১৫ জানুয়ারি, জিতেন নন্দী, রবীন্দ্রনগর, মহেশতলা#
আমাদের এই এলাকায় পথ দুর্ঘটনা লেগেই আছে। সন্তোষপুর রেল স্টেশন থেকে আকড়া ফটক অবধি রাস্তার দুপাশে ঘন বসতি। গাড়ির চালকেরা অনেক সময়ই সেটা মাথায় রাখে না। ফলে ঘটে যায় মর্মান্তিক সব দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু। এরকমই এক দুর্ঘটনা ঘটল ৬ জানুয়ারি রাতে।
পরদিন ৭ জানুয়ারি সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনছি পাশের বাড়ির মেয়ে দুটো ইস্কুলে যাচ্ছে না। ঘোষপাড়া থেকে সন্তোষপুর স্টেশন অবধি রাস্তা অবরোধ চলছে। কিছুক্ষণ পর পাড়ার কাজের লোক মামণি এল। ওর বাড়ি ঘোষপাড়ায়। ও বলল, ‘আমি শুনছি তিনজন মারা গেছে। বাবা আর ছেলে। আর একজন হিন্দুস্তানি … বেছে বেছে বাঙালিদের দোকান ভাঙছে।’ এসব বলতে বলতে মামণি ঝড়ের বেগে কয়েক বাড়ির কাজ আধসারা করে দৌড়াল ওর বাড়ির দিকে। সেখানে তখন কী হচ্ছে কে জানে!
এরপর বাজারে গেলাম সাইকেল নিয়ে। দেখলাম, রবীন্দ্রনগর থানার সামনে বেঞ্চি জুড়ে জুড়ে অবরোধ চলছে। ঘোষপাড়ার দোকানদারেরা ভাঙচুরের প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ করেছে।
বাস-অটো-যানবাহন বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ। পুলিশ প্রশাসন থেকে ঘোষণা করল ১৪৪ ধারা। সন্ধ্যেবেলায় বেরিয়ে দেখি কার্ফুর মতো থমথমে পরিস্থিতি। রাস্তায় টহল দিচ্ছে র্যাফ আর পুলিশ। ট্রাফিক গার্ড দিয়ে জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেড করা রয়েছে। সবচেয়ে অবাক হলাম যখন দেখলাম আমাদের পাড়ার তিনটে মন্দিরই বন্ধ হয়ে রয়েছে। একটা আতঙ্ক, লোকে গজগজ করছে, কিন্তু ফিসফাস করে।
কী বলছে তারা? কী ভাবছে? গুজবের খোলস ছাড়িয়ে তারই এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
চারধার থেকে ছেলেরা এসেছিল ভাঙতে
সুরাইয়া, সাতঘরা
যে মারা গেছে তার বাড়ি ছিল পীরডাঙার পীরবাবার মাজারের পিছনে। ও আবার লাঠিখোলার মালিকদের শালা না কী হয়। আর একজন যে মারা গেছে, সে খেয়ে নাকি বাসন ধুচ্ছিল। শুধু আমরিতলা থেকে তো আসেনি, বড়তলা লালপোল লাঠিখোলা চারধার থেকে ছেলেরা এসেছিল ভাঙতে।
দুর্ঘটনার দশ মিনিটের মধ্যেই থানায় ফোন করেছি
তরুণ সাও, ঘোষপাড়ার হোটেলের কর্মচারী
