দুবরাজপুরের লোবা গ্রামের জমি রক্ষা নিয়ে যখন বড়ো সংবাদপত্র ও টিভি সরগরম, সেই সময় হাতে এল একটা ছোটো পত্রিকা। একাশি বছরের পুরোনো, প্রগতিশীল ও বামপন্থী বলে খ্যাত ‘পরিচয়’ পত্রিকার শারদীয় ১৪১৯ সংখ্যাটি। তার পিছনের মলাটে ‘এমটা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ’-এর এক ঢাউস বিজ্ঞাপন, তাতে লেখা আছে, ‘দ্য পাওয়ার বিহাইন্ড পাওয়ার’ — ক্ষমতার পিছনে ক্ষমতা! হালফিল কাণ্ডকারখানার সঙ্গে মানানসই, খুবই অর্থবহ কথাটা! দুবরাজপুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড়ো মিডিয়া যখন শাসক দল তৃণমূল (এবং কিছুটা সিপিএমের) কাছা ধরে টানাটানিতে ব্যস্ত, তখন এমটা-র বিজ্ঞাপনে ঘোষিত হচ্ছে ক্ষমতার পিছনের ক্ষমতার কথা। ডাকসাইটে রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার পিছনে কর্পোরেট ক্ষমতার সত্য ঘোষিত হচ্ছে — শুধু এমটা-র ওয়েবসাইটেই নয়, প্রগতিশীল বামপন্থী পত্রিকার মলাটেও!
কিন্তু ক্ষমতা কি শুধু ক্ষমতার পিছনেই? ওপরে নিচে ডাইনে বাঁয়ে আরও বিচিত্র ক্ষমতার উঁকিঝুঁকি কি আমরা টের পাই না? দুবরাজপুরে খোলামুখ কয়লা খনির জন্য জমি নেওয়ার ব্যাপারে স্থানীয় গ্রামবাসীরা গত একবছর আগেই সরব হয়েছিল। একথা কি বিশ্বাসযোগ্য যে বড়ো মিডিয়া সেসব জানত না? বিলক্ষণ জানত। কিন্তু যখন মাটি কাটার মেশিন আটকে দেওয়া হল, পুলিশি হস্তক্ষেপ হল, হাওয়া গরম হল। এবার মিডিয়ার নাচনকোঁদন শুরু হল। মনে পড়ে নন্দীগ্রামের দখল আন্দোলনের কথা? আনন্দবাজার প্রথমে হাওয়া বোঝার চেষ্টা করছিল। কিন্তু যখন হাওয়া সত্যিই গরম হল, হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামল, তখন গণতন্ত্রের ধ্বজা হাতে আসরে নেমে পড়ল আনন্দবাজার! এর মধ্যেও একটা ক্ষমতার খেলা রয়েছে। নিজেদের সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেলের প্রচারের ক্ষমতার জোরে জনসাধারণের প্রতিবাদ বা আওয়াজকে ছাপিয়ে রাজনৈতিক দলের তরজাকে বড়ো করে তোলো; সবকিছুকে ভোটের রাজনীতির ময়দানে টেনে নিয়ে এসো; দরকার মতো রাজনৈতিক দাদাদের কখনো ওপরে তোলো, কখনো মাটিতে ফেলে রগড়াও; শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের এসব প্যাঁচপয়জারে দরকার মতো ব্যবহার করো।
এইভাবে আমাদের সাধারণ মানুষের সামনে-পিছনে ডাইনে-বাঁয়ে ওপরে-নিচে ক্ষমতার একটা জাল কাজ করে চলে। সমাজের ক্ষমতাহীন বহু স্বর বহু মত কয়েদ হয়ে থাকে ক্ষমতার এই জেলখানায়।
Leave a Reply