১৫ জুন, অমিতা নন্দী#
বীরভূম জেলায় বোলপুরের পরে প্রান্তিক, তার পরের স্টেশন কোপাই। স্টেশন থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার শ্রীনিধিপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় শ্রী স্বপন রুজ তাঁর পড়ে থাকা ১০০ বিঘা জমি দান করতে চেয়েছেন বেলুড় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পকে, হাসপাতাল তৈরির জন্য। এই মাঠের স্থানীয় নাম সর্বমঙ্গলার ডাঙা। আশপাশের এলাকায় কোনো হাসপাতাল নেই। ফলে গ্রামের মানুষদের চিকিৎসার জন্য দূরদূরান্তে যেতে হয়। ইতিপূর্বে বেলুড় শ্রমজীবীর বন্ধুরা বেলুড় ছাড়াও শ্রীরামপুরে আর একটি হাসপাতাল এবং একটি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলেছেন, তাঁদের সহায়তায় সুন্দরবনের সরবেরিয়াতে স্থানীয় মানুষজনের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে আর একটি হাসপাতাল, যেখানে কিছু জৈবচাষও হচ্ছে। এইসব কাজকর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে বোলপুরের কয়েকজন শিক্ষক ও সমাজকর্মী স্বপনবাবুর জমিতে স্থানীয় মানুষজনের প্রয়োজনে একটি হাসপাতাল গড়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। এই ব্যাপারে গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে সরাসরি কথাবার্তা বলার জন্য একটি সভার আয়োজন হয়েছিল ৪ জুন। মদনপুরে জৈবচাষের কাজে কর্মরত নিতাই মালও এই উদ্যোগে শামিল হয়েছেন। নিতাই মাল আগেই গিয়ে সভার তোড়জোড় শুরু করেছেন। আমরাও (আমি এবং জিতেন) ৩ তারিখ বিকেলে কোপাই পৌঁছে গেলাম।
৪ তারিখ শ্রমজীবী প্রকল্পের লোকজন এবং স্থানীয় মানুষেরা জড়ো হয়েছে সর্বমঙ্গলার ডাঙায়। বাইরে থেকে যাদের আসার কথা এমন ৫০ জনের জন্য সকালে মুড়ি-ঘুগনি আর দুপুরে ভাত-ডাল-সবজির দায়িত্ব নিয়েছিলেন এক সাধুবাবা, যার আশ্রয়স্থল উল্লিখিত জমিরই এক প্রান্তে। আগের সন্ধ্যায় সেকথা জানার পর পঞ্চায়েত সভাপতি বলেছিলেন আরও ১০০ জনের খাবার এবং সভাস্থলে স্কুলের সামনে একটা ছাউনি তৈরির দায়িত্ব পঞ্চায়েত নেবে। রান্নাবান্না সাধুর আশ্রমে একসঙ্গেই হয়েছিল। ভাত, ডাল, আলুপোস্তর ঝোল, পটল আলুর তরকারি, তেঁতুল দিয়ে আলুর টক ইত্যাদির জন্য আশপাশের গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে রসদ সংগ্রহ করে রান্নাবান্নার কাজে প্রায় ৪-৫ জনের টিম সকাল থেকেই লেগে পড়েছিল।
আশ্রম থেকে অনতিদূরে পঞ্চায়েতের কার্যালয় এবং স্কুলের মাঝের মাঠে বড়ো বটগাছের তলায় সভা শুরু হল প্রায় ১১টা নাগাদ। সবমিলিয়ে ১০০ থেকে ১৫০ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। বেলুড়, শ্রীরামপুর এবং সরবেরিয়া থেকে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের কর্মকর্তা এবং কিছু কর্মী, বোলপুর থেকে বেশ কিছু শিক্ষক ও সমাজকর্মী, লাভপুর থানার অন্তর্গত কিছু গ্রামের মানুষ, চাঁদপুর ও সুলেমানপুরেরও কিছু লোকজন এসেছিলেন।
সভা সঞ্চালনা করেন নিতাই মাল। নিজের লেখা একটি গান গেয়ে তিনি সভা শুরু করেন যার মূল কথা ছিল, হিম্মত থাকলে সবই করা যায়। হাসপাতালের জন্য যিনি জমি দিতে চেয়েছেন সেই স্বপনবাবু বলেন যে এই পড়ে থাকা জমিতে গ্রামের মানুষের চিকিৎসার জন্য যাতে হাসপাতাল গড়ে তোলা যায়, তার জন্য তিনি বিশ্বভারতীর শিক্ষক কিশোর ভট্টাচার্য এবং শান্তিনিকেতনের সমাজকর্মী শৈলেন মিশ্রকে বলেছিলেন। তাঁরাই বেলুড় শ্রমজীবীর সঙ্গে যোগাযোগে মধ্যস্থতা করেন।
কিশোরবাবু বলেন, বেলুড় শ্রমজীবীর সঙ্গে তাঁকে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন শান্তিনিকেতনের (প্রয়াতা) শ্যামলী খাস্তগীর, বছর পাঁচ-সাত আগে। তারপর থেকে বেলুড়, শ্রীরামপুর ও সরবেরিয়ায় যাতায়াত করে তিনি দেখেন, খুবই সততার সঙ্গে ওখানে ডাক্তার এবং অন্যরা কাজ করছে, গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত করে তোলা হচ্ছে যাতে তারা আবার শ্রমজীবীর কাজে যুক্ত হতে পারে, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে গ্রামের মানুষ জৈবচাষ ও মাছের চাষ করে হাসপাতালের রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য খাদ্যের জোগাড় করছে। অন্যদিকে বীরভূমে কোনো ইন্ডাস্ট্রি