তখন রাত এগারোটা দশ। আমাদের হোটেলের গেট আঁটা। পীরডাঙার সেলুনে কাজ করে জামাই আর শালা। ওই হোটেলটা বন্ধ ছিল বলে সাইকেল নিয়ে ওরা আমাদের এখানে এসেছিল। বেরিয়ে যাওয়ার পর … দেখুন গাড়িটা হোটেলের গা ঘেঁসে চলে গেছে। আওয়াজ হচ্ছে আমরা বেরিয়ে দেখি একজন এইদিকে পড়ে আছে, আর একজন ওই গাছতলার ওখানটায়। তারপর লোকজন এসে সবাই মিলে গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হল। পরেরদিন সকালে হোটেল খোলা হয়েছিল। তারপর গণ্ডগোল দেখে লোক বাড়তে সওয়া ন-টা নাগাদ বন্ধ করে আমরা পয়সাকড়ি গোছ করে পেছন দিয়ে পালিয়ে গেছি।
হাজারখানেক লোক এসেছিল। ভাঙচুরের নমুনা ওই তো দেখছেন। পুলিশ ছিল আগে থেকেই। পুরো স্টাফই ছিল। আমি আগের দিন অ্যাকসিডেন্ট হওয়ার দশ মিনিটের মধ্যেই থানায় খোকনবাবুকে ফোন করেছি।
গাড়িটা পীরডাঙায় একটা রিকশাকে মেরে এদিকে আসে
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, ঘোষপাড়া
আমি দেখেছি। গাড়িটা ওইদিক থেকে আসছিল। প্রথমে পীরডাঙায় একটা রিকশাকে মেরে আসে। তারপর এই হোটেল থেকে একটা সেলুনের ছেলে খেয়ে বেরোচ্ছিল, তখন তাকে ধাক্কা মারে। পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে চলে যায়। তারপর গাড়িটা যখন আসছে, ওদিক থেকে একটা ট্যাক্সি পাস হয়। পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা সাইকেল আসছিল, সেই সাইকেলে মেরে দিয়ে গাড়িটা দুটো পাক খেয়ে ঘুরে সোজা দোকানে ধাক্কা মারে।
পুলিশ-প্রশাসন সব লাইন দিয়ে পিছনে পিছনে যাচ্ছে
অরবিন্দ রাহা, ঘোষপাড়ার সাইকেলের দোকান
আগের দিন রাতে এগারোটা দশ নাগাদ একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়। একজন মারা গেছেন, নাম বলতে পারব না, লেবুতলায় ওনার বাড়ি। আর একজন ইন্জিওরড হয়েছেন, ওনার সেলুন-দোকান আছে। ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ড্রাইভার ধরা পড়েছে, গাড়ি আর লাশটাকে থানায় নিয়ে চলে গেছে। পরেরদিন সকাল আটটার পরে — অবরোধ ছিল কিছুক্ষণ আগে থেকে, দোকানপাট কিছু খুলতে দেয়নি — দশ-পনেরো হাজার লোক এসে দোকান ভাঙচুর করে। ভোলা কাউন্সিলার আর একটা লোক কী নাম যেন, সে বলল, তোরা এখনও দাঁড়িয়ে আছিস, ভাঙিসনি? বলতেই ওরা ভাঙতে শুরু করল। পুলিশ-প্রশাসন সব লাইন দিয়ে পিছনে পিছনে যাচ্ছে। বড়োবাবু স্পটে ছিলেন। আমার দোকানে ইট মেরেছে, ওপরে গাঁথনি দেওয়া আছে, ভাঙতে পারেনি। একজন পুলিশের লোককে আমি বললাম, আপনারা কন্ট্রোল করতে পারছেন না, আপনারা র্যাফ কেন নামাচ্ছেন না? তখন একজন পুলিশ আমাকে লাঠি নিয়ে তাড়া করে।
আমার দোকান ভাঙছে, আমি কী করে একা প্রতিবাদ করব?
