দীপংকর সরকার, হালতু, ১৬ জানুয়ারি#
কৃষ্ণপুর খুব একটা সুদুরের গ্রাম নয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মস্থান দেবানন্দপুর গ্রামের কাছেই। জি টি রোড ধরে আদিসপ্তগ্রাম থেকে দেবানন্দপুর মোড়ে গেলে, একটা লাল মাটির এবড়োখেবড়ো মোড়াম বিছানো ধুলি ধূসরিত রাস্তা এঁকেবেঁকে গিয়েছে কৃষ্ণপুরের দিকে। ত্রিবেণী থেকে বাহিত, হারিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদী এই জায়গা দিয়ে বহমান। সেই নদীর তীরের জায়গাটাকে লোকে কৃষ্ণপুর বলে ডাকত। প্রতিবছর ১লা মাঘ সকালে সেখানে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের পাশে বিশাল মাঠ জুড়ে মাছের মেলা বসে। ১৫-২০ কিলো ওজনের রুই, কাতলা, মৃগেল, ভেটকি বিভিন্ন স্টলে সাজানো থাকে। বড়ো বড়ো ঝুড়িতে থাকে একদাঁড়া কাঁকড়া। কেনাকাটা, দর কষাকষিতে চারিদিক সরগরম। ১৫-২০ কিলো সাইজের বিভিন্ন রকম মাছ এখান থেকে নিয়ে মানুষ যায় দূর দুরান্তে। আশেপাশের ব্যান্ডেল, কে বাজার, পাণ্ডুয়া, মগরা, চন্দননগর থেকে অনেক ব্যবসায়ী ও মৎস্যবিলাসী আসে ব্যাগ ভর্তি করে মাছ নিয়ে যেতে অতি সস্তায়। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য।
বাংলায় দ্বিতীয় কোনো এরকম মেলা আছে কিনা আমার জানা নেই। এই মেলা অন্তত পাঁচশো বৎসরের পুরোনো। গ্রামের পাশেই ইতিহাস প্রসিদ্ধ সপ্তগ্রাম বন্দর। সপ্তগ্রামের রাজা ছিলেন হিরণ্যদাস মজুমদার। ১লা মাঘ থেকে মেলা শুরু হয়। এই তথ্য দিলেন গ্রামের রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের সেবায়েত শৈলেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী।
অনেকে শুধু পিকনিক করার উদ্দেশ্যে ১লা মাঘ এই মেলা থেকে মাছ কিনে ঢুকে পড়ে কৃষ্ণপুর দেবানন্দপুরের আমবাগানে। সেখানে যত খুশি খাও মহাভোজে মেতে ওঠে তারা। আসে মৎস্যজীবী মৎস্য বিক্রেতারা। কৃষ্ণপুর দেবানন্দপুরের বাড়ি বাড়ি এই সময় আত্মীয়রা ভিড় করে নানান মজার দৃশ্য দেখার জন্য। মাছ তো কেনে, নানা প্রজাতির বিশালাকৃতি মাছেদের গমগম মৎস্য মেলা। মেলায় পাওয়া যায় ১০-১৫ কিলো ওজনের ভেটকি ও সামুদ্রিক শংকর মাছ। ভোলা ভেটকি, কই ভেটকি, চাঁদা ভেটকি, গুড়জালি, আড়, ট্যাংরা, হালুয়া, কয়েক ফুট লম্বা পাঙ্গাশ, রূপচাঁদা, পায়রা চাঁদা ইত্যাদি মাছ। চ্যাং শোল, বোয়াল, ল্যাটা মাছ। এক সময়ে এখানে দেখা যেত বাঙোষ, কাকলেশ, বান, গুঁতে, পাঁকালির মতো লুপ্তপ্রায় প্রজাতির কিছু মাছ। এবারের মেলাতে পঞ্চান্নটি মাছ ও সতেরটি কাঁকড়ার স্টল। কাঁকড়াগুলো এক দাঁড়ার। মেলায় এই একদাঁড়া কাঁকড়ার কিলো ৬০-৭০ টাকা। দুই দাঁড়ার কাঁকড়া এখন দেখা যায় না, বিদেশের বাজারে এর চাহিদা থাকায় সব বিদেশে রপ্তানি হয়।
আমি মেলার তারিখটা প্রথমে জানতাম না, কেবল শোনা কথার ওপরই ভরসা করে ১১ মার্চ ২০১২-এর এক রবিবারের সকালে হাওড়া থেকে সকাল ৬-২০ বর্ধমান লোকালে নামলাম আদিসপ্তগ্রাম স্টেশনে। নেমে কৃষ্ণপুর মেলার কথা জিজ্ঞাসা করলাম রিক্সাওয়ালাকে। বললেন ৬০ টাকা লাগবে আসা-যাওয়া। আমি পঞ্চাশ টাকা বলাতে রাজি হলেন না তিনি। আমি হেঁটেই চললাম। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর একটা সাইকেল ভ্যানওয়ালা বললেন কলেজ মোড় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি। গেলাম সেই ভ্যানে চেপে জি টি রোডে। ভ্যানওয়ালা আমার থেকে কোনো পয়সা নিলেন না। জি টি রোড পার হয়ে উল্টোদিকের মোড়াম বিছানো রাস্তা ধরে আবার হাঁটা শুরু করলাম কোনো সাইকেল ভ্যান না পেয়ে। হাঁটতে হাঁটতে একটা ইটভাটা চোখে পড়ল। চারিদিকে ধুলো উড়ছে। উঁচু নিচু ধুলি ধূসরিত রাস্তা। গ্রামে কোনো বিদ্যুতের লাইন চোখে পড়ল না। খুব একটা সম্পন্ন গ্রাম বলে মনে হল না। ৫০-৬০ বছর পূর্বে ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থা। গ্রামের আনাচে-কানাচে দেশি মদ তৈরির বিশাল বিশাল হাঁড়ি জড়ো করে রাখা হয়েছে। এটাই এখানকার বিশেষ জীবিকা।
কিছুদূর যাওয়ার পর পৌঁছালাম রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের সামনে। মন্দিরের সামনের সিঁড়িতে বসে আছেন সেবায়েত শৈলেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী। তিনি তখন পেপার পড়ছিলেন। কথার মাঝে তিনি মাছের বর্ণনা দিলেন। তিনি আমায় বললেন, ১লা মাঘ আসবেন, তাহলে সে অভিজ্ঞতা হবে অনেক রোমাঞ্চকর এবং বাংলার চেনা দেশের অজানা এক মেলাকে প্রত্যক্ষ করবেন। কথিত আছে এই মেলা নাকি প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো। আমি আসছে ১লা মাঘে যেতে চলেছি সেই মৎস্য মেলায়। আপনারাও আসবেন নাকি বিরল এই মেলাকে প্রত্যক্ষ করতে?
Leave a Reply