আকাশ মজুমদার, জলপাইগুড়ি, ১৫ মে#
আমরা ছোটোবেলা থেকে পরিচিত লোকজনকে টাকা রাখতে দেখেছি পোস্ট অফিস, ব্যাঙ্ক, ইনসুরেন্সে। তার বাইরে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানের কথা শুনতাম — পিয়ারলেস, সাহারা। কেউ কেউ শেয়ারে টাকা রাখত। মিউচুয়াল ফান্ডেও টাকা রাখত। কিন্তু সেগুলো কম। আমিও ছোটোবেলায় মাসি কাকুদের দেওয়া উপহারের টাকা রেখেছি পোস্ট অফিসে। হয়তো হাজার টাকার কিষান বিকাশ পত্র কেনা হয়েছে, সেটা হয়তো ৬-৭ বছর পরে ২০০০ টাকা হয়েছে। ক্লাস সেভেন এইটে মা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে পোস্ট অফিসে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল।
২০০০ সালের পর থেকে আস্তে আস্তে দেখতে পেলাম, বিভিন্ন নামে কিছু কিছু সংস্থা উঠে আসছে। প্রথমদিকে বিভিন্ন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। আস্তে আস্তে দেখি আমাদের শহরে একটা একটা করে ব্রাঞ্চ অফিস খুলছে। যেমন রোজভ্যালি, প্রয়াগ, আইকোর, অ্যালকেমিস্ট। একটা কৌতুহল ছিল। এরা কারা? তবে প্রত্যেকেই এলআইসি-র একটা লোগো ব্যবহার করত। অর্থাৎ এলআইসির সঙ্গে এদের একটা অ্যাটাচমেন্ট আছে বুঝিয়ে তারা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করত। ওদের সিস্টেমটা যেহেতু নেটওয়ার্কিং সিস্টেম, এক থেকে পনেরো অবধি র্যাঙ্ক থাকে এজেন্টদের, কে কার নিচে কত লোক জোগাড় করতে পারে, তাই পরিচিত ধরেই আমানত তোলা হত। প্রত্যেকেই কাছের লোককে অ্যাপ্রোচ করত। আমিও করেছি কিছু রেকারিং বা ওই ধরনের আমানত। ছোটো ছোটো। পরিচিতরা আসত এজেন্ট হিসেবে। ফলে অস্বীকার করা কঠিন হয়ে যেত। ধীরে ধীরে ওরা সমাজের খুব ভেতরে ঢুকে গেল, যা ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিস-ইনসুরেন্স পারেনি। এজেন্টদের জাল থেকে ওপরের দিকের লিডাররা বুঝে যেত, কার কাছে টাকা আছে। যেহেতু সম্পর্কের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর দাঁড়িয়ে, তাই কোম্পানির বদলে ব্যক্তিকে ভরসা করার ব্যাপার ছিল। কোম্পানির কাগজপত্র নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না।
একটা কৌতুহল তবু থেকে যায়। তাই আমি কাগজপত্র দেখতে চাইলাম। দেখলাম, কিছু ভারত সরকারের সিল দেওয়া কাগজের জেরক্স। প্রত্যেকেই জেরক্স ব্যবহার করে। সবার মোটামুটি একই ধরনের কাগজপত্র। প্রত্যেক কোম্পানিই বলত, আমার কোম্পানির কাগজপত্র ঠিক। বাকিদের কাগজ ভুলভাল। ওগুলোতে টাকা রাখা ঝুঁকি। মূলত তিন ধরনের আমানত স্কিম — রেকারিং ডিপোজিট, এক বা দুই বা তিন বছরের; ফিক্সড ডিপোজিট, তিন পাঁচ সাত বছরের। আরেকটা স্কিম ছিল এদের, এমআইএস বা মাসিক সুদের স্কিম। এমআইএস-এ যে কেউ তিরিশ হাজার টাকা তিন বা পাঁচ বছরের জন্য জমা রাখলে প্রতি মাসে যে সুদ পাওয়া যায় তা পোস্ট অফিস বা ব্যাঙ্কের থেকে অনেক বেশি। সেই জন্য লোকে এতে টাকা রাখত।
