১৭ এপ্রিল কুদানকুলামের পরমাণু বিরোধী জনআন্দোলনের থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয় তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাকে।#
————————————
কুদানকুলাম পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প বর্তমানে একটি ভয়ানক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলছে। এবিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং শীঘ্র ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
১) জিও-পোডোলস্ক এর নিচুমানের এবং খারাপ যন্ত্রপাতি সরবরাহ
রাশিয়ান কোম্পানি রোসাটম-এর সাবসিডিয়ারি জিও-পোডলস্ক সরবরাহ করা ভেজাল ও নিচুমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি হয়েছে কুদানকুলাম পরমাণু প্রকল্প। কোম্পানির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেই ঘোষণা রয়েছে, ‘গত কয়েকবছর ধরে জিও-পোডলস্ক বিদেশি বেশ কিছু ভিভিইআর-১০০০ চুল্লির পরমাণু প্রকল্পের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে : তিয়ানওয়ান (চিন), বুশের (ইরান), কুদানকুলাম (ভারত) (http://aozio.ru/production/ob-atom/). জিও-পোডলস্ক ২০০৭ বা তার আগে থেকেই ভেজাল যন্ত্রাংশ সরবরাহ শুরু করেছে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের কেনা-বেচা শাখার ডিরেক্টর সেরগেই শুতভ গ্রেপ্তার হন, উচ্চমানের যন্ত্রাংশ কিনছে দেখিয়ে তার বদলে নিচুমানের এবং সস্তা কাঁচামাল কিনে বাদবাকি টাকা পকেটস্ত করার দায়ে। ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস, রাশিয়ায় কেজিবি-র উত্তরাধিকার বহন করা গোয়েন্দা সংস্থা এই মামলাটির তদন্ত করছে। এই ঘটনার গভীর প্রভাব আছে রাশিয়ার বানানো পরমাণূ চুল্লিগুলির ওপর।
২০১২ সালের ১৫-১৮ জানুয়ারি ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জির একটি প্রতিনিধিদল (যাতে ছিলেন স্পেশ্যাল সেক্রেটারি এ পি জোশি, ডেপুটি সেক্রেটারি নিনিয়ান কুমার, অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের ম্যানেজার জোগেশ পাডি) জিও-পোডলস্ক-এ যান এবং কুদানকুলাম পরমাণূ প্রকল্পের অগ্রগতি, কবে তা চালু হবে এইসব বিষয়ে আলোচনা করেন (সূত্র : অ্যাটমএনার্জিমাশ ১৯ জুলাই ২০১২)
কিন্তু নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেডকে ২৮ জানুয়ারি ২০১৩ সালে একটি আরটিআই-তে যখন জানতে চাওয়া হয়, জিও-পোডলস্ক কুদানকুলামে কি কি যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে, তারা ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তে দায়সারাভাবে উত্তর (No. NPCIL/VSB/CPIO/2460/HQ/2013/371) দেয়, ণ্ণজিও-পোডলস্ক-এর বিরুদ্ধে কোনও তদন্তের কথা এনপিসিআইএল-এর জানা নেই।’ এটা একটা সর্বৈব মিথ্যে এবং ধোঁকা দেওয়া। কারণ ডিএই অফিসিয়ালরা তখন সদ্য জিও-পোডলস্ক ঘুরে এসেছেন এবং তারা নিশ্চয়ই সেখানকার ঘটনাবলী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এনপিসিআইএল ভারতীয় জনগণের থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করছে এবং গোটা জাতিকে ভুলপথে চালিত করছে সম্ভবত কিছু রাশিয়ান এবং ভারতীয় দালাল ও মুনাফাবাজদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য।
যখন আমরা অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড কে ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি কুদানকুলামে জিও-পোডলস্কের সরবরাহ করা যন্ত্রাংশের তালিকা চেয়েছিলাম, তারা ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ উত্তর দিয়েছিল, এনপিসিআইএল কাদের কাছ থেকে যন্ত্রাংশ নেবে তা এইআরবি-র আওতায় পড়ে না। তবে ডিজাইন, তৈরি এবং অপারেশন চালু করার কাজের কোয়ালিটি অ্যাসিওরেন্স-এর বিষয়ে এইআরবি-র নথিতে যে কোয়ালিটি কোড আছে, কুদানকুলাম চুল্লির নিরাপত্তা পর্যালোচনার সময় তা মেনে চলা হয়েছে।’
