সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ১৩ মার্চ#
স্ট্রিট ভেন্ডর্স (প্রোটেকশন অব লাইভলিহুড অ্যান্ড রেগুলেশন অব স্ট্রিট ভেন্ডিং) অ্যাক্ট, ২০১৪ অর্থাৎ ‘রাস্তায় হকারি নিয়ন্ত্রণ ও জীবিকা সুরক্ষা বিধি’ রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেয়েছে ৪ মার্চ, গেজেটে বেরিয়েছে ৫ মার্চ (http://egazette.nic.in/WriteRead-Data/2014/158427.pdf) আসুন আমরা দেখে নিই কী আছে এই নয়া কেন্দ্রীয় হকার বিধিতে।
প্রতি পাঁচ বছরে অন্তত একবার প্রত্যেকটি শহরে একেকটি টাউন ভেন্ডিং কমিটি সমীক্ষা চালাবে। সমীক্ষা চালাবার আগে এবং হকারি পরিচয়পত্র প্রদানের আগে কোনো হকারকে তার স্থান থেকে অন্যত্র সরানো বা উচ্ছেদ করা যাবে না। দুটি সমীক্ষার মধ্যবর্তী সময়কালে কমিটি ভেন্ডিং জোনে নতুন হকার বসতে অনুমতি দিতে পারে। ভেন্ডিং জোনে সেই এলাকার জনসংখ্যার আড়াই শতাংশের বেশি হকার থাকবে না। জায়গায় না কুলালে কোনো হকারকে পাশের ভেন্ডিং জোনেও স্থানান্তরিত করতে পারে কমিটি, তবে সকল হকারকে বসতে দিতে হবে কোথাও না কোথাও। সরানোর ক্ষেত্রে দেখতে হবে, যেন কোনোভাবেই হকারটির স্থাবর সম্পত্তির ক্ষতি না হয়। অন্যত্র সরালে তার জীবনধারার মান যেন কখনও না নেমে যায়।
১৪ বছরের বেশি বয়সের সমস্ত রাস্তার হকারদের হকারি পরিচয়পত্র প্রদান করতে হবে, এই লিখিত শর্তে যে, পরিচয়পত্র সম্বলিত সেই হকার, যার অন্য কোনো পেশা নেই, সে নিজে অথবা তার পরিবারের ব্যক্তিদের সহায়তায় তার ব্যবসা চালাবে। পরিচয়পত্র হবে স্থিতিশীল হকার, সচল হকার প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকারের, প্রকারভেদ ঠিক করবে রাজ্য সরকার। কোনোভাবেই পরিচয়পত্র অন্য কোনো ব্যক্তিকে হস্তান্তর করতে পারবে না। যদিও পরিচয়পত্রটি সন্তান বা সন্তানসম কাউকে হস্তান্তর করা যাবে, কেবলমাত্র তার শারীরিক অক্ষমতা অথবা দীর্ঘকালীন অসুস্থতা জনিত কারণে। মহিলা, তফশিলি জাতি, উপজাতি, পিছিয়ে থাকা অংশ, সংখ্যালঘু, বিকলাঙ্গ ব্যক্তিদের হকারি পরিচয়পত্র প্রদানে অগ্রাধিকার। নির্দিষ্ট সময় অন্তর হকারি পরিচয়পত্র পুনর্নবীকরণ করাতে হবে একটি ফি-র বিনিময়ে, সময় ও ফি রাজ্য সরকার নির্ধারণ করবে। সমস্ত পরিচয়পত্র নবীকরণযোগ্য। টাউন ভেন্ডিং কমিটি কারোর হকার পরিচয়পত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাতিল করতে পারে, হকার পরিচয়পত্রের শর্ত ভাঙার জন্য, কিন্তু তা করতে গেলে ওই হকারকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। এই বাতিল করার বিরুদ্ধে আবেদন করতে পারে হকার।
কোনো হকার যদি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বসার অনুমতি পায়, তাহলে সেই সময় ফুরিয়ে গেলে তাকে জিনিসপত্র গুটিয়ে নিতে হবে। হকারদের জায়গা পরিষ্কার রাখতে হবে এবং এর জন্য টাকা দিতে হবে পুরসভাকে। কোনো স্বীকৃত হকার এলাকার বাইরে হক করতে থাকা হকারদের ৩০ দিন নোটিশে তাকে সেই স্থান ছেড়ে দিতে বলা হবে। যদি কোনো হকার সেই সময়ের মধ্যে তার স্থান খালি করে না দেয় তাহলে সেই হকারকে দিনপ্রতি আড়াইশো টাকা জরিমানা দিতে হবে। অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সেই হকারের মালপত্র বাজেয়াপ্ত করতে পারবে অথবা তাকে বলপূর্বক সরিয়েও দিতে পারবে।
টাউন ভেন্ডিং কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন কোনো একটি এলাকাকে নো-ভেন্ডিং জোন বা হকার-মুক্ত এলাকা ঘোষণা করতে পারে, ‘পাবলিক পারপাস’-এর কারণে। সেক্ষেত্রে হকারদের ওখান থেকে উঠে যেতে হবে অন্যত্র। ওঠার নোটিশের পর তিরিশ দিন সময় পাবে হকাররা। তার পরেও না উঠলে তাকে জোর করে তুলে দিয়ে তার মালপত্র বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে, কিন্তু বাজেয়াপ্ত করার সময় কী কী বাজেয়াপ্ত করা হল, তার লিস্ট দিতে হবে হকারটিকে। হকারটি সরকার নির্ধারিত একটি ফি-র বিনিময়ে ওইদিনই বা তার পরের দিনের মধ্যে ওই জিনিসপত্র ফেরত পাবে। অথবা বাজেয়াপ্ত না করে বা জোর করে না তুলে প্রতিদিন সর্বোচ্চ আড়াইশো টাকা জরিমানা করা যেতে পারে।
