‘ফরিদাবাদ মজদুর সমাচার’ পত্রিকার (সম্পাদক শের সিং, ০১২৯-৬৫৬৭০১৪) এপ্রিল ২০১৫ সংখ্যায় মানেসার-এর আইএমটি, সেক্টর ৮, প্লট ৩৯৯-এর অস্তি ইলেক্ট্রনিক্স কারখানার কয়েকজন যুবক ঠিকা শ্রমিকের মৌখিক বিবরণ হিন্দিতে প্রকাশিত হয়েছে। এই নবীন শ্রমিকদের জীবনসংগ্রামের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির গুরুত্ব অনুভব করেই আমরা কয়েক কিস্তিতে তা বাংলায় অনুবাদ করে পুনঃপ্রকাশ করছি। মানেসার দ্রুত গড়ে ওঠা এক অত্যাধুনিক শিল্পাঞ্চল। দিল্লি শহরের কাছেই হরিয়ানা রাজ্যের মধ্যে গুরগাঁও জেলায় অবস্থিত এই শিল্প-শহর। অস্তি ইলেক্ট্রনিক্স কারখানায় গাড়ির ইলেকট্রিকাল ইকুইপমেন্ট, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদির ইলেকট্রিক কন্ট্রোল বোর্ড, মোবাইল ফোনের সার্কিট বোর্ড, রোবোট্সের কন্ট্রোল ইত্যাদির উৎপাদন হয়। অস্তি কর্পোরেশনের ৬টা ফ্যাকট্রি আছে জাপানে, ২টো চীনে, ২টো ভিয়েতনামে আর একটা মানেসারে। মানেসারে উৎপাদন শুরু হয়েছে ২০০৫ সালের অক্টোবরে। অস্তির ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে সুজুকি, ইয়ামা, প্যানাসোনিক, টয়োটা, ডেন্সো, কাবাসাকি, হন্ডা, মিৎসুবিশি, হিতাচি, সানিও, ক্যানন, সোনি, রোল্যান্ড, ফুজিৎসু, কসমো ইত্যাদি কোম্পানি। মানেসার কারখানার তিন-চতুর্থাংশ মহিলা শ্রমিক।
নেতাদের তরজা
* ঠিকা শ্রমিকেরা নিজেদের দম নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ইনকলাবি, ক্রান্তিকারি, ‘মজদুর বিউগ্ল’ ইত্যাদি গোষ্ঠীরা এসে আন্দোলনকে হাইজ্যাক করার চেষ্টা করল। কিন্তু আমরা সেসব হতে দিলাম না। ওদের আমরা পরামর্শদাতা হিসেবে গ্রহণ করলাম। ওদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে থাকলাম। আমরা ওদের হাতজোড় করে বললাম, দেখুন, আপনাদের কথা আমরা শুনব বটে, তবে মানা আর না-মানা আমাদের ব্যাপার।
এআইটিউসি নেতা : এইচএমএস এরকমই করে। তোমরা আমাদের সঙ্গে এসো। তোমাদের লড়াইটা আমরাই লড়ব।
ঠিকা শ্রমিক : আপনারা এসেছেন, ভালো কথা। যদিও আপনারা নপিনো অটো-তে যা করেছেন, সেটা আমরা ভালোই দেখেছি। আপনি যেতে পারেন। নমস্কার।
সিটু নেতা মোদির বিরুদ্ধে অনেক কিছু বললেন : মোদি এত এত আইন নিয়ে আসছেন যার ফলে শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ খারাপ হয়ে যাবে। ওইসব আইন যাতে পাশ না হয়, আমাদের রুখতে হবে।
ঠিকা শ্রমিক : আপনি বয়সে প্রবীণ। আপনার অনেক জ্ঞান। কিন্তু এটা রাজনৈতিক মঞ্চ নয়। ওইসব আইন তো এখনও আসেনি। আমরা তো তার আগেই বরবাদ হয়ে গেছি। এখন যে আইন আছে সেগুলোই লাগু করাতে পারছি না আর ভবিষ্যৎ নিয়ে হাঁক পাড়ছি।
এরপর যখন ‘মজদুর বিউগ্ল’ওয়ালারা এল, ইনকলাবিওয়ালারা বিরোধিতা করল। কেন ওরা এসেছে? ওদের মঞ্চ থেকে বলার সময় দেওয়া হবে না।
ঠিকা শ্রমিক : এটা তো ইনকলাবিওয়ালাদের মঞ্চ নয়। এটা ঠিকা শ্রমিকদের মঞ্চ। কে বলবে আর কে বলবে না, সেটা আমরাই ঠিক করব।
ঠিকা শ্রমিকদের লাগাতার অনশন
* কোম্পানির ওপর চাপ দেওয়ার জন্য ২ জন পুরুষ এবং ৫ জন মহিলা শ্রমিক ২৫ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভুখ হরতাল করল। কোনো সমঝোতা হল না, অনশন প্রত্যাহার করা হল। অনশন চলাকালীন অনেকে নানা মন্তব্য করলেন।
ডিসি, গুড়গাঁও : আমরা কি তোমাদের ভুখ হরতাল করতে বলেছি? তোমরা আমাদের ব্ল্যাকমেল করছ। বেরিয়ে যাও আমাদের অফিস থেকে। শ্রম দপ্তরে তোমাদের মামলা রয়েছে, ওরাই দেখবে।