মানস ঘোষ, ঘোষপাড়া
আমার ইলেকট্রনিক্সের দোকান। রেডিও-টেডিও সারাই। অ্যাকসিডেন্টের পর খবর পেয়ে রাতে এসেছিলাম। এসে দেখলাম, একজন ভদ্রলোক মারা গেছেন, স্পট ডেড হয়ে গেছেন। আর একজনকে হোটেলের ওখানে ধাক্কা মেরেছে। সকালবেলা আমি দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছি, আমার দোকান ভাঙছে, আমি কী করে একা প্রতিবাদ করব? ওদের বক্তব্য যতটা বুঝতে পেরেছি, এইসব খালধারের দোকানের জন্য পথটা সরু হয়ে গেছে, এইজন্য অ্যাকসিডেন্টগুলো হচ্ছে। … আমার টালিগুলো ভেঙেছে, ঝাঁপ ভেঙেছে, ভিতরে ওরা ঢুকতে পারেনি। কোনো দোকানেরই ভিতরে ওরা ঢোকেনি। লুটপাট হয়নি।
এসে দেখি গাড়িটা ভেঙে পড়ে আছে
রীতা বিশ্বাস, ঘোষপাড়ার সিগারেটের দোকান
রাতে আমি সাড়ে নটার সময় দোকান বন্ধ করে চলে গেছি। আমি খবর পেয়েছি তখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে। এলাম, এসে দেখি গাড়িটা ভেঙে পড়ে আছে। সব চুরমার হয়ে আছে, যা সাজানো ছিল জিনিসপত্রও সব চলে গেছে। তারপর পুলিশ, বড়োবাবুকে বললাম, কী করব? — যান যা আছে নিয়ে যান। বস্তা ভরেছি, তার মধ্যেও কিছু চলে গেছে। যে ক-টা ছিল, সরিয়ে নিয়ে গেলাম। পরেরদিন সকালবেলা সাতটা নাগাদ এসেছি। তার অনেক পরে দল বেঁধে এসে সব ভেঙে দিয়ে গেছে। ওপারে দাঁড়িয়ে আছি, দেখছি, ওদের কিছু বলতেও পারছি না। কী বলব, এত লোক। — ‘ভাঙ শালাদের ভাঙ’ বলতে বলতে যাচ্ছে — ওদের হাতে পাথর ইট বাঁশ, এখনও বাঁশ ভিতরে পড়ে আছে।
এসপি সাহেব বলেছেন, দেখছি গঙ্গাসাগরের মেলার পরে কী করা যায়
পরিতোষ দাস, ঘোষপাড়ার মুরগির দোকান
আমার মুরগির দোকান। ভাঙার পরে এগারোটা সাড়ে এগারোটার সময় একটু শান্ত হল। এতসংখ্যক লোক এসেছিল, স্থানীয় লোক কী বলবে? এই অঞ্চলেরই লোক। আমরা দোকানদাররা একটা জয়েন্ট পিটিশন করে থানায় আর আলিপুরে এসপি সাহেবের কাছে দিয়েছি, ওনারা বলেছেন, আমরা দেখছি গঙ্গাসাগরের মেলার পরে কী করা যায়। সাড়ে দশটা নাগাদ রবীন্দ্রনগর থানার ওখানে গিয়ে আমরা অবরোধ করেছিলাম। আমাদের দাবি ছিল, বারবার যদি অ্যাকসিডেন্ট হয়, তার জন্য দোকানদাররা তো দায়ী নয়, দোকানের ওপর কেন অত্যাচার হবে? আগের রবিবার সকালে আর একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। লালপোলের এক মহিলার অ্যাকসিডেন্ট হয়, পঞ্চান্নের মতো বয়স, এক ঘণ্টা পরে মারা গেছেন। একটা ছ-চাকার লরি জেট স্পিডে এসে … সকাল ছ-টায়।
শীতল মদ খেতে গিয়েছিল সন্তোষপুরে
পৃথ্বীরাজ তপাদার, রবীন্দ্রনগর এ ব্লক
