প্রবীর সেনগুপ্ত, তেঘরি, গেটপাড়া, মদনপুর, চাকদহ, ১৯ জুলাই#
১৯৮৬ সালের মার্চ বা এপ্রিল থেকে একটিমেশিনের সাহায্যে বেশ কিছু লোকের দ্বারা অত্যাচারের শুরু। আজও সেই অত্যাচার দিবারাত্র সমানে চলছে। কে বা কারা এই অত্যাচারে লিপ্ত জানা অসম্ভব। যেখান থেকে অত্যাচারের শুরু সে স্টপেজ বা জায়গার নাম গৌরাঙ্গ মন্দির। বাঘাযতীনের পর বিদ্যাসাগর তারপর গৌরাঙ্গ মন্দির। যাদবপুর পুলিশ ফাঁড়ির অন্তর্গত। অত্যাচারীরা এই অঞ্চলেরই নিকটবর্তী বাসিন্দা। কেন এ অত্যাচার আজও সমানে চলছে তা বুঝে উঠতে পারছি না। পাড়ার অনেকেই এদের নাম এবং কোথায় থাকে জিজ্ঞাসা করায় এড়িয়ে গেছে। অথচ সবাই এদের চিনত। মেশিন সম্পর্কে কেউ জানত না বা মেশিনের দ্বারা এরকম অত্যাচার করা যেতে পারে কারো সে ধারণা ছিল না বা নেই।
আমি মেশিনের সাহায্যে অনেকপ্রকার অত্যাচারের বিবরণ দেওয়া সত্ত্বেও কাউকে বিশ্বাস করাতে পারতাম না বা বিশ্বাসযোগ্য হত না। আজও নয়। এ এক বিশেষ খুনের মেশিন যা সকলের কাছে অজানা। এটাই অত্যাচারীদের কাছে প্লাস পয়েন্ট। ইলেকট্রনিক্সের যুগে এরকম মেশিন অবিশ্বাসের কিংবা আশ্চর্যের হওয়াই বিস্ময়ের।
মেশিনের সাহায্যে কী কী হয় তা সংক্ষিপ্ত বিবরণ সহ উল্লেখ করছি।
কানে শুনিয়ে
কানে শুনিয়ে নানান নোংরা কথা বলে। বানান, উচ্চারণ ভুল করিয়ে দেওয়া হয়। পড়তে গেলে হইচই করা এবং বিভিন্ন রকম কথা বলার দরুন পড়াও মনে রাখা সম্ভব নয়। লিখতে গেলে কোনোরূপ বাক্য গঠনকালে তার সঙ্গে এমন শব্দ জুড়ে দেয় যে সেই বাক্য গঠন করা সম্ভব হয় না। পুনরায় বাক্য তৈরি করতে বাধ্য করে, লেখাকালীন আঙুলে এমন চাপ সৃষ্টি করা হয় যে আঙুল কোনোভাবে নাড়ানো সম্ভব নয়। অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করি। এমনকী লিখতে গেলে এমন প্রক্রিয়া করা হয় যাতে পেনে কালি থাকা সত্ত্বেও কালি বের হয় না। সম্ভবত ওখানে মোমজাতীয় কাগজের সাহায্যে কলম থেকে কালি রোধ করা হয়।
সব দেখা যায়, শোনা যায়, ঘর বন্ধ থাকাকালীনও। কারোর সঙ্গে কোনোরকম গোপন কথা গোপন রাখা যায় না। সর্বদা উন্মাদ করে রাখে। মেশিনের সাহায্যে স্মাগলিং করা, কাউকে অনুসরণ করা ও যে কোনো সরকারি, বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও অনুসন্ধানের কাজ জেনে যাওয়া কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
দেহের অত্যাচার
চুল, ভুরু, চোখ, দাঁত, নার্ভ এবং হাড় প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন অত্যাচার সর্বদা সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছি।
