজের জাতিকে ধ্বংস করছি। পশুর মধ্যে যে মনুষ্যত্ব বোধ আছে আমাদের মধ্যে সে মনুষ্যত্ব বোধের বড়ো অভাব।
এইভাবে কয়েকটি তরুন প্রতিবাদের মধ্যে যে আলো উদ্ভাসিত হচ্ছে, তা শুধু আঠারো তম মাস নয়, আঠারো বছর ছুঁয়ে আঠারোর তরুণ যুবককে প্রস্ফুটিত করে সমাজকে কলুষমুক্ত করা, এই প্রত্যাশা সমস্ত বুদ্ধিজীবী মহলের।
Leave a Reply