রাশিয়ার আরেকটি কোর্টে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন আলেক্সান্ডার মুরাক নামে এক ব্যক্তি। সে আরেক কুখ্যাত রাশিয়ান কোম্পানি ণ্ণইনফরমটেক’ এর — তাঁর তিন বছর জেল হয়েছে নকল মাপক যন্ত্র পরমাণু ও জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের টারবাইনে সরবরাহ করার দায়ে। পরমাণু পার্কের মধ্যে নিচুমানের এবং ভেজাল যন্ত্রাংস ঢোকার মানে হল তামিলনাড়ু, কেরল এবং অন্যান্য জায়গার কোটি কোটি মানুষের ব্যাপক বিপদের আশঙ্কা, তাই এই বিষয়টিকে নিবিড়ভাবে তদন্ত করতে হবে রোসাটম, অ্যাটমস্ট্রয়েক্সপোর্ট, রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা, এবং সর্বোপরি ভারতের স্বাধীন পরমাণু বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে।
২) চুল্লির ডিজাইন অবহেলা করা এবং তাতে পরিবর্তন করা
যখন কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষজ্ঞ দলের সাথে পরমাণু শক্তি বিরোধী জনআন্দোলনের কথা ভেস্তে গেল আমাদের ওপর কংগ্রেস পার্টি এবং হিন্দু মুন্নানি-দের হিংসাত্মক আক্রমণের কারণে, তখন আপনি চারজনের একটি দলকে নিয়োগ করেছিলেন কুদানকুলাম পরমাণু প্রকল্পের বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখার জন্য। ওই দলের মধ্যে ছিলেন ড. এম আর শ্রীনিবাসন, যিনি অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান-ও বটে। আমরা ওই দলে তার অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিলাম। যদিও তিনি দলে ছিলেন এবং আমরা ওই দলের সঙ্গে ২০১২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আলোচনা করি তিরুনেলভেলিতে।
আমাদের কথাবার্তার সময় উপস্থিত ছিলেন তিরুনেলভেলির জেলাশাসক এবং অন্যান্য অফিসাররা। শ্রীনিবাসন কখনও বলেননি, চুল্লির ডিজাইনে পরিবর্তন করেছে ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি। আপনার কাছে তারা যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেখানে তারা এই ডিজাইন পরিবর্তনের কথা বলেছে কি না, সেকথাও কোথাও প্রকাশ্যে বলেনি। যদিও শ্রীনিবাসন জনসমক্ষে স্বীকার করেছে, ণ্ণফুকুশিমা বিপর্যয়ের অনেক আগেই আমরা অতিরিক্ত নিরাপত্তা বন্দোবস্ত চেয়েছিলাম। এই নিরাপত্তা বন্দোবস্ত মানে হল কিছু অতিরিক্ত ভালভ লাগানো। মূল চুল্লির ডিজাইনে কিছু পরিবর্তন করার মাধ্যমেই তা করা যায়, এবং আমার মনে হয় এই জন্যই দেরি হচ্ছে’. তাঁর মতে এই ভালভগুলি কিছু রাশিয়ায় আর কিছু ভারতে তৈরি হয়েছে, এবং চুল্লির সঙ্গে তা মিলতে অসুবিধা হচ্ছে বলেই এই দেরি হওয়া (http://newindianexpress.com/states/tamil_nadu/article1517314.ece)।
কুদানকুলাম পরমাণু চুল্লির মূল ডিজাইনের পরিবর্তন ঘটানোর পর, ভারতীয় কর্তাব্যক্তিরা তাতে কিছু নতুন জিনিস ফিরে ঢুকিয়েছেন এবং তার বিশদ বিবরণ কাউকে জানাননি। এ সমস্ত কিছুই রাশিয়ান চুল্লির মৌলিক ঘাটতির দিকে আঙুল তোলে। ডিজাইনে অদলবদলে তা আরও দুর্বল হয়। এবং তাতে নতুন যন্ত্রাংশ লাগালে তার বিশ্বস্ততাও আর থাকে না। যেহেতু এই ব্যাপারগুলির সঙ্গে কোটি কোটি মানুষের বেঁচেবর্তে থাকা জড়িত, তাই এসবের বিশদ বিবরণ জনগণকে জানানো দরকার।
৩) আসলে ঘাটতি পরমাণু অদক্ষতা এবং অপটু ইঞ্জিনিয়ারিং-এর, দোষ দেওয়া হয় প্রতিবাদকে
রাশিয়ান এবং ভারতীয় পরমাণু কর্তৃপক্ষ তাদের দুর্নীতি, অপচয় এবং অদক্ষতাকে আড়াল করে এবং প্রতিবাদের ঘাড়ে দোষ চাপায় পরমাণু চুল্লি চালু হতে দেরি হওয়ার জন্য। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় বলা হয়েছে, ণ্ণদেরির কারণ রাশিয়া থেকে যা মাল সরবরাহ হয়েছিল তার অনেক কিছুই প্রতিস্থাপিত করতে হয়েছে। এবং কিছু যন্ত্রাংশ জাহাজে করে আনতে হয়েছে।’ কুদানকুলাম পরমাণু প্রকল্পের সূত্রটি স্বীকার করেছে, ণ্ণপরমাণু চুল্লির কনটেনমেন্ট ভেসেলটি পরিবর্তন করতে হয়েছে, কারণ পুরনোটিতে ফুটো হয়ে গেছে, যা তিনমাস আগে টেস্টিং-এর সময় ধরা পড়ে।’ (http://newindianexpress.com/states/tamil_nadu/article1517314.ece).
