১৬ ডিসেম্বর বিশেষ কারণেই যেতে হয়েছিল পার্ক স্ট্রীট। ফেরার পথে মাদার টেরিজা সরণি ধরে হেঁটে যখন জহরলাল নেহরু রোডে পড়লাম, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। যাব লেনিন সরণী। জওহরলাল নেহরু সরণীর বাঁদিকের অপেক্ষাকৃত কম জনবহুল দিকটি দিয়ে হাঁটছি। চৌরঙ্গী ফ্লাইওভারের এদিকটায় আলো-আঁধারি খেলা করে। একটু এগোতেই বাঁদিকের প্রাচীরের ওপর থেকে কতগুলি মুখ চোখে পড়ল। চোখের কটাক্ষে ওরা প্রাণপণ ডাকছে। বুঝলাম ওরা দেহোপজীবী। আরও এগোতেই নজরে এল দু-একজন প্রাচীর ডিঙিয়ে ওই ইশারা লক্ষ্য করে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ওপরের ফ্লাইওভারের চলন্ত গাড়ির শব্দের মধ্যেও ওপাশ থেকে ঝোপ-ঝাড় ভেঙে চলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আরেকটু এগোতেই ফিসফিস গলা শুনতে পেলাম, ‘কুড়ি টাকা দেব, ভেতরে চলো।’ জবাব, ‘কুড়ি না পঞ্চাশ’।
গতিটা কমিয়ে দিলাম। ধীরে ধীরে এগোতেই দেখলাম সরু ফুটপাথের ওপর দু-জন দাঁড়িয়ে। কোনো নারী নয়। দুজনেই পুরুষ। হালকা-পাতলা চেহারার ছেলেটার বয়স ত্রিশের কম। কিন্তু নাছোড়। ‘পঞ্চাশ’ না হলে যাবে না। ওর মুখোমুখি দাঁড়ানো মাঝারি উচ্চতার আর একটা ছেলে। বোঝাই যাচ্ছিল, ওর বয়স-ও ত্রিশ ছোঁয়নি। কাছে এগিয়ে আসতে দু-জন থমকে গেল।
বললাম, কী হয়েছে? প্রথম উত্তর দিল পাতলা গড়নের ছেলেটি, ‘কিছু না। ও না বুঝতে চাইছে না।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী? ছেলেটি বলল, ‘বল কুড়ি টাকায় এখন কিছু হয়?’ আমি মাথা নেড়ে না জানালাম। ওর পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি গজ গজ করে চলতে শুরু করল, ‘কুড়ি হলে চল, নাহলে ভাগ। কাজ আছে, চললাম।’ সত্যি ও সড়কে গেল। ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
— তুমি যাবে?
— কোথায়?
— না, এখানে না চাইলে থাক। তোমার জায়গা আছে?
— না।
— আমার জায়গা আছে। তবে টাকা লাগবে। আমি অন্যদের মতো না। অন্যেরা পরে টাকা চায়। আমি আগেই বলে দিই।
— তা ভালো। তোমার কোথায় জায়গা? কত লাগবে বলো তো?
— রাসবিহারীতে এসো। ওখানে আমার এক বন্ধুবাড়ি আছে। ওর বাবা মা সবসময় থাকে না। ওকে দেড়শো টাকা দিলেই হবে। আর আমারটাও আছে।
— তোমাকে কত দিতে হবে?
— সে দিও। আমায় আগে ফোন করে দিও। আমি চলে যাব।
— কেন তাও তো বলো তোমার …
— একশো টাকা দিও। বেশি হল?
— না না কেন, তা দেওয়া যাবে।
— তুমি কী করো?
— তেমন কিছু না। একটু খবরের কাগজ-টাগজে লিখি।
— (হেসে) আমার ছবি ছেপে দিও না কিন্তু।
— না না। সে ভয় নেই। আমার খুব খিদে পেয়েছে। চলো খেতে খেতে কথা বলা যাক।
— না না, আমি যাব না।
— কেন যাবে না?
— তোমার সঙ্গে প্রথম আলাপ। না না …
— কোনো ব্যাপার না, চলো।
— ঠিক আছে।
জওহরলাল নেহরু রোডের ফুটপাথ ধরে চৌরঙ্গীর দিকে হাঁটছি। কথা বলছে ছেলেটি।
— তুমি কোথায় থাকো?
— বারাসাতের ওদিকে। তুমি?
— বারাসাত অনেক দূর। আমি পার্ক সার্কাসে থাকি। মাঝে মাঝে বারাসাতেও যাই। হাওড়া যাই। আমার কাস্টমার আছে। (লজ্জা পেয়ে) না, মানে বন্ধুরা থাকে। ডাকে, তাই যাই।
— এখানে তুমি রোজ আসো?
— না না সপ্তাহে দু-তিনদিন আসি। কখনও বেশি আসি। আসলে এখানে পুলিশ ধরে নিয়ে খুব মারে। কয়েকদিন আগে একজনকে মেরে পা ভেঙে দিয়েছে। ভয় করে। এখন ফোনে ফোনেই যোগাযোগ হয়ে যায়। তাছাড়া ফেসবুক আছে।
— তুমি কি এটাই করো, না অন্য কিছু?
— আমি দরজির কাজ করি। সময় পেলে এখানে আসি।
— তুমি যে এসব করো, তোমার বাড়িতে জানে?
— না না। এসব কেউ বলে?