আমাদের পাড়ার ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলায় শীতল দাসরা থাকে। ওরা তিন ভাই। তার মধ্যে ছোটো ছেলে আগে মারা গেছে। ক-দিন আগে ওদের বাবা মারা গেছেন। সোমবার ৫ জানুয়ারি ছিল তার বাবার শ্রাদ্ধ। মঙ্গলবার রাত দশটা নাগাদ সে নিজের মারুতি ভ্যান চালিয়ে মদ খেতে যায় সন্তোষপুরে। আবার কেউ বলছে, শীতল বাবার শ্রাদ্ধের ব্রাহ্মণের পাওনা মেটাতে বিধানগড়ে গিয়েছিল। ফেরার পথে এগারোটা নাগাদ সে ঘোষপাড়ার মোড়ে মিষ্টির দোকানের আগের পান-বিড়ির দোকানে এসে ধাক্কা মারে। তখন মারা যায় একজন। স্থানীয় মানুষ এসে ওই ঘটনা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মারধোর করে। পরদিন সকালে সাড়ে আটটা নাগাদ আবুতালেব মোল্লা এবং তাঁর এক সহকর্মী প্রচুর ছেলেকে নিয়ে এসে ঘোষপাড়া থেকে সন্তোষপুর পর্যন্ত দোকানগুলি ভাঙচুর করে। বিধানগড়ের কালিমন্দিরে ইট মারলে স্থানীয় বাসিন্দা, মূলত মহিলারা এসে রুখে দাঁড়ায়।
বেছে বেছে হিন্দুদের দোকান ভেঙেছে, একথা সত্য নয়
কল্যাণ ভট্টাচার্য, রবীন্দ্রনগরের দোকানদার
পীরডাঙার কাছে একজন রিকশাওয়ালাকে ধাক্কা মেরেছে, লোকে তাড়া করে। তারপর সেলুনের দোকানের ছেলেকে ধাক্কা মারে, সে হোটেলে খেয়ে মুখ ধুচ্ছিল, এরপর ঘোষপাড়ার কাছে এসে সাইকেলে বাবা আর ছেলেকে ধাক্কা মেরে সিগারেটের দোকানে ঢুকে গেছে। পরদিন বেছে বেছে হিন্দুদের দোকান ভেঙেছে, একথা সত্য নয়। যেমন, মুসলমান মালিকের কুয়োর বেড়ের দোকানে ভাঙচুর হয়েছে; নুরেলের বিল্ডিং মেটেরিয়ালের দোকানের সামনে ওর ইটগুলো খালে ফেলে দিয়েছে।
ওরা বলল, আমরা আজকে ভাঙচুর করব
চন্দন বসু, বিধানগড়
৬ তারিখ রাত্রি এগারোটা দশ-পনেরোতে ঘোষপাড়া মোড়ে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়। আমরা এখানে শুনি যে একজন না দুজন মারা যায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন সকালবেলা দোকান খুলেছি, কাজকর্ম শুরু হয়েছে। শুনলাম যে বাস-টাস বন্ধ আছে, ঘোষপাড়ায় পথ অবরোধ চলছে। আমরা ঠিক করলাম, আমাদের বললে আমরাও দোকান বন্ধ করে দেব। কিছুক্ষণ পরে পৌনে আটটা নাগাদ একটা দল এল। সেই দলে সত্তর-আশিজন ছেলে, লুঙ্গি পরা, হাতে লাঠিসোটা। দোকান ভাঙতে ভাঙতে আসছিল। এখানে আসার পরে আমরা প্রতিরোধ করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কীসের জন্য তোরা দোকান ভাঙছিস? দোকান যদি তুলতেই হয়, এক কাজ কর, আকড়া ফটক থেকে নেচার পার্ক পর্যন্ত পরিষ্কার কর, আমরাও তোদের সঙ্গে আছি। অবরোধ করতে বল, আমরাও আছি। মিটে গেল। তার ঠিক মিনিট দশ-পনেরো পরে একটা বিশাল জনতা নিয়ে আমাদের এখানকার ৮নং পৌরসভার কাউন্সিলার আবু তালেব মোল্লা, তার সঙ্গে থানার বড়োবাবু মধুসূদন নাথ ওনার স্টাফ নিয়ে এসে পড়লেন। উন্মত্ত জনতা প্রত্যেকটা দোকান ভাঙছে, মারছে, পথচারীদের গালাগাল করছে, করতে করতে এই পর্যন্ত এসে গেল। আমরা বললাম, ব্যাপারটা কী? বলল, তোমরা ঘরে চলে যাও, আমরা আজকে ভাঙচুর করব। তারপর আমরা পাড়ার লোক, মহিলা সকলকে নিয়ে পথ অবরোধ করলাম। আমাদের দাবি ছিল, এসপি-কে এখানে আসতে হবে। তিনি আসতে পারেননি। এসডিও এবং অন্য অফিসাররা এসেছিলেন। আমরা তাদের ডেপুটেশন দিলাম। ওঁরা বললেন, আমরা দেখছি।
