২৬ সেপ্টেম্বর, কামরুজ্জামান খান, মেছেদা#
কোলাঘাট শহরটি রূপনারায়ণ নদীর তীরে অবস্থিত। এই শহরটি ব্রিটিশ আমলে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বন্দর-কেন্দ্রিক বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল এখানে। মূলত পাট, কয়লা, কাঠ ব্যবসার জন্য ছোটো ছোটো জাহাজ আসত কোলাঘাটে।
আর কোলাঘাটের ইলিশ তো জগদ্বিখ্যাত ছিল। কথিত আছে, রেলের ব্রিটিশ বাবুদের একটা করে ইলিশ উপহার দিয়ে অনেকে রেলের বিভিন্ন কাজে চাকরি পেয়েছিল। যদিও রেলের বেতন ছিল যৎসামান্য। বিভিন্ন কাজে উপঢৌকন হিসেবে কোলাঘাটের ইলিশের প্রভাব ছিল অনেক বেশি।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টে ভারত স্বাধীনতা লাভের পর এদেশে কোলাঘাটের ইলিশের চাহিদা অনেক গুণ বেড়ে যায়। রূপনারায়ণ নদে তখন হাজার হাজার ইলিশ মাছের আনাগোনা।, জেলেদের রমরমা বাজার। তখন এক একটা ইলিশ মাছ গোটা অর্থাৎ থবকা দরে বিক্রি হত। এক একটা মাছের দাম পড়ত দুই আনা থেকে আট আনা পর্যন্ত অর্থাৎ এখনকার ১২ থেকে ৫০ পয়সা পর্যন্ত। রূপনারায়ণ নদের সেই বিখ্যাত ইলিশ ট্রেনে বুক করে পুরী, নাগপুর প্রভৃতি দূর দূর স্থানে পাঠানো হত। উড়িষ্যার চিলকার ইলিশের স্বাদ কোলাঘাটের ইলিশের তুলনায় কিছুই ছিল না।
একসময় কোলাঘাট থেকে পূর্বে তমলুক এবং পশ্চিমে রানিচক (ঘাটাল) পর্যন্ত স্টিমার চলত। ক্রমশ রূপনারায়ণ মজতে থাকে। তার চড়ায় স্টিমার আটকে যেত, আবার জোয়ার এলে সেই স্টিমার ভেসে উঠে যথাস্থানে পৌঁছে যেত। আজ এই স্টিমার চলাচল নেই। নদীর বুকে পলি ভর্তি হয়ে চরা পড়ে যাওয়ায় প্রায় চল্লিশ বছর আগে স্টিমার বন্ধ হয়ে যায়। ইলিশ মাছের আনাগোনাও নেই বললেই চলে, কোলাঘাটে ইলিশ মাছ আর ধরা পড়ে না বললেই চলে।
কিন্তু মানুষের মনে ইলিশের সেই স্বাদ আর গন্ধের অনুভূতি রয়ে গেছে। তাই আজও বর্ষার সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে চারচাকা গাড়িতে চেপে বাবু ক্রেতারা ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশের খোঁজে কোলাঘাটে আসে। এক-দুই হাজার টাকা পকেট থেকে বের করে দিয়ে এক-দু কেজি সাইজের ইলিশ কিনে নিয়ে মহানন্দে তারা বাড়ি ফিরে যায়। অথচ তারা জানে না যে কোলাঘাটের ইলিশ ওগুলো নয়। কিছু অসাধু মাছ ব্যবসায়ী ভালো সাইজের ইলিশ মাছ ক্রয় করে সুন্দরভাবে প্যাকিং করে রাখে, খদ্দের দেখলে অতি যত্ন সহকারে মাছটিকে গছিয়ে দেয় শাঁসালো খদ্দেরের হাতে। আসলে এই মাছগুলো আসে ডায়মন্ড হারবার থেকে, কখনো খেজুরি বা হলদিয়ার মোহনা থেকে, আবার দীঘার মোহনা বা উড়িষ্যার তালসারি থেকেও আসে। কোলাঘাটে রূপনারায়ণের ইলিশ সারা মরসুমে একটি বা দুটি কখনো-সখনো ধরা পড়ে জেলেদের জালে।
নদী মজে যাওয়া ছাড়াও কোলাঘাটে ইলিশ না আসার কারণ রয়েছে। কোলাঘাট থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট চালু হয় প্রায় বত্রিশ বছর আগে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষিত বর্জ্য অর্থাৎ দূষিত জল ও ছাই অনবরত এসে মিশছে রূপনারায়ণের জলে। এছাড়া রূপনারায়ণের ওপর রয়েছে চারটি ব্রিজ, ফলে ইলিশেরা আর কোলাঘাটমুখী হয় না। আর একটা কারণ হল, রূপনারায়ণ নদীর খাঁড়িমুখে জেলেরা সবসময় জাল ফেলে মাছ ধরে নেওয়ার জন্য মাছ আর উজান বেয়ে কোলাঘাটে আসতে পারে না।
কোলাঘাটের ইলিশ আজ রূপকথার গল্প। কোলাঘাটের ইলিশ মানেই সোনালি আঁশ, ঝকঝকে শরীর। একদম জ্যান্ত ইলিশ সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে, আলতো হাতের ছোঁয়ায় হড় হড় করে পিছলে যায়। যখন কড়াইয়ে চাপানো হয়, রান্নাঘরের বাইরে পাড়াজুড়ে ম ম করতে থাকে তার পাগল করা গন্ধ। কোলাঘাট আছে, রূপনারায়ণও বয়ে চলেছে আপন খেয়ালে। কিন্তু সেই ইলিশ আর নেই।
Leave a Reply