শমীক সরকার, গুপ্তকাশী, ২৯ জুলাই#
বছর চল্লিশ আগে কেদারধাম যাওয়ার উপায় ছিল কেবল পায়ে হেঁটে যাওয়া। তখন মে থেকে অক্টোবর এই ছয়মাসের সিজনে দিনে বড়ো জোর দেড়শো লোক যেত কেদারধাম। তারপর গৌরিকুণ্ড অবধি পাকা রাস্তা তৈরি হয়। সেখান থেকে কেদারধাম ১৪ কিমি পায়ে হাঁটা পথ। মাঝে রামবড়াতে হল্ট করার জায়গায় বড়ো বাজার। আর কেদারধাম পুরোদস্তুর শহর। এই আজকের কেদার।
তবে, বছর কয়েক আগের কেদার আর এখনকার কেদারের মধ্যে ফারাক আছে। দুবছর আগে অবধি মাত্র দুটো হেলিকপ্টার যাত্রী নিয়ে কেদার যেত। দুবছর আগে সংখ্যাটা বেড়ে হয় এগারো। বিভিন্ন কোম্পানির বদান্যতায় গুপ্তকাশি, উখিমঠ, ফাটার গ্রামের পাশে পাশে গজিয়েছে হেলিপ্যাড। বাড়ছে আরও। ছয়জন যাত্রী নিয়ে দিনের দিন কয়েক ঘন্টার মধ্যে কেদারে গিয়ে পুজো দিয়ে নিয়ে আসছে হেলিকপ্টার। ৭৭০০ টাকা ভাড়া মাথাপিছু। এতে সঙ্কট ঘনিয়েছে কেদারকে ঘিরে গজিয়ে ওঠা আশেপাশের কয়েকশো গ্রামের হাজার হাজার মানুষের পেশায়। তাদের কেউ সিজনে পালকি নিয়ে, যাত্রী পিঠে নিয়ে, রাস্তায় অস্থায়ী ধাবা খুলে হাজির হয়ে যেত। তাছাড়া এলাকার হোটেল ব্যবসা আর কেদারের পুরোহিত-পাণ্ডারাও দেখেছিল সিঁদুরে মেঘ। তাই ১৪ জুন থেকে ধর্মঘট চলছিল কেদারে। চলছিল অনশন। প্রশাসনের হস্তক্ষেপেও জট কাটেনি। ফলে তিন দিনের সমস্ত যাত্রী আর তাদের স্থানীয় সঙ্গীরা আটকে পড়েছিল। কেউ কেদারধামে, কেউ রাস্তায় রামবড়ায়, গৌরীকুণ্ডে, শোনপ্রয়াগে। সে কারণে ১৬-১৭ জুনের প্লাবনের সময় ওই এলাকায় প্রায় তিনদিনের সমান পর্যটক ছিল। মেখন্ডা গ্রামের লীলাদেবী থেকে বারাসুর প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, সবার এক মত — কেদারে এত মৃত্যুর কারণ এটাই।
এসব কিছুই আমরা শুনছিলাম কেদারের রাস্তায় গুপ্তকাশী-উখিমঠ এলাকায় কয়েকটি গ্রামে চিকিৎসা শিবিরে যোগ দিয়ে। সংবাদমন্থন পত্রিকার তরফে আমি আর শ্রীমান ২৪ জুলাই প্রায় কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই রওনা দিয়েছিলাম কলকাতা থেকে গুপ্তকাশীর উদ্দেশ্যে। হরিদ্বার-হৃষিকেশ এলাকায় কিছু বামপন্থী সংগঠনের তৈরি করা এই চিকিৎসা শিবিরগুলির হাতে আমরা দশ হাজার টাকা তুলে দিই। তার মধ্যে ছিল আমাদের পত্রিকার তরফে তোলা সাড়ে ছ-হাজার টাকা, আর ‘আন্দোলনের সংলাপ’ পত্রিকা কর্মীদের তোলা সাড়ে তিন হাজার টাকা। আমরা দু-দিন এই শিবিরগুলিতে অংশ নিই। ২৭ জুলাই ফাটা-র কাছে খাট, ধানীগাঁও এবং ২৮ জুলাই খাড়াই এবং মেখণ্ডা গ্রামে। ২৭ জুলাই রাতটা আমরা কাটাই ধানী গাঁও-এর শিবসিংয়ের পরিবারের আতিথ্যে।
