২৬ জানুয়ারি, নিজামউদ্দিন আহমেদ, কানখুলি, মহেশতলা#
হিন্দু তীর্থযাত্রীদের মুসলিম গাইড
ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে গঙ্গাসাগরে পুণ্যস্নানের উদ্দেশ্যে ৪৮ জনের একটা দল নিজস্ব বাস ভাড়া করে এসেছে। তাদের দায়িত্বে রয়েছেন ইয়াকুব আনসারি এবং মহঃ আলম নামে দুই যুবক। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করে ছোটো মনের ছোটো প্রশ্নটাই করে ফেললাম — ‘তোমরা তো মুসলিম, তাহলে …?’ প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই ওঁদের উত্তর চলে এল, ‘হিন্দু-মুসলিম বুঝি না ভাইয়া। ব্যবসার কাজে আমাদের দুজনকে নিয়মিত কলকাতার বড়বাজার আর পার্কসার্কাসে আসতে হয়। আমাদের গ্রামের কেউ কখনও কলকাতায় আসেনি। তাই আমাদেরই গঙ্গাসাগর ঘুরিয়ে আনার দায়িত্ব এরা দিয়েছে।’ আরও জানলাম ইয়াকুব আর আলমের কাছ থেকে। ওঁদেরই গ্রাম থেকে আর একদল মানুষ গিয়েছিল রাজস্থানের আজমীর শরীফে। সেই যাত্রার গাইড হয়েছিলেন ওই গ্রামেরই বিষ্ণু, রামপ্রসাদ আর বিরজু। কারণ ওই তিনজনই কর্মসূত্রে আজমীরের হাল-হকিকত জানেন। শুনে অবাক হলাম বটে, কিন্তু ভালোও লাগল। প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি না পেরোনো দুই যুবকের সোজাসাপটা কথায় আমার প্রথাগত ভাবনাগুলো গুলিয়ে যায়। আমি তাকিয়ে থাকি সূর্যাস্তের আগের পশ্চিমতটের দিকে, যেখানে গঙ্গা মিলেছে সাগরের সঙ্গে।
গঙ্গাসাগর ইজ মাচ ক্লিনার দ্যান কুম্ভ
জাপানের শিল্পশহর কোবে থেকে সাগরমেলায় এসেছেন বছর পঞ্চাশের শিনজি কাগুচা। নেশায় ফোটোগ্রাফার শিনজি আলাপচারিতায় জানালেন, ভারত, ভারতের লোকজন আর ভারতের মেলাগুলো তাঁকে ভীষণভাবে টানে। সেই টানে দেদার ছবি তুলছিলেন তিনি। অবশ্য তার বেশিরভাগ নাগা সন্ন্যাসীদের। নাগা সন্ন্যাসীদের ছবির একটা প্রদর্শনী করার ইচ্ছা জানালেন। এর আগে তিনবার কুম্ভমেলায় যোগ দিলেও গঙ্গাসাগরে তিনি এই প্রথম। এক নাগা সন্ন্যাসীর কাছ থেকে গাঁজা চেয়ে নিয়ে সুখটান দিতে গিয়ে কেশে একাকার শিনজি। নাগাবাবা ভালো করে টিপ্স দিলেন — কখন ধোঁয়া টেনে, কতক্ষণ রেখে, কত সেকেন্ড পরে ধোঁয়া ছাড়তে হয়, ইত্যাদি। এই প্রশিক্ষণের মাঝে পড়ে দোভাষির কাজ করতে গিয়ে আমার লাভ হল। মুফতে এক্কেবারে হিমালয়ের নাগাবাবার কাছ থেকে গাঁজা খাওয়ার ট্রেনিংটা হয়ে গেল!
শিনজিকে প্রশ্ন করলাম, কুম্ভ আর গঙ্গাসাগরের মধ্যে পার্থক্যটা কী? পার্থক্যের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই জানালেন, কুম্ভতে নাগা সন্ন্যাসির পাশাপাশি পুণ্যার্থীর সংখ্যাও অনেক বেশি থাকে। আর শেষ কথাটা শুনে বঙ্গবাসী হিসেবে আমার ভালো লাগল — গঙ্গাসাগর ইজ মাচ ক্লিনার দ্যান কুম্ভ। যাক! বিদেশির কাছ থেকে গঙ্গাসাগরের পরিচ্ছন্নতার একটা সার্টিফিকেট পাওয়া গেল!
