মণীষা চৌধুরী(গোস্বামী), কোচবিহার#
কোচবিহারে রূপান্তরকামী মানুষের সংগঠন ‘মৈত্রী সংযোগ সোসাইটি’র উদ্যোগে গত ২৫শে বৈশাখ অভিনব কায়দায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে আমরা শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই চর্চিত হতে দেখি, কিন্তু এখানে আলোচনার বিষয়ে উঠে এসেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ‘রবির আলোয় ঋতু’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে আলোচনায় বারে বারে উঠে আসছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করেছিলেন মূলত রূপান্তরকামী মানুষেরা। এঁরাও কতটা নিখুঁতভাবে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তা এই অনুষ্ঠানে না গেলে সত্যিই বোঝা যেত না। অনুষ্ঠানের শুরুতে গান, কবিতা ইত্যাদি হয়ে যাওয়ার পর ঋতুপর্ণ ঘোষের জীবন নিয়ে কিছুটা আলোচনা হল, ঋতুপর্ণ ঘোষের জীবনের পরিবর্তনই ছিল আলোচনার মূল বিষয়বস্তু। এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবির পাশে আরোও একটি ছবিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হল। অনুষ্ঠানে উপস্থিৎ একজন তাঁর জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ‘জানুস কোরজ্যাখ’র কথা বলেন। জানুস কোরজ্যাখ ছিলেন একজন জার্মান স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে পরিবার পরিজন হারানো শিশু-কিশোরদের নিয়ে তিনি একটি অনাথ আশ্রম চালাতেন। জার্মান সৈন্যবাহিনী যখন সেই অনাথ আশ্রমটি দখলের নির্দেশ দিল এবং সাথে এটাও জানিয়ে দিল যে ওই আশ্রমের সব আবাসিকদের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হবে আর জার্মান বলে জানুস কে ছেড়ে দেওয়া হবে তখন তিনি কবিগুরুর ‘ডাকঘর’ নাটকটি ইহুদি ভাষায় অনুবাদ করে সেই আশ্রমে মঞ্চস্থ করলেন। অভিনয় করেছিলেন সেই আশ্রমেরই শিশু কিশোরেরা আর সেটাও হয়েছিল ক্যাম্পে যাওয়ার এক সপ্তাহ আগে ১৯৪২ সালের ১৮ই জুলাই। ভারতবর্ষের বাইরে ‘ডাকঘর’ নাটকটি যতবার মঞ্চস্থ হয়েছে তাদের মধ্যে এই পোল্যান্ডের অনাথ আশ্রমেই সম্ভবত প্রথমবার মঞ্চস্থ হয়েছিল। এরপর ক্যাম্পের যাওয়ার সময়ে জানুস কোরজ্যাখ তাঁর আশ্রমের ১৯৬ জন শিশু কিশোরদের সাথেই ক্যাম্পে চলে যান, সেখানেই গ্যাস চেম্বারে তাঁর মৃত্যু হয়। এবারে ঋতুপর্ণ ঘোষের কবিগুরুকে নিয়ে করা তথ্যচিত্র ‘জীবনস্মৃতি’ও শেষ হয় ‘জানুস কোরজ্যাখের ডাকঘর’ দিয়ে। কবিগুরুর লেখা প্রথম কবিতা প্রসঙ্গে একজন জানালেন যে ছোট থেকেই আমাদের শেখানো হয় বা রবি ঠাকুরের লেখা জীবনস্মৃতি পড়েও আমরা জানতে পারি যে তাঁর শৈশবের পাঠ ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ –ই তাঁর জীবনে ‘আদি কবির প্রথম কবিতা’। তিনি ঋতুপর্ণ ঘোষের ফার্ষ্ট পার্সন উদ্ধৃত করে বলেন ‘আমরা কখনও ভেবে দেখিনা, এটা কোনও তথ্য পরিবেশন নয়। এটা বালক রবির কল্পনা। বর্ণপরিচয়ের পাতায় অনুরূপ যে সংলগ্ন বাক্যদুটি উনি