আমরা যেসব পাহাড়ি গ্রামে গেছে, সব গ্রামেই ১ থেকে ৫৫ জন যুবক কেদারনাথের বিপর্যয়ের পর আর ফেরেনি। ঘোড়া খচ্চর যে কত মারা গেছে তার হিসেব নেই। মে-জুন মাসে স্কুলে ছুটি পড়ে। তাই একমাস রোজগারের ধান্ধায় এইসব গ্রামগুলো থেকে হাজার হাজার স্কুলপড়ুয়া কেদারে চলে গিয়েছিল। কেউ আবার এমনিই গেছিল কেদার, ছুটিতে। একটি হিসেব পাওয়া গেল এরকম, উখিমঠ এলাকারই ৫৮৬ জন হারিয়ে গেছে বা মারা গেছে। এর মধ্যে দেড়শোর বয়স ১৬-র নিচে। ১৬ জুন সন্ধ্যেয় এবং ১৭ তারিখ ভোরবেলায় যে বান আসে মন্দাকিনী উপচে গিয়ে, তার ধাক্কায় ছত্রভঙ্গ কেদার শহর থেকে পালিয়ে আশেপাশের পাহাড়গুলোতে ছুটে গিয়েছিল এই পাহাড়ি গ্রামের যুবকরা। অনেকেই তাই বেঁচে ফিরেছে। আবার অনেকেই পারেনি, ফিরে আসার পথে নদী পার হতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছে।
তবে এলাকার যত মানুষ মারা গেছে, সেই তুলনায় নেপাল থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশ, এমনকী জম্মু থেকে আসা পর্যটনশিল্পের সাথে বা রাস্তা সারাই ও অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত শ্রমিক ও পর্যটকের মৃত্যু অনেক বেশি। কারণ, পাহাড়ি অবস্থা সম্পর্কে তাদের অনভিজ্ঞতা। দৈনিক জাগরণ পত্রিকায় ২৪ জুলাই প্রকাশিত উত্তরাখণ্ড সরকারের বয়ান অনুযায়ী, নেপাল সহ ভারতের উনিশটি রাজ্যের থেকে নিখোঁজ মোট ৫৪৬৬ জন। তার মধ্যে উত্তরাখণ্ডের ৯৩৪ জন। তার মধ্যে এই রুদ্রপ্রয়াগ জেলা (যেখানে কেদারঘাটি) থেকেই ৬৫৩ জন। এটা শুধু নিখোঁজের হিসেব। মৃতদেহ যাদের পাওয়া গেছে, সেই হিসেব আলাদা। স্থানীয়দের মত, মোট মৃত কুড়ি হাজারের মতো।
উত্তরাখণ্ড সরকার মৃত ও নিখোঁজদের জন্য পাঁচ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। কেউ বলছে, ডেথ সার্টিফিকেট দিলে তবেই মিলবে এই টাকা, অর্থাৎ শুধু মৃতদের ক্ষতিপূরণ. কারো বক্তব্য, নিখোঁজদেরও দেওয়া হবে। পরে ফিরে এলে ফেরত দিতে হবে। নইলে শাস্তি। একটা খচ্চর কিনতে লাগে এক লাখ টাকা, কিন্তু খচ্চরের ক্ষতিপূরণ ২০ হাজার। তেমনি পালকি পিছুও কিছু ক্ষতিপূরণ ধরা হয়েছে। কিন্তু কত তা শুনলাম না।, কেদার এলাকায় প্রতিদিন কত পালকি, খচ্চর, শ্রমিক, পর্যটক, ধাবা, পুরোহিত, পূজারি আসে যায় — তার সরকারি হিসেব থাকে। থাকে সিজনাল রেজিস্ট্রেশন। তার জন্য এমনকী যারা কাঁধে করে যাত্রীদের নিয়ে যায়, সেই ‘পিঠুবালী’দেরও মাথা পিছু ৭০০ টাকা করে দিতে হয় প্রশাসনকে। তবে দলিত অধ্যুষিত মেখন্ডা গ্রামের দশটি পালকির মালিক লাক্কি জানায়, যদি আশি শতাংশ লিখিত হয়, কুড়ি শতাংশ অলিখিত বা বেআইনি সবকিছুর মধ্যেই আছে। তাদের হিসেব কে রাখে?