নেই, শ্যালো পাম্প ও রাসায়নিক দিয়ে কিছু চাষ হচ্ছে। এখানে যদি গ্রামের মানুষ নিজেদের চিকিৎসার কাজে নিজেরাই হাত লাগায়, এখানকার ছেলেমেয়েরা যদি বেলুড় ও শ্রীরামপুর থেকে কিছুদিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে কাজ করে, এই জমির মধ্যে যে পুকুরগুলি আছে সেখানে যদি মাছ চাষ করা যায়, জমির কিছু অংশে জৈবচাষ করা যায়, তাহলে হাসপাতালের কাজেই তা লাগবে। বোলপুরের বেশ কিছু ডাক্তার তাঁদের নিজেদের প্র্যাকটিসের বাইরেও এখানে এসে প্রয়োজনে গাছতলায় বসেই চিকিৎসার কাজ শুরু করতে রাজি আছেন, কলকাতা ও অন্যান্য জায়গার কিছু শিক্ষক, চাকুরিজীবী, চিকিৎসক এবং অবসরপ্রাপ্ত মানুষজন এই কাজে হাত লাগাতে আগ্রহী।
বেলুড় শ্রমজীবীর কৃশানু মিত্র বললেন, ব্যাপারটা এমন নয় যে একজন জমি দিতে চাইলেন আর আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা নিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। এত শক্তি, এত ডাক্তার-নার্স-কর্মী আমাদের নেই। তাই স্বপনবাবুর প্রস্তাব নিয়ে আমরা অনেক ভেবেছি। যদি ইনডোর চালু করতে তিন বছর লাগে, তবে এর মধ্যে আউটডোর চালু করে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে হবে এখান থেকেই।
নিতাই মাল জানালেন যে লাভপুরের একজন ক্যানসার রোগীকে বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যখন তাঁর একেবারে শেষ অবস্থা। তাঁকে বাঁচানো যায়নি। কিন্তু যে আত্মীয়-বন্ধুরা ওখানে গিয়েছিল, ওখানকার চিকিৎসক ও অন্যদের আন্তরিকতা দেখে তাদের এত ভালো লেগেছে যে এখানে তেমন হাসপাতাল গড়ে ওঠার খবরে উৎসাহিত হয়ে ওই গ্রাম থেকে অনেকেই আজ এসেছে।
সুলেমানপুরের ভৈরবনাথ ডোম কাগজ পড়ে জেনেছেন যে এখানে একটা হাসপাতাল হবে। সবাইকে তা বলেওছেন। স্বপনবাবুকে এমন উদ্যোগের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বললেন, মানুষের মনে অনেক সংশয় আছে। হয়তো একাজটা শুরু করে ওঁরা আর শেষ করলেন না, তাহলে কী হবে?
কোপাই ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার স্বপন মুখার্জি বললেন, গ্রামে একটা সভ্যতা আছে এখনও। কিন্তু স্বাস্থ্যের ব্যাপারে মানুষ বড়ো অসহায়। যাদের আগ্রহ আছে তারা যদি বেলুড়-শ্রীরামপুরে ঘুরে আসে, তবে আর কোনো সংশয় থাকবে না
শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের প্রধান ব্যক্তি ফণীগোপাল ভট্টাচার্য তাঁর দীর্ঘ ভাষণে বললেন, হিম্মত থাকলে সবই করা যায়। এটা এতদিনকার অভিজ্ঞতা থেকে সত্য বলে তাঁর মনে হয়। এখন চারিদিকে ইতস্তত গড়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিং হোম আর হোটেল সবই এমন ঝাঁ চকচকে যে তাদের মধ্যে কোনো তফাত করা যায় না। তবে সাধারণ মানুষ সেখানে চিকিৎসা করাতে পারে না, ঘটিবাটি বেচে ধারদেনা করে যদিওবা যায়, তবে বাড়ির লোকেরাই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফণীবাবু বলেন, জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের মূল কথা ছিল, ‘নিজেদের স্বাস্থ্য নিজেরাই গড়ব’। এই শ্লোগান নিয়ে ওঁরা কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরে মনে হয়েছে যে শুধু চিকিৎসা দিয়ে পৃথিবীকে, মানুষকে ভালো রাখা যায় না। সুস্থ চাষবাস-শিক্ষা এসবেরও বিশেষ প্রয়োজন আছে।
সরবেরিয়া শ্রমজীবী হাসপাতালের মূল সংগঠক অরুণ সেন নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা সংক্ষেপে বলে সকলকে আহ্বান জানালেন, আসুন এখানে এমন একটা হাসপাতাল, একটা বিদ্যালয়, একটা কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলি যা শুধু বীরভূম জেলার মধ্যে নয়, গোটা রাজ্য এবং দেশের মধ্যে একটা মডেল হয়ে উঠবে।
সর্বমঙ্গলা মন্দিরের পুরোহিত খুবই আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইছিলেন, এখানে মানুষের ভূমিকা কীরকম হবে? তিনি শুনেছিলেন, এখানে বিশাল হাসপাতাল হবে, তিন-চারতলা বিল্ডিং হবে, অনেকে কাজ পাবে। এখন সবার কথা শুনে বুঝলেন যে নিজেদের শ্রম দিয়েই সবটা করতে হবে। সেটা ওঁর ভালো লাগল।
mitra chatterjee says
bhaggyo krome amio sekhane uposthit chhilam..natun kore khaborta pore aro bhalo laglo…sobtai khub inspiring….