শাকিল মহিনউদ্দিন, মেটিয়াবুরুজ, ৯ আগস্ট#
পরপর স্বপ্নের অপূরণে কেড়ে নিয়েছে জীবনীশক্তি, তাই কেমন যেন একতেলে, আত্মভোলা। প্রশ্ন শুনলেই হাসি পায়, মন হেসে লুটোপুটি খায়, অবুঝ মনটা মাঝেমধ্যে ভুল বোঝে, অকাজ করে বসে — নিষ্পাপ হাসি দিয়ে বোঝাতে চায়, ‘কী করব, মেয়েমানুষ আমরা, অতশত কী আর জানি?’ খোঁজ রাখে না পৃথিবীর আহ্নিকগতির, রাজার পালা বদলে মাথা ঘামায় না, কসমেটিক্স বোঝে না, তাই সাজগোজের বাহার নেই, জন্মভূমির কথা বললে শুধু ঘরকে দেখায় — কিন্তু ডাক দিলেই ‘যাই গো বাবু’ সাড়া দেয়। তলব করার কারণটা না বুঝেই ঝড়ের গতিতে পার — চোখ ফেরাতেই পুনরায় হাজির। বলেছেন এক, শুনেছে আর এক — অমনি বকেয়া বকুনি খেয়ে লজ্জাবতীর মতো গুটিয়ে যায়। বুকে জীবনযন্ত্রণার চাপা পাথরের ওপর ছোট্ট নুড়ির আঘাত। যন্ত্রণা বাড়ে, মুখের বিকৃতি ঘটে, চোখের কোণে দেখা দেয় বন্যা।
পরনে সংসারের ঝুলকালি মাখা আটপৌরে শাড়ি। ছাইমাখা গালপাটি পুরোনো সংসারের মতোই তোবড়ানো। বেশভূষায় প্রমাণ সংসারের ফুলটাইমার, সার্ভিস এটিএম–এর মতো চব্বিশ ঘন্টা। সংসারের অস্থাবর সম্পত্তি — দখলদার কর্তাগিন্নি। কখনো কর্তার পেছনে বাজারের ব্যাগ হাতে, কখনো চায়ের কাপ বা জলের গ্লাস নিয়ে অবিকল মূর্তির মতো নির্বিকার দাঁড়িয়ে, সংসারের সবচেয়ে কাছের মানুষ — পরিচারিকা।
সংসারের ফোল্ডার — খুললেই পাওয়া যাবে একরাশ তথ্য। খাঁজে খাঁজে হরেক আইটেম সাজানো — কী নেই তাতে? হাঁড়ির হাল–হকিকত, কর্তাগিন্নির চুলোচুলি থেকে সংসারের চালচিত্র। এদের ফেসবুকে গেলে একগাল হাসির আলাপচারিতায় উঠে আসে অজানা কত কথা। তবে সহজে খোলা যায় না এদের মনের কল। সাইটে যেতে হয়, গুগ্ল ঘাঁটতে হয় (ধৈর্য ধরতে হয়), মনের গভীরে সুড়সুড়ি দিয়ে বের করে আনতে হয়। এদের নাম তসলিদি, ঊষা, লক্ষ্মীদি, পারভিন বা সুরাইয়ার মা।
এরা কাজ করলেই শ্রী, নয়তো সংসারের হাল বিশ্রী। সংসারের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ — এদের দিনলিপি। ওভারটাইমও আছে — খুঁটিনাটি বিষয়ের হিসেব রাখা, ভুলে যাওয়া কথা মনে করিয়ে দেওয়া, বাইরের ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে সংসারকে আড়াল করে রাখা। ভাগ্যের পরিহাসেই এদের এই ঠিকানা। কেউ স্বামী পরিত্যক্তা, কারোর স্বামী মদখোর জুয়াড়ি, কেউ পেট পালতে এই জীবিকাবরণ। সংসারের খুবই আপনজন, তথাপি দূরের। পাঁচজনের আলোচনায় যোগদান বা সিদ্ধান্তগ্রহণের অনুমতি এদের থাকে না। গোপন কথা ব্রডকাস্টিংয়ের ভয়ে দূরে সরানো হয় এদের। অতিথির আগমনে বাড়ি সেজে ওঠে আপনমনে, আর সাজে সকলে — শুধু সাজে না এরা। নোংরা কাপড়ে বাড়ির আনাচে কানাচে আত্মগোপন করে। সারাবছরের ভাতকাপড়ই এদের পারিশ্রমিক। কিন্তু বোনাসে পায় বকুনি, দাঁতখিঁচুনি আর ঝুড়িঝুড়ি রাগঝাল — নীরবে হজম করে।
মজে যাওয়া মনের ওপর এক ফোঁটা সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে হাজির হয় ছোটো পর্দার সুখদুঃখের গলিঘুঁজিতে, ছোটো ছোটো হাসিকান্নার রঙ্গালয়ে নিজেকে খুঁজে পাবার কী নিদারুণ প্রচেষ্টা। টিভি সিরিয়ালে শাশুড়ি–বউয়ের ঝগড়া, নায়ক–নায়িকার প্রেমালাপ, কিংবা ভিলেনের খপ্পরে নায়িকার আর্তনাদে উৎকণ্ঠিত হয়। ‘কী হয় কী হয়, ঘটনাটা কতদূর গড়ায়’ দেখা শেষ হয় না, কর্তার চটজলদি ফরমাস — ‘যা শিগ্গির এক কাপ চা নিয়ে আয়’ — ফিরে যায় বাস্তবের একঘেয়েমিতে। কিন্তু বিরক্তির প্রকাশ একেবারেই মানা। চা বানাবার অবসরে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোকে অভিশাপ দেয়। কাউকে বলতে পারে না, বলেও না — শুধু জলধারায় চোখদুটি ঝাপসা হয়ে যায়।
Leave a Reply