ক্রমশ পরের দিকে দেখা গেল, এরকম ভুরি ভুরি কোম্পানি বেরোচ্ছে। সবাই বলত, তাদের বিভিন্ন প্রকল্প আছে — রিয়েল এস্টেট, কোল্ড ড্রিংক্স, মিনারেল ওয়াটার, ফুড, অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি — এরা সেখান থেকেই রিটার্ন দেয়। এবং এদের যা লাভ সেইসব প্রকল্পে, তা আমানতকারীদের প্রদেয় সুদের থেকে অনেক বেশি। তাই কোনো সমস্যা নেই। ফলে জমা রাখা টাকা মার যাওয়ার ভয় নেই। প্রত্যেকেই বলত, তারা অ্যাসেট ভিত্তিক কোম্পানি। আর বাকিরা অ্যাসেট ভিত্তিক কোম্পানি নয়।
এদের ছাপানো ব্রোশিওরে এবং ওয়েবসাইটে এদের বিভিন্ন প্রজেক্ট সম্পর্কে ফলাও করে লেখা থাকত। কিন্তু তার বাস্তব ঠিক ভুল বিচার করা স্থানীয় আমানতকারীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। পরে শুনেছি, এদের এক দু-টো প্রকল্প চলে, বাকিগুলো ভাঁওতা।
এসব বামফ্রন্টের আমল থেকেই চালু হয়েছে, মোটামুটি ২০০০ সাল থেকে। যত দিন গেছে, এরা বুক ফুলিয়ে কাজ করতে লেগেছে।
এর পরে দেখলাম, আরেক ধরনের কোম্পানি বাজারে এল — আমার ভাষায়, হাই রিস্ক চিট ফান্ড। এদের আইডিয়াটা রোজ ভ্যালি বা আইকোর থেকে একদম আলাদা। প্রথম এই ধরনের কোম্পানি যার নাম শুনলাম, রয়াল। এদের হেড অফিস কোচবিহারে। পরে এরা মোটামুটি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় অফিস তৈরি করে। এদের মূলত একটাই স্কিম ছিল, এমআইএস। কারো কারো ফিক্সড প্ল্যান ছিল। এমআইএস প্ল্যানটা এরকম — কেউ যদি আঠারো মাসের জন্য এক লাখ টাকা রাখে, সে তাহলে মাসে আট হাজার টাকা করে রিটার্ন পাবে আঠারো মাস ধরে। এবং আঠারো মাস পরে মূল টাকাটা ফেরত পাবে। যে এজেন্টের মাধ্যমে এই টাকাটা উঠবে, সে পাঁচ পার্সেন্ট করে প্রত্যেক মাসে পাবে। অর্থাৎ কেউ যদি এজেন্ট হয়ে টাকা রাখে, তাহলে সে নিজেই ৮+৫ অর্থাৎ তেরো পার্সেন্ট করে পাবে প্রতি মাসে। আবার আঠারো মাস পরে সে মূলটা ফেরত পাবে। তেরো পারসেন্ট করে পেলে সাত মাসের মধ্যে মূল টাকাটা উঠে আসছে। অর্থাৎ সাত মাসের ঝুঁকি। বাকি যা পাবে তা উপরি। আমার প্রথমেই মনে হয়েছিল, এটা শিগগিরি বন্ধ হবে। কী করে এটা সম্ভব? কিন্তু কোথায় কী, দেখলাম মানুষ দিব্বি আমানত রেখে সুদ পাচ্ছে। এবং যারা তা পাচ্ছে, তাদের মাধ্যমে এটা ছড়াচ্ছে বিভিন্ন লোকের মধ্যে। প্রথমে এদের কোনো বিজ্ঞাপন থাকত না। পরে উত্তরবঙ্গ সংবাদে বিজ্ঞাপন দেখলাম। এরা বিভিন্ন জায়গায় ব্রাঞ্চ খুলে ফেলল।