সবাই ঠেকিয়েছে, নাহলে রিপন মরে যেত
নরেন্দ্র নাথ রায়, বিধানগড়
আমরা সকালে দোকান খুলতে এসেছি। তখন শুনতে পাচ্ছি, ওরা দলবল নিয়ে আসছে। এখানকার লোক ওদের থামাতে গেছে। ওরা শোনেনি। আমার ছেলে রিপনের দোকান ভাঙতে গেছে, ও বলেছে, আমার দোকান ভেঙো না। ও ওদের ঠেকাতে গেছে, ওরা দোকানের ঝাঁপ খুলে ভিতরে সব ভেঙে দিয়েছে। মাথায় বাড়ি দিয়েছে, সবাই ঠেকিয়েছে, নাহলে ওখানেই মরে যেত। … ওর ঘুগনি ভর্তি গামলাটা নিয়ে খালের জলে ফেলে দিয়েছে।
দুটো ছেলে এতিম হয়ে গেল
অনুপম ইসলাম, কানখুলি হালদারপাড়া
যিনি মারা গেছেন কালামউল্লা হালদার (বয়স ৪৪), আমার মামা। উনি খানা খেতে গিয়েছিলেন সফির কাঠগোলায়। ক্ষীর-পিঠে ছিল, বিয়ের আগের দিন একটা অনুষ্ঠান হয়। উনি সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করতেন, খেয়েদেয়ে আসছিলেন। সাইকেলটা নিয়ে হেঁটে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। সেই টাইমে একটা মারুতি ভ্যান সন্তোষপুরের ওই সাইড থেকে আসছিল। ড্রাইভার মদ্যপান অবস্থায় ছিল। বেপরোয়াভাবে গাড়িটা ওঁকে ধাক্কা মেরে একেবারে দোকানের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। তৎক্ষণাৎ পুলিশ ওঁকে নিয়ে চলে গেছে। একজন এসে খবর দিতে আনুমানিক ওঁর ছেলে বার হয়ে গেল। ওর মা বার হতে দিচ্ছিল না। গিয়ে দেখে ওর বাবার সাইকেল আর জুতোটা পড়ে আছে। ও কাঁদতে কাঁদতে ঘরে এল।
উনি রেডিমেড সেলাই কাটাইয়ের কাজ করতেন। বাচ্চাকাচ্চা সেয়ানা হয়ে ওঠবার মুখে চলে গেলেন। বড়ো ছেলে শাহরুখ রবীন্দ্রনগর স্কুলে ক্লাস টুয়েলভে পড়ে। ছোটো ছেলে সালমান। দুটো ছেলে এতিম হয়ে গেল।
গৌতমের মাথার ভিতরে আঘাত লেগেছে
ছোটেলাল শর্মা, পীরডাঙায় সেলুনের দোকান
৬ জানুয়ারি রাতে আমি এবং আমার শ্যালক গৌতম শর্মা (বয়স ২০) সাইকেলে চেপে খেতে গিয়েছিলাম ঘোষপাড়ায় হোটেলে। খাওয়ার পর আমরা যেই হোটেল থেকে বেরিয়েছি, একটা মারুতি জিপ এসে আমার শ্যালককে ধাক্কা মারে সামনে থেকে। ও পড়ে যায়। ওর চোখে, মুখে আর মাথায় দারুণ চোট লাগে। তখন রাত ১১টা ১০ মিনিট বাজে। সেই অবস্থায় আমি সাইকেল ফেলে রেখে একটা ট্যাক্সিকে হাতে-পায়ে ধরে ওকে নিয়ে যাই টালিগঞ্জে বাঙুর হাসপাতালে। সেখান থেকে পেশেন্টকে ছেড়ে দেয়। অগত্যা আমি অ্যাম্বুলেন্সে করে ওকে একটা নার্সিং হোমে নিয়ে যাই। সেখানে একদিনে আমার কাছ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে নেয়। পেশেন্টকে তখন নিয়ে যাই চিত্তরঞ্জনে (পার্ক সার্কাসে ন্যাশনাল মেডিকাল কলেজে)। সেখানে ওর চিকিৎসা হয়। কিন্তু শনিবার ওকে ওরাও ছেড়ে দেয় এবং লিখে দেয় যে নিউরো-সার্জারি ডিপার্টমেন্টে সোমবার অথবা শুক্রবার নিয়ে আসতে। কারণ ওর মাথার ভিতরে আঘাত লেগেছে।
হাজার হাজার ছেলে, কাকে সামলাব?
