তমাল ভৌমিক, ভবানীপুর, ৮ মে#
নেতাজী ভবন মেট্রো স্টেশনের ট্রেন ধরব বলে দাঁড়িয়ে আছই। ট্রেন ঢোকার মুখে একটা মেয়ে দুহাত তুলে লাফাতে আরম্ভ করল, ‘এয়ার কন্ডিশনড এয়ার কন্ডিশনড ‘। তার সঙ্গী ছেলেটা হাসছে। এসি ট্রেন আসছে। এদেরকে দেখে মনে হয় মণিপুরি। না হলেও উত্তর–পূর্বাঞ্চলের কোন রাজ্যের তো বটেই। ফরসা মুখ আর ল্যাপাপোঁছা নাক–চোখ দেখে যাদেরকে আমরা সাধারণত ‘নেপালি‘ বলে থাকি সেরকম দুজন।
এরা না হয় পাহাড়ি এলাকার মানুষ – সমতলের বৈশাখী রোদের প্রখর তাপে নাজেহাল। কিন্তু এখানকার মানুষরাও তো দেখছি পটাপট এসি বা এয়ারকন্ডিশনিং মেশিন লাগিয়ে ফেলছে। শ্যামবাজারে আমাদের ছাত্রীরা থাকে ভাড়া বাড়িতে। জ্যাঠা–ঠাকুমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে তাদের সাকুল্যে একখানাই ঘর। ওই ঘরেই তিনজনের খাওয়া শোয়া পড়াশুনা টিভি দেখা – সব। সেই ঘরে একটা এসি লাগিয়ে ফেলেছে। গড়িয়াতে আমার এক বন্ধু একখানা আর এক আত্মীয় দু ঘরে দুখানা এসি লাগিয়েছে। এরা সকলেই কিন্তু মধ্যবিত্ত — স্কুলকলেজ– অফিসে চাকরি করে। আগেকার মধ্যবিত্তদের ফ্যানের জায়গা নিয়ে ফেলছে আজকের এসি। জায়গা নিয়ে ফেলছে ঘরের মধ্যে যত না মনের মধ্যে আরও বেশি। আমার এক ছাত্রীর কাছে একটা ঘটনা শুনে সেরকমই মনে হল।
ছাত্রী পড়ে দক্ষিণের এক ঐতিহ্যবাহী মিশনারি স্কুলে। সেখানে সব ক্লাসরুমে এসি লাগানো আছে। ছাত্রীর ক্লাসে একজন টিচার এক ‘দুষ্টু–ছাত্রী‘কে পিছনের বেঞ্চ থেকে সামনে আসতে বলায় সে জানায় যে তার জ্বর হয়েছে, সামনের দিকে এসি লাগানো আছে বলে সেদিকে বেশি ঠাণ্ডা, টাই সে সামনে বসতে চায় না। টিচার টাকে সামনের বেঞ্চে জোর করে বসালে ছাত্রীটি এসি বন্ধ করে দেওয়ার অনুরোধ করে। টাতে শিক্ষিকা জানান যে তাঁর খুব গরম লাগছে এবং ওই একটি ছাত্রীর জন্য তিনি এসি বন্ধ করতে পারবেন না। ফলত; এসি চালু থাকে এবং এর ফলে ওই ছাত্রীটির কিছু না হলেও আমার ছাত্রীটির ঠাণ্ডা লেগে গেছে।
এই গরমে এসির ঠাণ্ডা কেন ফ্যানের হাওয়া লাগারও যার চান্স নেই তেমন একজনের কথা শুনলাম আমার এক মাস্টারমশাইয়ের কাছে। মাস্টারমশাই রিক্সায় চেপেছিলেন দুপুরবেলায় আর প্রচণ্ড রোদ্দুর দেখে সাইকেলরিকশা চালককে বলেছিলেন, ‘আমার ছাতাটা একটু মাথায় দেবেন নাকি?’ সেখানও থেকে কাহিনীর শুরু। রিকশাওয়ালা বলেন যে তিনি ছাতা বা টুপি মাথায় দিয়ে রিক্সা চালান না, অভ্যেস খারাপ হওয়ার ভয়ে। শুধু প্রতি খেপ রিক্সা টানার পরে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটু ঘাম শুকিয়ে নেন এবং টাতেই বেশ থাকেন। তিনি আরও বলেন যে জয়নগরের থেকে শহরতলিতে এসে যেখানে তাঁর ডেরা সেখানে ইলেকট্রিক ফ্যানও তাঁর নেই। প্রথম রাতে গরমে ঘুমের একটু কষ্ট হয়, কিছুটা হাতপাখা নেরে সময় কাটানোর পরে বাইরে থেকে একটা হাওয়া আসে, টাতেই ঘামে ভেজা গা তাঁদের শীতল হয়, তখন তাঁরা ঘুমিয়ে পরেন।
শুনে আমি মাস্টারমশাইকে বললাম, প্রায় একই রকমের বর্ণনা আমাদের কাজের মেয়ের থেকে শুনেছি। ওরা থাকে আরও দক্ষিণে। রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ, মানে এসিবির এলাকায়। সেখানে ইলেকট্রিক থেকেও থাকে না। ফলে তার ঘরে ভাড়া করা ফ্যান প্রায় প্রতিরাতে অনেকক্ষণ বন্ধ থাকে। ঘরে হাওয়া ঢোকে না, গুমোট। তখন বাইরে বারান্দায় গিয়ে শুয়ে হাওয়া পেতে হয়। পেতে হয় মানে পেতেই হয়। না হলে ভোররাতে উঠে আবার কাজও করতে ছুটবে কী করে?
Leave a Reply