এরপর এদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও কোম্পানি এল, যেমন ইউনিক স্টার, শিবশংকর, অ্যাক্সিস রিটেল ইন্ডিয়া প্রভৃতি। এদের মধ্যে রয়াল আর ইউনিক স্টার অনেক বড়ো পরিমাণে কাজ করেছে। এদের অফিসে আমি নিজে গেছি, কথা বলেছি। এদের বক্তব্য, এদের কোনো প্রকল্প নেই। এরা পুরো টাকাটাই শেয়ারে খাটায়। মোট তেরো পার্সেন্ট সুদ দেয় মাসে। কিন্তু এরা এর থেকে অনেক বেশি টাকা শেয়ারে খাটিয়ে লাভ করে। এরা খাটায় কমোডিটি ট্রেডিং বা পণ্যের শেয়ার বাজারে। সোনা, প্ল্যাটিনাম, ক্রুড অয়েল প্রভৃতি মার্কেটে। ওরা বলেছিল, ওই মার্কেটটা অন্য যে মূল শেয়ার বাজার, তার থেকে অনেক বেশি সময় ধরে চলে। সকাল ন-টা থেকে রাত ন-টা। ফলে সারাদিনে অনেকটা সময় থাকে, সারাদিনে বারবার টাকাটা খাটানো সম্ভব হয়। প্রসঙ্গত, সাধারণ শেয়ার বাজার চলে সকাল ন-টা থেকে বেলা তিনটে পর্যন্ত। যাই হোক, ওদের দাবি ছিল, কমোডিটি ট্রেডিং-এর ফলে ওদের প্রতিদিন ৮-১০ শতাংশ লাভ থাকে আসলের ওপর। সারা মাসে ওরা অনেকটা লাভ পায়। তার খুব অল্প অংশই তারা আমানতকারী বা এজেন্টদের দেয়। ওরা ডাইরেক্ট ব্রোকিং হাউস বা শেয়ারবাজারের সরাসরি দালাল। সেই লাইসেন্স ওদের আছে। ফলে ওদের পক্ষে এতটা সুদ দেওয়া কোনো সমস্যা নয়।
কিন্তু আমি দেখেছি, এদেরও নথিপত্র শক্তিশালী নয়। এরা কেবল একটা ছাপানো সার্টিফিকেট এবং একটা টাকার রসিদ দেয়। পরে আমি রয়াল-কে দেখেছি, অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের একটা জিরো ব্যালেন্সের অ্যাকাউন্ট খুলে দিচ্ছে আমানতকারীদের। এবং অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের এটিএম কার্ড-ও দিয়ে দিচ্ছে। ফলে আমানতকারী মাসিক সুদ ওই এটিএম দিয়ে সরাসরি তুলে নিতে পারছে।
পরের দিকে স্কিমগুলো বদলাতে থাকে, বা আরও আগ্রাসী হতে থাকে। একটা কোম্পানি অ্যাক্সিস রিটেল ইন্ডিয়া, এদের প্ল্যান ছিল, দশ মাসে পুরো টাকাটা ফিরিয়ে দিত, অর্থাৎ মাসিক হিসেবে ধরলে দশ শতাংশ, এর সাথে আট শতাংশ করে মাসিক সুদ। তার সঙ্গে এজেন্ট-এর কমিশন পাঁচ শতাংশ। অর্থাৎ মোট ২৩-২৪ শতাংশ করে মাসে দিত। অর্থাৎ চার-পাঁচ মাসেই মূল টাকাটা উঠে আসে।
কয়েক মাস আগে এদের যখন রমরমা ব্যবসা, উত্তরবঙ্গে এরা বড়ো বড়ো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ফান্ডিং করা শুরু করে। জলপাইগুড়ি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল স্পনসর করে ইউনিক স্টার। বাইরে থেকে আর্টিস্ট এনে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামটাতে ইউনিক স্টার নাকি তিরিশ লাখ টাকা দিয়েছিল। একাধিক ব্যানার, বিশাল বিশাল গেট … কোচবিহারের এবারের রাসমেলা এই ধরনের কোম্পানির বড়ো বড়ো গেটে ভর্তি হয়ে গেছিল। \par