কেদারঘাটি যাওয়ার রাস্তার আশপাশের এই গ্রামগুলোতে অন্যান্য পাহাড়ি গ্রামের তুলনায় অনেক বেশি স্বচ্ছলতা আছে, তা কেদারকে ঘিরে এই ছ-মাসের ব্যবসার কারণে। লাক্কিলালের কথায় ‘কেদার ফ্যাক্টরি’। এটা শুনে যারা কেদার-ব্যবসায় জড়িত নয়, তারা অনেকেই চটে গেল। বাড়াসু গ্রামের প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক যেমন বললেন, কেদারে এত লোকের সমাগম ভালো নয়। এখানে আজকাল অনিল আম্বানি এসে পুজো দেয়। এতে তো কোরাপশন বাড়বেই, না? একেকজন পাণ্ডা পুরোহিত কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। এই যে সব ধ্বংস হয়ে গেছে, ফের কি কেদার যাত্রা শুরু হবে? তাঁর কথায়, সরকার বা কোম্পানিগুলো কেদার যাত্রা শুরু করেনি। করেছিল জনসমাজ, সাধু-সন্তরা। ফের কেদারের পথ খুঁজে নেবে ওই জনসমাজই। উত্তর ভারতের জনসমাজ।
তবে আমাদের চিকিৎসা শিবিরের মাধ্যমে আমরা যে চিত্র দেখেছি, তাতে এতটা আশাবাদী হতে পারিনি। চিকিৎসা শিবিরের সংগঠক মুনিশ ভাই বলছিলেন, ২০০১ এবং ২০১১-র জনগণনা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, উত্তরাখণ্ডের অন্তত দুটি পাহাড়ি জেলা, আলমোড়া এবং পৌরিতে জনসংখ্যা কমে গেছে, বাড়ার বদলে। দিল্লিতে লক্ষ লক্ষ উত্তরাখণ্ডী চলে গেছে। চাষবাসের হাল এখানে ভালো নয়, কারণ নতুন রাজ্য উত্তরাখণ্ডের পথ চলাই শুরু হয়েছিল চাষের বদলে পর্যটনকে উন্নয়নের মূল অক্ষ ধরে নিয়ে। একটা প্রমাণ, আগে এখানে গাড়ি চলতে পারে এমন রাস্তা ছিল ৮ কিমি। গত ১০ বছরে উত্তরাখণ্ডের আমলে তৈরি হয়েছে ১৫ কিমি রাস্তা। কিন্তু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং পর্যটনের কারণে ও রাস্তা তৈরির কারোণে মুহুর্মুহু ব্লাস্টিং-এর ফলে নড়ে গেছে পাহাড়। একটু মেঘভাঙা বৃষ্টিতেই ভূমিধ্বসে মারা যায় প্রচুর মানুষ।
গত বছর উখিমঠে এক মেঘভাঙা বৃষ্টিতে ভূমিধসে প্রায় একশো মানুষ মারা গিয়েছিল। এবার ধ্বংস হল কেদারঘাটি। পাহাড় থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই হতে পারে রুদ্রপ্রয়াগ জেলাটিকেও।
Leave a Reply