মুখ্যমন্ত্রী জনতা দরবারে আবেদন করলেন। কোনো উত্তর পাওয়া গেল না।
গুড়গাঁও থেকে রাজ্য সরকারে যিনি মন্ত্রী হয়েছেন : ঠিক আছে, দেখছি।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী : এটা আমার এলাকা নয়। তবু আপনারা যখন এসেছেন, আমি কথা বলব।
বিজেপির মহিলা শাখার প্রধান ঠিকা শ্রমিকদের ব্যাপারে কথা বলতে ফ্যাকট্রিতে গেলেন। বেরিয়ে এসে বললেন, কাজ কম রয়েছে। তবু আমি ওপরমহলে বিষয়টা নিয়ে যাব। তারপর অবশ্য তাঁর আর দেখা পাওয়া গেল না।
বিধানসভা থেকে একজন এলেন, কিছু আশ্বাস দিয়ে চলে গেলেন।
শ্রমিকদের অনশন ভাঙার জন্য কয়েকজন এইচএমএসের নেতাও এলেন।
লড়াইয়ের অবসান আর পাওনা হিসেব বুঝে নেওয়া
* অনশন শেষ হওয়ার পর ফ্যাকট্রির কাছে ধরনা চলতে থাকল। এটা-ওটা করতে করতে আমরা আর একটা ভুল করলাম। ঠিকা শ্রমিকেরা ২৩ ডিসেম্বর ৪-৫ গ্রামের সরপঞ্চকে মধ্যস্থতা করার জন্য ডাকল। ‘আমাদের এলাকায় কোম্পানির এত স্পর্ধা কী করে হল যে এতগুলো শ্রমিককে তাড়িয়ে দিল’ — এই কথা বলতে বলতে তাঁরা ফ্যাকট্রিতে গেলেন। বাইরে বেরিয়ে এসে ওই সরপঞ্চরা বললেন, ‘যখন ফ্যাকট্রিতে কাজ নেই, তখন কাজ ওরা কোথা থেকে দেবে?’ আর আমাদের দুর্বলতা টের পেয়ে বললেন, ‘তোমরা এখান থেকে উঠে পড়ো, নাহলে জবরদস্তি উঠিয়ে দেব।’
তিনদিন পরে মস্তানরা রাতে এসে তাঁবু ভেঙে দিল।
তখন আমরা গুড়গাঁওয়ের শ্রম দপ্তরে এএলসি-র দপ্তরের সামনে ধরনায় বসলাম। একদিনের মধ্যেই পুলিশ এসে জোর করে আমাদের তুলে দিল। দ্বিতীয় দিন আমরা মুঞ্জাল কিরিইউ ফ্যাকট্রির বাইরে তিন মাস ধরে অবস্থানরত স্থায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলাম। রোজ বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত ধরনা দেওয়ার অনুমতি পাওয়া গেল। এইচএমএসের নেতারা মুঞ্জাল কিরিইউ-র শ্রমিকদের বললেন, এরা কারও কথা শোনে না, তোমরা এখান থেকে সরে পড়ো।
অস্তি-র ঠিকা শ্রমিকেরা প্রতিদিন ধরনায় বসতে থাকল। শ্রম দপ্তরে তারিখের পর তারিখ পড়তে থাকল। এর মধ্যে কোম্পানি ৫-১০-১৫ হাজার থেকে শুরু করে ২৫ হাজার পর্যন্ত হিসেব দেওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের মধ্যে ২৫০ জন ২০.১.২০১৫ পর্যন্ত হিসাব নিয়ে নিলাম। আর বাকি ৩৫ জন — ২২ জন মহিলা ও ১৩ জন পুরুষ — কোর্ট-কাছারি চালিয়ে যেতে থাকল। ইনকলাবি আর ক্রান্তিকারিদের একজন করে পরামর্শদাতা হিসেবে রাখা হল। যেহেতু আমরা আইনকানুন বুঝি না, তাই ইমানদারি বজায় রেখে চলে এরকম একজনকে উকিল হিসেবে রাখা হল। কোম্পানি ও সরকারের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য ওঁর আইনি পরামর্শ নেওয়া হল।
১৮.৩.২০১৫ তারিখে শ্রম দপ্তরে এসে কোম্পানির অফিসারেরা চুক্তি করল, ৪০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। আমরা না মানতে ওরা বলল যে এই মামলা অনেকদিন চলবে। আমরাও বললাম, চলুক!
ভবিষ্যতের প্রস্তুতি
* যারা হিসাব নিয়ে নিল আর যারা কোর্টে গেল, অস্তি ইলেকট্রনিক্সের সেইসব শ্রমিক এলাকার অন্য ফ্যাকট্রিতে কাজে লেগে গেল।
নিজেদের মধ্যে মেলামেশা বজায় রাখার জন্য আমরা একটা সমিতি বানিয়েছি। ইনকলাবিওয়ালারা আমাদের সমিতির মধ্যে ঢুকতে চাইল। আমরা রাজি হলাম না। আমরা ঠিক করেছি যে আমরা যেখানেই কাজ করব, সেখানে আমাদের মধ্যে বিচালির ডাল গলতে দেব না। ইউনিয়নের জায়গায় আমরা নতুন কিছু করব। ফ্যাকট্রি-বিশেষ হিসেবে সংগঠিত না হয়ে আমরা শিল্প হিসেবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করব।
Leave a Reply