সারদা কাণ্ডের পরে, হঠাৎ করে এদের প্রত্যেকের অফিস কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়। এদের বক্তব্য, সারদা কাণ্ডের ফলে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তা কেটে গেলেই আবার এরা কাজ শুরু করবে। এদের কিছু উঁচুতলার এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এবারে তারা পুরোনো সব স্কিমগুলো বন্ধ করে দেবে, কারণ সেগুলো অবৈধ ছিল, বদলে শুরু করবে কম সুদের কিছু প্ল্যান, যেগুলো নাকি বৈধ।
এই ধরনের কোম্পানিগুলি আসার আগে আরেক ধরনের কোম্পানি এসেছিল। কয়েক মাসের জন্য কিছু অনলাইন কোম্পানি তৈরি হয়েছিল। যেমন — ই-গ্লোবাল, ওয়ে টু লাইফ, আর্য গ্রুপ প্রভৃতি। এদের প্রত্যেকের এক একটা সুন্দর ওয়েবসাইট থাকত। হঠাৎ করেই এদের অনলাইন কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায় এবং আর এদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরা প্রতিদিন ১-২ শতাংশ করে সুদ দিত। এদের নিয়ম ছিল : একটা আইসিআইসিআই, বা অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক বা এসবিআই ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট করতে হত আমানতকারীদের। সেখানে টাকা ডিপোজিট করতে হত। তারপর ওরা অনলাইনে একটা আইডি জেনারেট করত। সেই মতো অ্যাকাউন্টে সুদ চলে আসত প্রতিদিন। দিনে এক শতাংশ হলে মাসে তিরিশ শতাংশ!
সে সময় দেখা যেত, কোনো কোনোদিন ব্যাঙ্কে এত টাকা জমা পড়ছে যে, ব্যাঙ্কগুলি মাঝে মাঝে টাকা জমা নিতে অস্বীকার করতে বাধ্য হত। তবে এত টাকা জমা পড়া সত্ত্বেও সরকার বা প্রশাসন স্তরে কোনো তদন্ত হয়েছে বলে শুনিনি। আমার পরিচিত একজনই সাত লাখ টাকা ডিপোজিট করেছিল। তার তিনদিনের মধ্যে ওই কোম্পানির ওয়েবসাইট বন্ধ হয়ে যায়। ওই সাত লাখ টাকা পুরো হাওয়া হয়ে যায়। কারণ দাবি করার কোনো জায়গা ছিল না। শুধু অনলাইন। কোনো কাগজপত্র ছিল না, কোনো প্রমাণ ছিল না। আজ সারদা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। তখন এই নিয়ে প্রশাসন, সরকার, মিডিয়া কেউ কিছু বলেনি। আমি শুনেছি, এটা হয়েছে সারা ভারত জুড়ে। কোটি কোটি টাকা মার গেছে। এজেন্টরা বহুদিন এলাকা ছাড়া ছিল।
কয়েক মাস আগে শোনা গেল, এই ধরনের কোম্পানিগুলি প্রত্যন্ত গ্রামে হানা দিয়েছে। তারা সাত দিনে ডবল বা পনেরো দিনে ডবল দিচ্ছে। দিনহাটা বা আলিপুরদুয়ার — এইসব দিকে এগুলো দেখা গেছিল। সেই কোম্পানিগুলোকে পুলিশ যখন বন্ধ করতে যায়, তখন স্থানীয় আমানতকারীরাই পুলিশকে আক্রমণ করে, পুলিশের জিপ পুড়িয়ে দেয়। তবে তাদের এখন কী অবস্থা, তা জানি না।
Leave a Reply