রত্নাকর সাহু, গ্রাম কুন্ত সামালাহি, বোলাঙ্গির, উড়িষ্যা, ২৫ ফেব্রুয়ারি#
আমি একজন চাষি, খেতিবাড়ি করি। বছরে একবার বর্ষার সময় ধান চাষ করি। নিজেদের খাওয়ার মতো ফল, যেমন আম, কমলা লেবু, কলা এসবও করি। আমার পাটকপুরা কলা খেতে খুব ভালো। সাড়ে চোদ্দো থেকে পনেরো একর জমি আছে আমার। আমি জহ্নিজরি দেশি বীজের ধান চাষ করি। পাঁচ বছর আগে বড়গড় জেলা থেকে আমি এটা সংগ্রহ করেছিলাম। এই ধানের চাল খুব সুস্বাদু। একর প্রতি ২৪-২৫ বস্তা ধান হয়, বস্তায় ৭৫ কেজি আঁটে।
আগে খোরাকির পর আমার ধান কিছু বাঁচত, যেটা আমি বেচে দিতাম। আমার চার ছেলে। ওদের আমি এখন জমি ভাগ করে দিয়েছি। যার বেশি হয়, সে বেচে। আমার ধানের জমির মাঝখানের ফালিটায় আমি ফলের বাগান করেছি।
আমার জমিতে পোকামাকড় কম হয়। আমি পোকার জন্য নিম, করণ ইত্যাদির পাতার সঙ্গে গোমূত্র মিলিয়ে প্রসেসিং করে জমিতে দিই। দেশি গাইয়ের পনেরো লিটার মূত্র, ২০-৩০ কেজি গোবর, ১ কেজি গুড়, ১ কেজি বেসন, সার বা বিষ নেই এমন ১ কেজি ভালো মাটির সঙ্গে ২০০ লিটার জল মিশিয়ে দশ দিন ছায়াতে রেখে দিই। তারপর আমি সেটা ব্যবহার করি। ১ একর জমিতে দুই ড্রাম হলেই যথেষ্ট। এতে ফসলের ফলনটা ভালো হয়।
আমার নিজের দেশি গাই আছে। একটা গরু আর দুটো বকরি আছে। লোক পাওয়া যায় না, বেশি গরু রাখাও মুশকিল। এখন সবাই জার্সি গরু রাখে, দেশি গাই খুব কম লোকেই রাখে। জার্সি তো কোনো গরুই নয়। ও হল গ্রাইন্ডার মেশিনের মতো! ওকে যত খাওয়াবে, ততই দেবে! আমি শুনেছি, গুজরাতে গির নামক গরুর যা দুধ হয়, তা গিনিস বুকে রেকর্ড হয়েছে। কেন আমরা জার্সি গরুর পিছনে পড়ে রয়েছি? আমার জমিতে দুটো জিনিস নিষিদ্ধ। এক, জার্সি গরু আর দুই, ডিপ টিউবওয়েল। মাটি খুঁড়ে বড়ো বড়ো কুয়ো তৈরি করে জল পাওয়া যায়। তবে আমার খেতে এক মাসের জন্য জলের অভাব হয়। কী করব? কিছু গাছপালা মরেও যায়।
সেইজন্য আমি গাছ লাগাই। সেই ১৯৫৫ সাল থেকে লাগিয়ে আসছি। এটাই আমার ধর্ম। বৃক্ষ আমার ভগবান। সারা উড়িষ্যার মধ্যে আমার বিখ্যাত গোলাপের নার্সারি ছিল। এখন আর নেই। জলের অভাবে গাছ মরে যেত। একবছর বেশ ক্ষতি হয়ে গেল। এখন আমি হলদি লাগাই। এতে লাভ হয়। জুন মাসে লাগিয়ে দিই। এখন ফলন পেয়ে যাই।
চাষ করে পুরো সংসার চলে না। একটা ছোটো দোকানও আছে। বড়ো ছেলে আমার সঙ্গে চাষে লেগে আছে। তার তিনটে ছেলে স্কুলে পড়ে। আমি গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে থাকি একটা বাগিচায়, তার নাম হল তপোবন।
এক মাস পরে আমার বয়স হবে আশি। আমার স্ত্রীর বয়স ছিয়াত্তর। প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকি, রাসায়নিক সার বা বিষ ব্যবহার করি না। আমার সেরকম বেশি ওষুধপত্র লাগে না। সামান্য আয়ুর্বেদের সাহায্য নিই। অবিভক্ত কটক জেলায় আমার ঘর ছিল। ঘরের চারপাশে দুই একর জমিতে ঝাড় আর জরিবুটি লাগানো ছিল। আমার মা সেগুলোর দেখভাল করতেন। মায়ের কাছ থেকে শিশুকালেই শিখেছি। পরে পাটনাগড়ে হাইস্কুলে পড়তে গেলাম। সেখানে রামমূর্তি পাত্র বলে একজনের একটা ছোটো বাগান ছিল। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। আমি রোজ সেই বাগানে যেতাম। ওঁর কাছ থেকে অনেক জ্ঞান পেয়েছি। চাষ শিখেছি বাবার কাছে। জঙ্গল, পশুপালন, উদ্যান — এই তিনটে না বুঝলে চাষে কেউ সফল হতে পারে না।
Leave a Reply