কামরুজ্জামান খান, বাঙালোর, ১৪ জুলাই#
বাঙালোর শহরে এত গরু গাধা আর ঘোড়ার গাড়ি চলে যে ভাবাই যায় না আমরা জেট যুগে বাস করছি। বিশেষত গরুর গাড়ি, তাও বাঙালোরের মতো শহরে! এখানে প্রচুর গরু ঘুরে বেড়ায়, বিশেষ করে বাজার এলাকায়, হোলসেল সবজি মার্কেটে, জঞ্জাল ফেলার এলাকায় এবং খাবারের দোকানের আশেপাশে। সবজি বাজারে এরা ভিড় জমায়। এখানে প্রচুর পরিমাণে টমেটো, বেগুন, মূলো এবং নানা ধরনের ফেলে দেওয়া সবজি এরা মহানন্দে খায় আর প্রচুর মল মূত্র ত্যাগ করে এলাকাকে নোংরা করে রাখে।
আমাদের ওখানকার মতো ছোটো গরু নয় এরা। সব জার্সি গরু। অনেক বড়ো হয়। হাতির মতো চেহারা এদের। সারা রাত সারা দিন এরা ঘুরে বেড়ায়। গরুদের এখানকার হিন্দুরা অনেক খাতির যত্ন করে। যেমন, এখানে প্রতিটা দোকান খোলে দশটার সময়। সেই সময় কোনো গরু যদি দোকানের সাটারের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে দোকান খোলার পর মালিক একটা গামলাতে করে গরুটাকে অনেক রুটি কলা আরও বিভিন্ন জিনিস খেতে দেয়। গরু সেটাকে মহানন্দে খায়। তারপর মালিক গরুটাকে ছুঁয়ে প্রণাম করে, তারপর দোকানদারি শুরু করে।
আমি একদিন সকালে দেখি, কিছু লোক অনেক রুটি কলা কিনে রাস্তার গরুদের খাওয়াচ্ছে বাসস্ট্যান্ডের কাছে। কিন্তু কিছু দূরেই ফুটপাথে দুটি মহিলা ও দুটি বাচ্চা থাকে অনেকদিন ধরে, তাদের অবস্থা জীর্ন শীর্ণ, তাদেরকে কিন্তু কেউ কিছু খাবার দেয় না। আমি অনেকদিন ওদের দেখছি। ওই অবস্থাতেই ওরা দিন রাত কাটায় ওখানে।
এতো গেল গাই গরুদের কথা। আর বেচারা বলদ গরুরা নাজেহাল। ভোর থেকেই এরা গাড়ি টানতে ব্যস্ত। আমাদের ওখানকার বাচ্চাহাতি গাড়িগুলোর মতো এখানকার গরুতে টানা গাড়ির ডালাগুলো। একটা গরুর কাঁধে জোয়াল দিয়ে চারটে চাকা লাগানো। খোলা ডালা বডির গাড়ির ওপর এত মাল চাপানো হয়, যা মনে হয় প্রায় তিন চার টন হবে।
গরুর গাড়ি মূলত কাঁচা সবজি, হোলসেল ভূসিমালের মালপত্র, অ্যালুমিনিয়ামের চ্যানেল, লোহালক্কড় এবং বিভিন্ন ভারী ভারী জিনিসপত্র বওয়ার কাজ করে। একটা গাড়িওয়ালার সাথে কথা হচ্ছিল। সে কুড়ি কিলোমিটার দূর থেকে আসে সবজি নিয়ে এবং প্রায় প্রতিদিন আসে। আমি বললাম, গরুর কোনো অসুবিধা হয় না? সে বলল, গরু তো ভালোই থাকে। খায় দায় আরামে থাকে। সকালেই তো মাল বইতে হয়। আর সারা বিকেল আর রাত তো শুধু খায়। রেস্ট নেয়।
আমি আর আমার শরু ভাই বাদল মিলে যাচ্ছিলাম লোহাপট্টির ভেতর দিয়ে। দেখি একটা গরুর গাড়িতে এত লোহার পাত চাপিয়েছে যে, গরু আর টানতে পারছে না গাড়িটাকে। গাড়িতে আবার দুটো লোক বসে আছে। গরুটা বেঁকে গেলে তার ওপর চলল সজোরে চাবুকের ওপর চাবুক। গরুটার নাক মুখ দিয়ে লালা বেরুতে লাগল, বেঁকে গেল ঘাড়টা। পাগুলো স্লিপ করছে, এগোতে পারছে না। রেহাই নেই। একজন গরুর গাড়ি থেকে নেমে জোয়ালটাকে ধরল, আর একজন চাবুক চালাতে থাকল। গরু লাফাতে লাগল, গাড়ি চলতে লাগল।
এমনই গাধা আর ঘোড়ার গাড়িও মাল বয়েই চলেছে প্রতি নিয়ত। মনে হয় না বাঙালোর একটা হাইটেক শহর — যেন টিপু সুলতানের সেই পুরোনো শহর, টিপু সুলতানের ফোর্ট, টিপু সুলতানের প্যালেসের সঙ্গে আজও আছে গরু, গাধা, আর ঘোড়ার গাড়ি — এই বাঙালোরে।
আমাকে একজন পথচারী বলল, এটা ওল্ড বাঙালোর, কলকাতার মতো। যদি নতুন বাঙালোর দেখতে চাও, তাহলে চলে যাও ইলেকট্রনিক্স সিটি। ওহি হ্যায় নিউ বাঙালোর, হাইটেক বাঙালোর।
Leave a Reply