হকারি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা বা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একজন সিভিল জর্জ অথবা ম্যাজিস্ট্রেট বিচারকের পৌরহিত্যে ও দুজন অন্যান্য পেশার ব্যক্তিকে (যারা সরকারি কর্মচারী নয়) সরকারের তরফে নিয়োগ করতে হবে।
সরকার থেকে উদ্যোগ নিয়ে টাউন ভেন্ডিং কমিটি তৈরি করতে হবে, তাদের অফিস করে দিতে হবে ও কাজের লোক দিতে হবে। এই টাউন ভেন্ডিং কমিটি হকার পরিচয়পত্র দেবে, রাজ্য সরকারের নীতি অনুযায়ী নো-ভেন্ডিং জোনের পরামর্শ দেবে স্থানীয় প্রশাসনকে, হকারদের রেজিস্ট্রার রাখবে, পরিচয়পত্র পুনর্নবীকরণের তারিখ জানাবে। এই টাউন ভেন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান হবে মেয়র স্থানীয় ব্যক্তিত্ব, এর সদস্যদের মধ্যে অন্তত দশ শতাংশ হবে অসরকারি সংগঠনের, অন্তত চল্লিশ শতাংশ হবে হকারদের নির্বাচিত প্রতিনিধি, যাদের মধ্যে অন্তত তিরিশ শতাংশ হবে মহিলা হকারদের প্রতিনিধি। এছাড়া থাকবে পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন, ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্ক প্রভৃতিদের প্রতিনিধি।
বিনা পরিচয়পত্রে অথবা কোনো হকার যদি তার পরিচয়পত্রে উল্লেখিত শর্ত লঙ্ঘন করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হতে পারে।
রাজ্য সরকার এই আইন বলবৎ হওয়ার এক বছরের মধ্যে নিজস্ব রুল তৈরি করবে এই আইন লাগু করার জন্য। সেই রুল তৈরির সময় খেয়াল রাখবে, নো-ভেন্ডিং জোন তৈরির নীতি নির্ধারণের সময় যেন ক) কোনো বাজার এলাকা বা নিজের নিয়মেই গড়ে ওঠা বাজারকে নো-ভেন্ডিং জোন ঘোষণা করা না হয়; খ) সর্বনিম্ন সংখ্যক হকারকে সরাতে হয়; গ) ঘিঞ্জি অজুহাতে কোনো এলাকাকে নো-ভেন্ডিং জোন ঘোষণা করা যাবে না; ঘ) কোনো এলাকায় পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে বাজার থাকলে সেই জায়গাকে ঐতিহ্যশালী এলাকা বলে ঘোষণা করতে হবে এবং কোনোভাবেই সেখান থেকে হকারদের উচ্ছেদ করা যাবে না; ঙ) বলপূর্বক উচ্ছেদ যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ ও কম করার জন্য রাষ্ট্রশক্তি সজাগ থাকবে।
এই আইনে যেমন হকারিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তেমনি অস্বচ্ছ শব্দের ‘পাবলিক পারপাস’ এলাকার অজুহাতে কোনো এলাকাকে নো-ভেন্ডিং জোনের আওতায় নিয়ে আসাকে সমালোচনা করেছে কিছু হকার সংগঠন। এছাড়াও আরেকটি উদ্বেগের জায়গা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মরশুমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ও নাগরিকদের চাহিদা অনু্যায়ী হকাররা তাদের জিনিসপত্র কেনাবেচা করে থাকে; এমনকী একই দিনে বিভিন্ন সময়ে তারা স্থান পালটে পালটে হকারি করতে থাকে নাগরিকদের চলাফেরার গতিপথ অনুযায়ী। শহরে মূলত ব্যস্ত রাস্তার দুপাশেই হকারদের বসতে দেখা যায়। অনেক হকারই এক পেশার লোক নয়, যে দুপুরে হকার, সকালে সাফাইকর্মী, বিকেলে হয়ত বাজনদার। আইন অনুযায়ী সে তো হকার লাইসেন্স পাবে না! কিন্তু দশ-কাজ করেই তো সংসার চালায় আমাদের দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ!
তাছাড়া আমাদের দেশে হকার ছাড়াও আছে ফেরিওয়ালা, সেই ফেরিওয়ালারা কি এই হকার আইনের আওতায় আসবে?
এই আইন অনুযায়ী রাজ্য সরকারের যে আইন বা বিধি তৈরি করার কথা, তাতে এইসব প্রশ্নের স্পষ্ট উল্লেখ ও মীমাংসা থাকা প্রয়োজন।
Leave a Reply