কামরুজ্জামান খান, মেচেদা, ১৬ ফেব্রুয়ারি#
মেদিনীপুর জেলা ঐতিহাসিক দিক থেকে যেমন বিখ্যাত, তেমনি মেদিনীপুর কৃষি-নির্ভর জেলা হওয়ায় এখানকার কৃষির মধ্যে ধান ছাড়া ফুল চাষ, পান চাষ, মাদুরকাঠির চাষের মাধ্যমে ব্যবসায়িক সাফল্য বহুকাল থেকেই সুবিদিত। বিশেষত ফুলের চাষের বিশেষ সুনাম আছে। কোলাঘাট ব্লকের সবচেয়ে পুরোনো ফুলের বাজার দেউলিয়া বাজার আর কোলাঘাট ফুল বাজার বিভিন্ন রকমের ফুল এই দুই বাজার হয়ে কলকাতা, রাঁচি, কটক, ভুবনেশ্বর, নাগপুরের বাজার হয়ে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই এর সাথে জড়িয়ে আছে বহু মানুষের জীবন-জীবিকা ও অঞ্চলের অর্থনীতি।
কোলাঘাট যেমন ইলিশের জন্য বিখ্যাত ছিল, তেমনি বহু যুগ থেকে আজও ফুলের জন্য বিখ্যাত। কোলাঘাটের ফুলের বাজার সেই কবে চালু হয়েছিল তার হদিস পাওয়া যায়নি। তবে ষাটের দশক থেকে বড়ো আকারে ফুল কেনাবেচা শুরু হয় বলে সইদুল ইসলাম জানালেন। তাঁরা তিন পুরুষ ধরে ফুল চাষ করে আসছেন। বর্তমানে সত্তর দশক থেকে কোলাঘাট ডাউন এক নম্বর প্লাটফর্মের সামনের দিকে রেলের ঝিলের ধারে ছোট্ট একটা জায়গায় হোলসেল ফুলের বাজার বসতে শুরু করে পাকাপাকি ভাবে
ফুলের ব্যবহার বিভিন্নভাবে হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। পুজোর জন্য ব্যবহার ছাড়াও ফুল দিয়ে বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠানের সাজসজ্জায়, উপহারে এবং ফুল থেকে আতর, ঔষধ, সুগন্ধি এমনকী তেলও প্রস্তুত করা হয়। ফুলের এই বহুমুখী ব্যবহারের ফলে এর কদর সাধারণের কাছে বাড়তে থাকে। ফুল চাষে বেশ লাভের মুখ দেখতে শুরু করলে চাষিও উৎসাহ নিয়ে ঝুঁকতে শুরু করে ফুল চাষে। দুই মেদিনীপুর সহ হাওড়া জেলাতেও প্রচুর ফুলের চাষ শুরু হল। বাজারে ফুলের রঙ ও সুগন্ধির জন্য চাহিদা বাড়তে লাগল। চাষিরাও ফুল উৎপাদনের সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী কোলঘাট ও দেউলিয়া বাজারকে ব্যবহার করতে শুরু তাদের বেচাকেনার জন্য। বাড়তে থাকে এই দুই ফুলের বাজারের গুরুত্ব, চাষিও কিছুটা অর্থের মুখ দেখতে শুরু করে।
এর পরে পরেই শুরু হয় ফুল চাষের প্রতিযোগিতা। কার ফুল কত ভাল হবে এবং তার দাম বাজারে কত হবে এই নিয়ে চলতে থাকে চাষিদের মধ্যে রকমারি ফুল চাষের প্রতি আগ্রহ। গোলাপ, রজনীগন্ধা, অপরাজিতা, জবা, টগর, দোপাটি, গাঁদা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, বেল, জুঁই, পাতাবাহার সহ বিবিধ ফুলের চাষ চলছে মেদিনীপুরের বিভিন্ন খেতে। হচ্ছে পদ্ম ফুলের চাষও। বহু চাষি আজও ফুল চাষ করেই জীবনযাপন করে চলেছে ।
মেদিনীপুরের কোলাঘাট ব্লক, শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লক, পাঁশকুড়া ব্লক, দাসপুর ১ নম্বর ব্লক, ডেবরা ব্লক এবং হাওড়া জেলার বাগনান ১ নম্বর এবং ২ নম্বর ব্লকে সব থেকে বেশি পরিমাণে ফুল চাষ হয়। ফুলচাষিরা ফুল নিয়ে প্রতিদিনই সকালে আসে কোলাঘাটের বাজারে।
কিন্তু বর্তমানে কোলাঘাটের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি সিমেন্ট কারখানা থেকে অনবরত নির্গত রাসায়নিক বর্জ্য ও দূষিত ছাইয়ের দাপটে ফুল চাষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে ২০০ মিটার এবং ৬০০ মিটার উচ্চতার গগনচুম্বী চিমনি দিয়ে ছাই উড়ে বাতাসে মিশে যেভাবে চারপাশের ৫০ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে তাতে এলাকা দূষিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। মানুষের এবং জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ সকলেরই ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে চাষেরও, বাদ পড়ছে না ফুল চাষও। ফুল বাগানে ফুটতে থাকা ফুলের গায়ের রঙ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, পাপড়ির ওপর পড়ছে কালো আস্তরণ। বহু ব্লকে ফুল চাষের হার কমতেও শুরু করেছে। কমে গেছে পদ্ম ফুলের চাষ। আগে মেদিনীপুর খাল এবং ৬নং জাতীয় সড়ক এবং ৪১নং জাতীয় সড়ক ও তমলুক রোডের দুই ধারের নয়নজুলি ও খড়গপুর-হাওড়া রেল লাইনের দুই ধারের খাল এবং নয়নজুলিতে ও বিভিন্ন ঝিলে ফুলের চাষ হত। কিন্তু দূষণের ফলে পদ্ম ফুলের চাষ প্রায় নষ্ট হতে বসেছে .
কোলাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি থেকে নির্গত হওয়া ছাই পরিবেশকে দূষিত করে চলেছে। মেদিনীপুর খাল কোলাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই পড়ে মজে যাচ্ছে, বিভিন্ন নয়নজুলি কোলাঘাটের ছাই ফেলে বুজিয়ে দেওয়া হচ্ছে, রেলের ঝিলগুলোকে মাছ চাষের উপযোগী করে তোলা হচ্ছে, নতুন নতুন রাস্তা সম্প্রসারণ হওয়ার জন্য নয়নজুলি আয়তনে ছোটো হয়ে যাচ্ছে, সর্বোপরি পদ্ম চাষ থেকে পানিফল চাষ লাভজনক হওয়া।
ফুলচাষে সরকারি সহযোগিতা বা কোনো পরিকল্পনা না থাকার জন্য, বর্তমানে পদ্মের ভাণ্ডারে টান পড়েছে। বহু ফুলচাষি এখন লাভজনক মাছ, পানিফল চাষের দিকে ঝুঁকছে। কোলাঘাটের হোলসেল ফুল বাজারে প্রায় ১০ হাজার চাষি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ফুল কেনাবেচার সাথে যুক্ত। রেলের জায়গায় ফুলের বাজার হওয়ায় রেল পুলিশের অত্যাচারে লেগেই থাকত সবসময়। কোনো নির্দিষ্ট শেড নেই এই বাজারে। নেই কোনো শৌচালয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে রেলের ডিআরএম-এর কাছে গণ-ডেপুটেশন দেওয়ার পর বছর কয়েক আগে একটা শৌচালয় করে দেওয়া হয়েছে। সেই শৌচালয় ব্যবহারের জন্য চাষি পিছু পাঁচ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে, বেড়েছে রেলের আয়।
কোলাঘাটের ফুল বাজার জেগে ওঠে ভোর তিনটে থেকে। চাষিদের কেউ ট্রেনে চেপে, কেউ বাসে, কেউ সাইকেলে বা ভ্যানরিক্সায়। ক্রেতারাও আসে ভুবনেশ্বর, টাটা, কটক, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি বিভিন্ন জায়গা থেকে। ফুলের নানাবিধ পসরা সাজিয়ে বসে চাষিরা বা ফুল ব্যবসায়ীরা। চলতে থাকে দর কষাকষি। কোনোটা কিলোদরে, কোনোটা আঁটি প্রতি, কোনোটা ডজন প্রতি, কোনোটা গোছ হিসাবে অথবা পিস হিসাবে বিক্রি হয় বিভিন্ন ফুল। সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে এই চাষের প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন স্থানে ফুল চাষে আগ্রহ বাড়ছে, বাড়ছে দেশে বিদেশে ফুলের চাহিদা। তাই ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে চাষিরাও রাসায়নিক সার প্রয়োগে ফলন বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। এই ফুল ব্যবসাকে কেন্দ্র করে আসছে প্রচুর বিদেশি মুদ্রাও। অথচ এই ফুল চাষের পরিকাঠামোর উন্নতিতে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি প্রশাসনের কোনো হেলদোল নেই। বিগত সরকার এমনকী বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে কেউই এ নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। কোলাঘাটের দূষণসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় দুই মেদিনীপুরের এই লাভজনক ফুল চাষ যে আশঙ্কার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই।
Leave a Reply