বঙ্কিম, অশোকনগর, ২৯ জুন#
একজন মানুষকে একদল লোক পেটাচ্ছে। মহিলারাও মারছে। মানুষটি শিক্ষক, চারদিকে লোকেরা ভিড় করে আছে। সামনের সারিতে টিভি ক্যামেরা। টানটান উত্তেজনা। শিক্ষক ছাত্রীর শ্লীলতাহানি করেছে। দশম শ্রেণীর ছাত্রী। মহিলারা উত্তেজিত। ক্ষতবিক্ষত লোকটির ঠোঁটের কোণা বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। সামনে ক্যামেরা তাক করে ‘ মিডিয়াদণ্ড’ উঁচিয়ে সাংবাদিকের প্রশ্ন, আপনি কি বিবাহিত? উত্তরে, হ্যাঁ। আবার প্রশ্ন, ছেলেমেয়ে আছে, হ্যাঁ, দুটি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে আছে। তবে এমন কাজ করলেন কেন? অন্য ছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করুন, আমি এমন করিনি …
মুহুর্তে বন্ধুদের কাছ থেকে ফোন এল, এই টিভিতে দেখো, অশোকনগরে এক শিক্ষককে শ্লীলতাহানির দায়ে ধোলাই দিচ্ছে। দ্যাখো … পার্টির ওপরতলা থেকে ফোন গেল কর্মীর কাছে, দ্যাখো, তোমার এলাকায় কী চলছে!
জনগণের তাণ্ডব চলছে। সবকিছুই মিডিয়াবন্দী হচ্ছে। ঘটনার কাছাকাছি কোচিং সেন্টারে যেখানে শিক্ষক মশায়ের বৃদ্ধ মা থাকেন, সেখানে ভাঙচুর হচ্ছে। ইতিমধ্যে পুলিশ এল, অভিযুক্তকে থানায় নিয়ে গেল। ঘটনা আপাত সমাপ্তি। কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা টিভি চ্যানেলে ‘জ্যান্ত’ (লাইভ) থাকল ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে শিক্ষকের ধোলাই পর্ব। ধোলাই চলল গণমনের। শিক্ষক রইলেন জেল-এ। ছাত্রীটি বিধ্বস্ত, ঘটনার দু-দিন বাদেও সে কাঁদছে, ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। মহিলাদের কাছে একান্তে জানাল তার অবমাননার কথা। থানায় জানানো হয়েছে, ‘ আনুমানিক একমাস হল আমি কঁচুয়ার মোড় ‘ স্নেহলতা কোচিং সেন্টার’-এ মাধ্যমিক প্রস্তুতির জন্য ভর্তি হই। অন্যান্য দিনের মতো আজও দুপুরে সেখানে পড়তে যাই। সেখানকার প্রধান অধ্যক্ষ পরিতোষ বিশ্বাস মহাশয় আমাকে আলাদা কক্ষে নিয়ে বসান। লেখাপড়ার মাঝে তিনি আমার শরীরে বিভিন্ন জায়গায় হাত দিতে থাকেন, আমি ভদ্রভাবে শিক্ষাগুরু পরিতোষবাবুকে এই ধরণের আচরন করতে মানা করা সত্ত্বেও তিনি আমায় জড়িয়ে ধরে আমার স্তন ও নিম্নাঙ্গে হাত দেন। ভয়ে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে কোনওরকমে বাড়ি ফিরে আসি। এর আগেও তিনি দু-তিনবার একাজ করেছেন।’
বাড়ির লোক জানতেন না, এফআইআর কপি তুলতে হয়। পরে থানা থেকে তারা কপি তুলেছেন। উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলা বারাসত সাবডিভিশন, অশোকনগর থানা, এফআইআর নাম্বার ৩৩৯/১৩ তাং ১৮/০৬/১৩। আইপিসি সেকশন ৩৫৪এ/৩৫৪বি।
মেয়েটির মা জানালো, ‘ আমিও ওনার কাছে কোচিং-এ পড়েছি, কিন্তু ওনার এমন স্বভাবের কথা জানতাম না। ওইদিন যখন ওনার বাড়িতে যাওয়া হয়েছিল, তখন ওনার মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছিল।’
কোচিং সেন্টার এলাকার বাসিন্দা প্রবীনা কল্পনা সরকার বেশ জোরের সাথে বললেন, ‘ আজ বিশ বছর হলো পরিতোষকে আমি জানি। ও কখনও মদ খায় না। এমনকি বিড়ি সিগারেটও খায় না। ওরা বলে কিনা পরিতোষ মদ খেয়েছে। ওকে মারার সময় ওরা পরিতোষের মুখে মদ ঢেলে দিয়েছে।’ কোচিং সেন্টারের আশেপাশের আরও অনেকেই মাস্টারমশাই যে মদ্যপান করেন না একথা জানালো।
কোচিং সেন্টারের কাছেই থাকে জিৎ সরকার (এইচ এস) ও মৌসুমী সরকার (বি এ)। দুই ভাইবোন। ওরা বলল, ছেলেবেলা থেকে মাস্টারমশাইকে চিনি। ওনার সম্বন্ধে একথা বিশ্বাস করতে পারিনা। মৌসুমী বলল, ‘ আমি ওনার কাছে বি এ-তে ইতিহাস পড়েছি। ওনার কতগুলো ডিসিপ্লিন আছে। যে নোটটা দেবেন, সেটার পড়া ওনার কাছে দিতে হবে, তবে আবার নতুন নোট দেবেন। আর ওই মেয়েটি যখন কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়েছে, তখন ওর সাথে আরও তিনজন ছাত্রী ছিল। ও সাইকেলে গেছে, এখানে কাউকে কিছু বলেনি। পড়ে ওর সাথের মেয়েগুলো টিভির লোকেদের জানিয়েছিল, ওরা একসাথে পড়ে বেরিয়েছিল কোচিং থেকে।’ কল্পনা সরকার-ও বলেছেন, একটা মেয়ের ওপর এখানে কিছু হলো, এখানে এত বাড়ি, এত লোক। কাউকে কিছু বলল না, অথচ পরে ওর মা লোকজন নিয়ে এসে এখানে ভাঙচুর করল।
কয়েকদিন পরে পরিতোষ জেল থেকে ফিরে এসেছেন, কোচিং সেন্টারে আবার পড়ানো শুরু করেছেন। তার শতাধিক ছাত্রছাত্রী আবার আসতে শুরু করেছে। তার সাথে দেখা করতে গেলে উনি বললেন, ‘ আমি অভিযুক্ত, আমার কথা আপনারা বিশ্বাসই করতে যাবেন কেন। বরং ওই ছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন। আমি এখানে আজ পঁচিশ বছর টিউশন পড়াই। ওই মেয়েটি একমাসও হয়নি আমার কাছে পড়তে এসেছিল।’ এরপর বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘ দেখি মেয়েটি কীভাবে কোর্টে দাঁড়িয়ে আমার সম্বন্ধে এইসব কথা বলে!’
তথ্য সহায়তা তোজাম্মেল হক।
Leave a Reply