আবুতালেব মোল্লা, মহেশতলা ৮নং ওয়ার্ডের পৌরপিতা
(৭ তারিখ) বেলা ন-টা নাগাদ, আমাকে আইসি ফোন করলেন, কাউন্সিলার সাহেব, আপনি একটু ঘোষপাড়ায় আসেন, বিশাল গণ্ডগোল হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে আর একজন ফোন করল, দাদা এখানে একবার আসেন, দোকানগুলো ভাঙচুর হচ্ছে। আমি মোটরসাইকেল নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলাম। দেখছি পুলিশ নেই, চ্যাংড়া ছেলেরা কেউ টালিতে ইট মারছে, কেউ শাটারে ইট মারছে। কারও হাতে বাঁশ আছে, সে বাঁশ দিয়ে টালি ভাঙছে। এবার কাকে সামলাব? সেখানে তো হাজার হাজার ছেলে। আইসি-কে বললাম, আপনারা কোথায়? — আমরা এই সামনেই এসে গেছি। তারপর দেখি পুলিশ আসছে। এবারে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে যতটা পেরেছি সামলেছি। এখানে আছি, তখন ফোন এল সন্তোষপুর থেকে, এখানে গণ্ডগোল হচ্ছে, তুমি এখানে এসো। আমি বললাম, আমি তো একটা লোক, পুলিশ নিয়ে যাচ্ছি। আমরা এদিকটায় কিছুটা বন্ধ করতে করতে ওখানে চলে গেলাম। ঘোষপাড়া থেকে যাচ্ছি, কারও হয়তো টালি ভেঙেছে, কারও হয়তো দোকানের পাল্লা ভেঙেছে। নেপুর গোলার ওখানে, কিশোর সংঘ ক্লাবটার ওখানে উইকেট-টুইকেট বার করেছিল, যারা ভাঙচুর করছে তাদের সঙ্গে … আমরা গিয়ে দেখি ওইরকম ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে, আমরা সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে দিলাম। ওখান থেকে আমরা চলে এলাম ফের ঘোষপাড়াতে।
হাজার হাজার ছেলে, ছোটো ছোটো বাচ্চারা, অনেক চ্যাংড়া ছেলেরা, আমাদের এই মোড় থেকে কিছু, হাজিরতন থেকে কিছু, পাঁচুড় থেকে, মালিপাড়া থেকে, ৭নং ওয়ার্ড থেকে, সন্তোষপুরের ওদিক থেকে ছেলেরা এসেছে। তাদের বক্তব্য যে বারবার এখানে অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে। আমি আর খালেক সাহেব মিলে সবাইকে শান্ত করলাম। আমরা বললাম, ভাঙচুর করে লাভ নেই, এই বেআইনি দোকানগুলো যাতে উচ্ছেদ হয় আমরা চেষ্টা করব। যারা ভাঙচুর করছিল, সব জায়গার ছেলে ছিল, পাবলিকের বক্তব্য হচ্ছে, এই জায়গায় প্রায়ই অ্যাকসিডেন্ট হচ্ছে। দু-সপ্তাহ আগে একজন মহিলা অ্যাকসিডেন্ট হয়ে মারা গেছেন। তিনি সকালে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন, হাজিরতনের মহিলা। এই রোডের ওপর ইট বালি স্টোন চিপ বিক্রি করে। রাস্তা এনক্রোচ করে ওরা ব্যবসা করে, তার জন্য অনেক সময় গাড়ি ঘুরে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে। একটা ফুটপাত ছিল, সেটা অনেকে দখল করে ব্যবসা করছে। ইরিগেশন ক্যানালের ধারে এপার-ওপারে যারা আছে, সবাই একটা করে ফ্ল্যাট পেয়েছে শম্পামির্জা নগরে। যখন ফ্ল্যাট দেওয়া হল, যতগুলো দোকান ছিল সবাইকে দেওয়া হয়েছে। দোকানগুলো তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আবার সেই জায়গাটা এনক্রোচমেন্ট করা হয়েছে। তার জন্য রাস্তা সরু হয়ে যাচ্ছে। একটা দোকান করেছ, তার সামনে একটা বেঞ্চ ফেলেছ। এগুলো তুলতে হবে। ঘটনা হচ্ছে এই। কোনো লুঠ হয়নি। কোনো পুলিশের লাঠিচার্জ হয়নি। পুলিশ কাউকে অ্যারেস্ট করেনি।