— এসব কিছু করছ তা ভালো! কিন্তু বিয়ে থা করবে না?
— না, আমি পারব না। তাই বিয়ে করব না।
— বাড়ি থেকে জোর করলে কী করবে?
— তখন ‘না’ বলব। আর তখনেরটা তখন দেখা যাবে।
হাঁটতে হাঁটতে চৌরঙ্গি পেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে থামি। দুটো চিকেন রোল অর্ডাড় দেই। ছেলেটিকে ডেকে বসাই। ছেলেটি চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে,
— আমার খিদে পেয়েছিল বুঝলে কী করে? মুখটা শুকনো লাগছে, না?
— (সত্যি বুঝতে পারিনি) না, মনে হল।
— বাড়ি থেকে বিকেল বেলা দুটো বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছি। আর খাওয়া হয়নি। ওই আজ প্রথম ছিল। হল না।
— আমি তোমার ক্ষতি করে দিলাম না তো।
— না না। ওইটা শয়তান। ভালো হল। কিছু খেতে দিত না। এমন লোক রোজ আসে।
— (অপ্রস্তুত বোধ করে) ঠিক আছে, চলো। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। তোমার তো ক্ষতি করে দিলাম, আজ তো একজনও হল না। তার ওপর এভাবে লেট করিয়ে দিলাম।
— না না। আমি ভালো না লাগলে সবার সঙ্গে করি না।
— তোমার নাম কী?
— সূরয। আমি কিন্তু মহামেডান।
— আছা ট্রাম ডিপোর ওদিকটা দিয়ে হেঁটে আসি চলো। … তোমার নাম সূরয আমার বিশ্বাস হল না।
— সত্যি আমার নাম সূরয।
— ঠিক আছে। তুমি বললে, সবার সাথে করো না। কিন্তু যারা সোনাগাছি বা বৌবাজার থাকে, তারা তো টাকা দিলেই করতে দেয়। ভালো মন্দ, সুন্দর কুৎসিত বিচার করে না।
— আমি ওদের মতো বেশ্যা নাকি?
— তুমিও তো টাকা নাও। তাহলে?
— হ্যাঁ। এখন নিই। দু-বছর ধরে নিই। আগে নিতাম না। আগে তো ছোটো ছিলাম। সব পারতাম না। লাগত। এখন পারি। আচ্ছা আমাকে দেখলে বোঝা যায়?
— হ্যাঁ।
— মোটেও না। আমি হাঁটলে পেছন দিক থেকে বোঝা যায়।
— আমার তো সবদিক থেকেই মনে হয়েছে, তুমি অন্য রকম। … আচ্ছা তুমি কতদূর পড়াশুনা করেছ?
— ক্লাস নাইন। … তারপর আর পড়িনি। ভালো লাগত না।
— তুমি কতদিন ধরে এই লাইনে আছ?
— তাও ষোলো সতেরো বছর।
— এতদিন! কী করে এপথে এলে? কীভাবে বুঝলে তুমি অন্যরকম?
— আট নয় বছর বয়সে আমার জ্যেঠতুতো দাদা একা থাকলেই ডেকে নিয়ে যেত। ওর ওখানে হাত দেওয়াত। আমার ভালো লাগত। আরও সব কিছু করাত। আমাকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে ঘুরতে নিয়ে যেত। ওরটা ছুঁয়ে থাকতাম। তখন থেকেই বুঝতাম, এটা আমার ভালো লাগে। ছেলেদের দিকে তাকাতাম। ছেলেদের খুঁজতাম। একদিন বাইরের একজনকে পেলাম। তারপর আরেকজন এল। এই তার পর থেকে …
— ও! এ জন্য তোমার পড়াশুনা হল না।
— হ্যাঁ, একদম মন বসত না।
— এই ধরনের সম্পর্ক এখনও কতজনের সঙ্গে করেছ? শ-খানেক হবে?
— ধ্যুৎ। অনেক বেশি। হাজার খানেক।
— বাব্বা। এখন তোমার বয়স কত?
— ছাব্বিশ।
— এখন যে সব রোগ বেরোচ্ছে, ভয় করে না?
— হ্যাঁ করে। কী করব বল? আমি ওটা ছাড়া করতে দিই না!
— আচ্ছা কয়েকদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের একটা রায় বেরিয়েছে জানো তুমি? এসব যে কর সেটা তো এখন অপরাধ!
— শুনেছি। তাতে আমার কী? আমার দূরে দূরে কাস্টমার আছে। সেখানে কী করবে, কে সেটা জানবে?
— হ্যাঁ, তবুও তো!
— ছাড়ো তো!
— আচ্ছা এসব কথা যদি কখনও লিখি?
— সে তোমার ব্যাপার। তবে ছবি দিও না কিন্তু।
— বেশ রাত হল। আমাকে ফিরতে হবে। তুমিও তো এখনও কিছু করনি। যাও দেখো। কিছু হয় কি না। আচ্ছা আসি।
— ঠিক আছে। আমি মাঝেমাঝেই এখানে থাকি। কাজ থেকে ফিরে আসি। যোগাযোগ রেখো। এলে দেখা হবে।
আমি মাথা নাড়লাম। তারপর হাঁটতে শুরু করলাম। দু-জনের দুটো পথ দু-দিকে বেঁকে গেল।
আলাপচারী সৈকত মিস্ত্রি, অশোকনগর, উত্তর চব্বিশ পরগনা এবং সূরয, কলকাতা।#
Leave a Reply