চুল ও ভুরুতে নানান রকম কেমিক্যাল ছাড়াও আরও অন্য কিছু দেওয়া হয়। কানে শুনিয়ে বলার দরুন মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারি কিছু প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেমন কোনো সময় লজ্জাবতী লতাকে স্পর্শ করার মতো, কোনো সময় শুষ্ক, আবার কোনো সময় মাথায় জল ঢালার মতো চপচপে ভেজা। তার ফলে চুল ঝরে যায়। ভুরুতেও ওইরকম প্রয়োগের ফলে ভুরুর চুল সব পড়ে যায়।
চোখে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে অসহ্য জ্বালা করে এবং নোংরা আসে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে চোখের মণি ও ভিতরকার সাদা অংশ শুষ্ক হয়ে যায়। ফলে ভয়ানক চুলকায়। এসব প্রয়োগের কথা আনুমানিক ও তাদের কানে শুনিয়ে বলার ভিত্তিতে। যার দরুন দৃষ্টি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়। ডাক্তারের উপদেশ অনুযায়ী আই ড্রপ ব্যবহার করি।
দাঁতে ব্রাশ লাগানো যায় না। ব্রাশ সঠিক ব্যবহার না করতে দেওয়ার দরুন ক্ষতি হয় এবং শীঘ্রই পড়ে যায়। জলপান করাকালীন দাঁতে এমন ধাতব স্পর্শ করে যার ফলে অসম্ভব যন্ত্রণা অনুভূত হয় যা অবর্ণনীয়। যে কোনো খাবার চিবোতে গেলে সূক্ষ্ম তারের মতো কোনো কিছু ব্যবহারের ফলে মাড়িতে গিঁথে যায় ফলে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। খাবার খাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হই। এক্ষেত্রেও ডাক্তারের প্রয়োজন।
নার্ভের চাপ সৃষ্টির ফলে জীবন বেরিয়ে যায়। পা, হাত বা আঙুল এমন অবস্থায় যে কোনোভাবে নাড়ানো যায় না। নার্ভ ছিঁড়ে যাওয়ার মতো। ডাক্তারের মতামত অনুযায়ী ওষুধ খেতে বাধ্য হই। অতিমাত্রায় ঘুমের ওষুধ খেয়েও অত্যাচারে ঘুম হয় না।
পায়ের হাড় চেপে ধরলে এক পাও এগোনো যায় না। বিছানাতে শুলেও হাড়ের এই অত্যাচারের ফলে ভেঙে যাবার মতো হয়। ঘুমোনো সম্ভব নয়। যন্ত্রণা বলা বাহুল্য।
যা যা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা কানে শুনিয়ে শুনিয়ে করা হয়েছে। অন্যথায় জানা বা বোঝা সম্ভব নয় যে মেশিনের দ্বারা এই অত্যাচার।
প্রথম অবস্থায় (১৯৮৬) আমি বুঝতে পারতাম না, কানে শব্দ কোথা থেকে আসে ও নানান কুৎসিত কথা কে বলছে? কোথা থেকেই বা আসছে? কারা বলছে? অনুসরণ করার জন্য ঘরের বাইরে যেতাম, কাউকে দেখতে পেতাম না। মাসখানেক এইরকম অজানা ভীতির মধ্যে থাকার পর কানে শুনতে পাই এ অত্যাচার মেশিনের সাহায্যে করা হচ্ছে। তখন বুঝতে পারতাম কানে শুনিয়ে এবং দেহের এই অত্যাচার সবই মেশিনের সাহায্যে।