পড়েছিলেন তা কোনওমতেই ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ হতে পারে না। কারন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত ঐ প্রাথমিক পাঠে বাক্যদুটি সমার্থক হলেও প্রকাশের ভঙ্গি অন্যতর- ‘জল পড়িতেছে, পাতা নড়িতেছে’ বিদ্যাসাগরের পঙতিদুটি হয়তো এক প্রকৃতি পাঠের সংকেত নিয়ে এসেছে কিন্তু মনে মনে কিংবা কোনও কল্পনার সত্য দিয়ে ই বাক্যবন্ধনটি কেমনভাবে কবিতা করে ফেললেন শিশু রবি যে পঞ্চাশ বছর বয়েসে যখন তাঁর জীবনস্মৃতি লেখার সময়, ততদিনে বাক্যদুটি নির্ভুল নিঃসংশয়তায় কেবল ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে’ র ছন্দ অনুবাদ হয়েই বেঁচে আছে তাঁর মনে। আর তাই বোধহয় সারাটা জীবন ধরে সমস্ত বাঙালী পাঠকের চৈতন্য জুড়ে ‘জল পড়া’ আর ‘পাতা নড়া’ –র দ্যোতনা সজীব হয়ে রইল বছরের পর বছর’। অনুষ্ঠানের একেবারে শেষে একজন বললেন এই Facebook বা whatsapp রবীন্দ্রনাথের হাতে হয়তো বাঙালী খুঁজে পেত সঠিক বাংলা রূপান্তর যেভাবে একতারা হয়ে উঠেছে ‘আনন্দলহরি’ বা বেতার হয়ে উঠেছে ‘আকাশবানী’।
অনুষ্ঠান শেষে আহ্বায়ক সুমি দাস জানালেন –“ এই অনুষ্ঠানের মত সব অনুষ্ঠানই হয় ‘মৈত্রী সংযোগ সোসাইটি’ কোচবিহার আর বহরমপুরের ‘কর্ণসুবর্ন ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’র (KWS) এর যৌথ উদ্যোগে। আর আর্থিক সহায়তা প্রদান করে ‘India Development Association’ (AID) নামে একটি আমেরিকান NGO.
কেন ঋতুপর্ণ ঘোষ? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন “ কদিন আগে একটা বই বেড়িয়েছে, ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখার একটা বিরাট সঙ্কলন – ‘ফার্স্ট পার্সন’। বইটা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ঋতুপর্ণ ঘোষের খুব কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখায় রবি ঠাকুরের কথা বার বার উঠে এসেছে। সেই জায়গা থেকেই আমরা নামটা ভেবেছি যে ‘রবির আলোয় ঋতু’- অনেকটা আলোকিত হয়েছে। আমি রবীন্দ্রনাথের খুব কম বই পড়েছি। উনি জমিদার বাড়ির ছেলে ছিলেন বলে ওনার লেখা বইতে খুব একটা কষ্ট, অভাব, দুঃখ পাইনা, শুধু প্রেম ভালোবাসা। ওনার কবিতা বেশ কিছু ভালো লাগে, ছোটগল্প, নষ্টনীর খুব ভালো লেগেছে। ঋতুপর্ন ও রবীন্দ্রনাথ এর সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে বলতে এই প্রোগ্রামটা ভাবা হয়েছিল, মানে নাম ও অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করি আমি আর আমার এক বন্ধু”।
আর একজনের ফটোতে মালা দেওয়া হল, উনি কে? “ও হল পূজা, এক রূপান্তরকামী। বহুদিন ধরেই মুম্বাইয়ে বার ড্যান্সারের কাজ করত। একসময়ে কোচবিহারে ফিরলেও পরে শিলিগুড়িতেই থাকত ‘মৈত্রী সংযোগ সোসাইটি’র শুরু থেকেই আমাদের সাথে ছিল। মুম্বাই থেকে কোলকাতা ফিরছিল, ট্রেনে AC র ঠান্ডা সহ্য হয়নি, কোলকাতাতে নেমে শরীর খারাপ হয়ে যায়, তারপর মারা যায়”।
Leave a Reply