তারপর আমরা ঘোষপাড়ার ওখানে একটা বেঞ্চ ফেলে তার ওপরে — অ্যাডিশনাল এসপি সাহেব ছিলেন, ডিএসপি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল ছিলেন, খালেক সাহেব ছিলেন, আমি ছিলাম। আমরা ওখানে মানুষকে বুঝিয়ে বললাম, এখানে প্রশাসন থেকে ১৪৪ ধারা জারি করেছে, আপনারা এখান থেকে সরে যান। পুলিশ ছোটো মাইক নিয়ে এসেছিল, তাতে আমরা বারবার অনুরোধ করে, সকলকে সরিয়ে দিলাম। তারপর আমরা ওখানে বেঞ্চ নিয়ে বসলাম। তখন বেলা একটা। এমএলএ মমতাজ বেগম এসেছিলেন।
আমি একজন প্রাক্তন কাউন্সিলার, আমার কি এক হাজার হাত যে আমি এক হাজার ছেলেকে সামলে নেব? আমার আঙুলে চোট লেগেছে। আমি কারও লাঠি কাড়তে গিয়ে, কাউকে ঘাড় ধাক্কা দিচ্ছি, আমি সেইভাবে তো মারতে পারব না, তাহলে তো পাবলিক আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি সওয়া দুটো পর্যন্ত ওখানে থাকলাম।
আহত (গৌতম শর্মা) ও নিহত (কালামউল্লা হালদার)-এর পরিবার দরখাস্ত করলে কিছু ক্ষতিপূরণ পেতে পারে পুরসভা থেকে। …
এব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারি না
মধুসূদন নাথ, আইসি, রবীন্দ্রনগর থানা
আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের একটা সিস্টেম আছে। একজন অফিসার হিসেবে আমি কাউকে এব্যাপারে কিছু বলতে পারি না। যা কিছু বলবার আমার উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বলবেন আলিপুর থেকে। এসপি আছেন, অ্যাডিশনাল এসপি ওয়েস্ট আছেন। ওখানে গিয়ে দেখা করলে ওঁরা বলবেন।
ইতিমধ্যে দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের সমিতিগুলি আলিপুরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এসপি এবং এসডিও-র কাছে গণস্বাক্ষর সহ স্মারকলিপি পেশ করেছে। সেই স্মারকলিপিতে তারা দুর্ঘটনা পরবর্তী ভাঙচুরের এই ঘটনার জন্য সরাসরি মহেশতলা পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের পৌরপিতা হাজি আবু তালেব মোল্লা, সৈয়দ মুজতবা আলি এবং রবীন্দ্রনগর থানার বড়োবাবু (আইসি) মধুসূদন নাথকে দায়ী করেছে। আইনানুগ পদক্ষেপের জন্য এলাকার নাগরিক সমাজ অধীর আগ্রহে প্রশাসনের শুভবুদ্ধির অপেক্ষায় রয়েছে। কালামউল্লা হালদারের অকালমৃত্যু দুঃখজনক। গৌতম শর্মা মাথায় আঘাত পেয়ে চিকিৎসাধীন। কিন্তু দুর্ঘটনার জের ধরে এইধরনের দাঙ্গা-হাঙ্গামা অবশ্যই নিন্দনীয়।
Leave a Reply