এইসব বিবরণে সাধারণ চিকিৎসক ও মনোরোগ চিকিৎসক তাকে মনোরোগী হিসেবে পরিগণিত করে। মনোরোগীরা অনেক কিছু বলে যা সম্পূর্ণ কাল্পনিক, একেবারে অবাস্তব। সুতরাং আমার এই বাস্তব সত্য ডাক্তার এবং সাধারণের কাছে মনোরোগীর ন্যায় কাল্পনিক ও অবাস্তব। সুতরাং আমি মনোরোগী বলে পরিগণিত ও মনোরোগ চিকিৎসাধীন। যার ফলে মেশিন ব্যবহারে কোনরকম ভীতি বা বাধার প্রশ্ন উঠছে না। সুতরাং মেশিন পরিচালকবৃন্দ মেশিন পরিচালনায় নির্ভীক।
১৯৮৬-তে অসহ্য অত্যাচার থেকে বাঁচার তাগিদে আমি ভবানীভবনে ডিআইজি সিআইডি ডিপার্টমেন্টের মিঃ মণ্ডলের কাছে যাই এবং আবেদন রাখি। বেশ কয়েকবার যাওয়ার পর সব বর্ণনাসহ একটি আবেদনপত্র জমা দিই। মিঃ মণ্ডল আবেদনপত্রটি টালিগঞ্জের ডিআইজিসিআইডি ডিপার্টমেন্টের মিঃ ভুট্টোকে পাঠান। সেখানে যাওয়া সত্ত্বেও কোনো ফল পাইনি। পুনরায় মিঃ মণ্ডলের কাছে যাই, তাতেও উপকৃত হইনি।
অবশেষে শ্রদ্ধেয় জ্যোতিবাবুর নিকট মেশিনের বিবরণসহ চিঠি দিই। জ্যোতিবাবুর সৌজন্যে টালিগঞ্জ সিআইডি থেকে মিঃ টি কে গাঙ্গুলি চিঠির মাধ্যমে আমাকে ডেকে পাঠান। সকল বিবরণ দেওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি মেশিন দ্বারা অত্যাচারিত।
১৯৯৬ সালে ‘মানস’ নামক সংস্থায় আসি। ‘মানস’ মনোরোগ সংস্থা। নদীয়ার মদনপুর তেঘরি গ্রামে অবস্থিত। মানসে থাকাকালীন পুনরায় ভবানীভবনে চিঠির মাধ্যমে আবেদন করি।
অবশেষে চাকদহ ডিআইজি সিআইডি থেকে মিঃ ভৌমিক ইনভেস্টিগেশনে আসেন ও ডাক্তারদের সঙ্গে এই সংক্রান্ত ব্যাপারে কথা বলেন। আমিও তিন থেকে চারবার ওনার কাছে যাই। অথচ কোনো সুরাহা হয়নি।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেববাবুকেও দুইবার চিঠি দিয়েছি। কোনো উত্তর মেলেনি। এইরকম অত্যাচার যার ওপর যেখানেই করুক না কেন কোনো কাজেই সক্ষম হওয়া যায় না। মৃত্যু ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এ বেঁচে থাকা অর্থহীন। আমি মৃত। আমি যে মেশিনে অত্যাচারিত যদি অন্য কারো ওপর তা প্রয়োগ করা হয়, সেও আমার মতো সব কিছু হারাতে বাধ্য হবে। কোনো কাজ বা কোনো কিছুই তার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। কাউকে বিশ্বাস করানোও অসম্ভব।
যে কোনো পদস্থ কর্মচারী, পলিটিকাল লিডার বা প্রশাসনিক কাউকেও কানে না শুনিয়ে এভাবে দেহের অত্যাচার করা — তার পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে না। অপারগ হতে বাধ্য। ডাক্তার অবলম্বন ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
অনুরোধ আর কাউকে যেন এইরকম অত্যাচারের আওতায় পড়তে না হয়। এ এক দুর্বিসহ জীবন। সুতরাং মেশিনের সন্ধান করে যত শীঘ্র সম্ভব উদ্ধার করা একান্ত প্রয়োজন।
লেখাটিতে সাধুভাষার ব্যবহার ছিল। তা সম্পাদনা করা হয়েছে।
সুমিত চক্রবর্তী says
এখন আর খেয়াল পড়ছে না। তবে মনে হচ্ছে সম্পাদনা না করে সাধুভাষা থাকলেই ভালো হতো।