গঙ্গাসাগরই পরান গোস্বামীর ভরসা
ফলতার পরান গোস্বামীর মনটা ভালো নেই। অভিমানে তাঁর গলা বুজে আসছে। ধর্মের নামে অধর্ম আর সইতে পারছেন না তিনি। এত বেশি মনঃকষ্ট হচ্ছে, হয়তো সামনের বছর থেকে আর গঙ্গাসাগরে আসবেনই না। কারণ? পরানরা তিন পুরুষ ধরে সাগরমেলায় ভ্রাম্যমান পুরোহিতের কাজ করে আসছেন। অর্থাৎ মন্দির চত্বরে না গিয়ে সমুদ্রতটেই পূজা, যজ্ঞ ইত্যাদি করেন তাঁরা। কিন্তু তাঁর অভিযোগ — এখন অনেক জাল পুরোহিতে ভরে গেছে গঙ্গাসাগর। পুণ্যার্থীরা প্রতারিত হচ্ছে আর সেধে পয়সা খরচ করে নরকে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে! তবে পরানের সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ কপিলমুনি মন্দিরের রেজিস্টার্ড পুরোহিতদের ওপর। তারা নাকি এখন কেউ তৃণমূল, কেউ সিপিএম বা কংগ্রেসের ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত। এই রেজিস্টার্ড পুরোহিতরা পুণ্যার্থীদের পরানের মতো ভ্রাম্যমান পুরোহিতদের কাছে যেতে দেয় না। এবার রোজগার কেমন হল? পরান গোস্বামী জানালেন — ‘বেশ খারাপ’। গতবার মেলার পাঁচদিনে তাঁর প্রায় ১২ হাজার টাকা রোজগার হয়েছিল। এবার তার অর্ধেকও হয়নি। তিনি আরও জানালেন, এবার ওড়িয়া পুরোহিতের সংখ্যাও অনেক বেশি। উড়িষ্যা থেকে আসা পুণ্যার্থীরা দেশোয়ালি পুরোহিতদের ওপরেই বেশি ভরসা রাখে।
সারা বছর কখনও খেতমজুরি, কখনও ঘুগনি বিক্রি করেন পরান। জিজ্ঞাসা করলাম, বছরের অন্য সময়ে এলাকায় পূজা করেন না কেন? শুনেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন তিনি — ‘জানেনই তো, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না।’ অগত্যা গঙ্গাসাগরই পরানের ভরসা।
মায়েরা তো এরকমই হয়
১৫ জানুয়ারি সকাল প্রায় দশটা। গঙ্গাসাগর মেলা প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র জেলাশাসকের মেলা অফিসে তখন ব্যস্ততা তুঙ্গে। জেলার আধিকারিকদের দম ফেলার সময় নেই। সেই সময় হঠাৎ ঝড়ের গতিতে ২৫-৩০ বছর বয়সি এক মহিলা সেই অফিসে প্রবেশ করলেন। পায়ের জুতো কোথাও পড়ে গেছে, পরনের পোশাক অবিন্যস্ত। মহিলা যাকেই সামনে পাচ্ছেন পায়ে ধরছেন আর বলছেন ‘আমাকে বাঁচাও’। উপস্থিত সকলে হতভম্ব। আস্তে আস্তে মহিলার সঙ্গী অপর মহিলা জানালেন, ওঁর বাচ্চা মেয়ে দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে। তা দেখে অস্থায়ী হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এক্ষুণি মেয়েটিকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা না করালে বাঁচানো যাবে না। সেজন্য একমাত্র পথ হল, হেলিকপ্টারে করে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া। কারণ সড়কপথে নিয়ে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। এই অনুরোধ নিয়েই মন্দিরবাজারের বাসিন্দা টুম্পা মণ্ডলের ওই আকুতি। জেলাশাসক শান্তনু বসু সবেমাত্র মেলা অফিস ছেড়ে চলে গেছেন। তখন অন্য যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সবাই মহিলাকে সান্ত্বনা দিলেন, ‘ঠিক আছে, দেখছি’। কিন্তু গ্রাম্য মেয়ে টুম্পার একটাই কথা — ‘বাবুরা তোমরা হেলিকপ্টারে করে আমার মেয়েকে কলকাতায় নে যাও, ওকে ছাড়া আমি বাঁচবুনি।’ সেই সঙ্গে হাতে-পায়ে ধরা আর বুক চাপড়ানি চলছিলই।
অগত্যা জেলাশাসককে জানানো হল। হেলিকপ্টারের ব্যবস্থাও হল। একজন মন্তব্য করলেন, ভদ্রভাবে আবেদন-নিবেদন জানালে কেউ ওর কথায় কর্ণপাত করত না। আর এক বৃদ্ধা মন্তব্য করলেন, ‘মায়েরা তো এরকমই হয়’।
Leave a Reply