কুদানকুলাম কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ণ্ণ২ নং ইউনিটের জন্য যেসব যন্ত্রাংশ কিনে গুদামে রাখা হয়েছিল, সেগুলি এই ১ নং ইউনিটের যন্ত্রাংশ পাল্টানোর কাজে ব্যবহার হয়ে গেছে।’ এটাও পরিষ্কার নয়, কেন তারা ২ নং ইউনিটের যন্ত্রাংশ কিনে গুদামে ফেলে রেখেছিলেন, কারণ ১ নং ইউনিটের সঙ্গে সঙ্গেই ২ নং ইউনিটের কাজও তো চলার কথা। আসলে পরমাণু কর্তৃপক্ষ যে কথা চেপে যাচ্ছে, তা হল, ১ নং ইউনিটটি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা তাই জন্যই ২ নং ইউনিট থেকে যন্ত্রাংশ নিয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কেউ জানে না, ভারতকে মোট কত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে এই সব এদিক ওদিক করার জন্য।
শ্রীনিবাসের স্বীকারোক্তি অনুসারে কুদানকুলাম প্রকল্পের ১ নং চুল্লিটির এই হাল হয়েছে প্রতিবাদ এবং সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা ঝুলে থাকার জন্য। এটা জঘণ্য মিথ্যে কথা! এমনকি যখন আমাদের আন্দোলন চলছিল ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত, তখনও কুদানকুলাম প্রকল্পে নিয়মিত এবং পুরোদমে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলেছে প্রতিদিন। যখন তামিলনাড়ু সরকার আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করল ১৯ মার্চ ২০১২ এবং আমাদের ইদিনথাকারাই গ্রামের দিকে ঠেলে সরিয়ে দিল, কুদানকুলাম প্রকল্পের সাইট ডিরেক্টর আর এস সুন্দর বলেছিলেন, চুল্লি ঠাণ্ডা করার জন্য যে জল লাগে, তার ণ্ণওয়াটার কেমিস্ট্রি’-র রিপোর্ট খুবই উৎসাহব্যঞ্জক, কারণ প্রতিবাদ যখন চলছিল তখন প্রাথমিক রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক বন্দোবস্ত ছিল (P. Sudhakar, “Croatian experts to inspect the condition of equipment,” The Hindu, March 23, 2012)।
কুদানকুলাম পরমাণু প্রকল্পের বরিষ্ঠ মেইনটেনান্স ইঞ্জিনিয়ার এস টি আরাসু বলেছিলেন, ণ্ণআমরা সমস্ত পাম্পগুলি চালিয়ে কম্পনের সীমা মেপে দেখেছি। তা সীমার মধ্যে এবং এটা আমাদের কর্মীবাহিনীর দক্ষতার ফসল। যদিও এই অংশটি সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি গত সাড়ে পাঁচ মাসে, কারণ যন্ত্রাংশগুলি আশ্চর্যজনকভাবে কাজ করেছে (P. Sudhakar, “Employees at Kudankulam project site a charged lot,” The Hindu, March 24, 2012)।
ইয়েভগেনি দুদকিন, রাশিয়ান স্পেশ্যালিস্ট গ্রুপের প্রধান বলেছেন, অ্যাটমস্ট্রয়েক্সপোর্টের কোনও বিশেষজ্ঞ প্রতিবাদের দিনগুলিতে সাইট ছেড়ে চলে যাননি। তিনি ইঙ্গিত দেন, কিছু অতিরিক্ত কাজ করা দরকার, এবং বলেন, ণ্ণএটা কোনও বিশাল কাজ নয়’। (P. Sudhakar and S. Sundar, “Primary coolant pumps to undergo another trial,” The Hindu, March 29, 2012.)
একইরকমভাবে, যখন সুপ্রিম কোর্ট সেপ্টেম্বর ২০১২ তে একরাশ পিটিশনের ওপর শুনানি শুরু করেছিল, এবং কুদানকুলাম কর্তৃপক্ষকে কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়নি। অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ড বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তামিলনাড়ু এবং কেরালার লড়াকু মানুষদের অনুভবকে পাত্তা না দিয়ে জ্বালানি সংযোগের অনুমতি দেয়।
কিন্তু এখন কুদানকুলাম কর্তৃপক্ষ, ভারতের পরমাণু শক্তি কর্পোরেশন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং পরমাণু শক্তি ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা কুদানকুলাম পরমাণু প্রকল্প কমিশনিং করতে তাদের নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে দোষ দিচ্ছে, ণ্ণসমুদ্রের জল ব্যবহার করে ঠান্ডা করার কারণে হওয়া ক্ষয় এবং লিক’-এর ওপর। যদি এইটুকু সময়েই পাইপগুলি লিক হয়ে যায় এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তাহলে সরকারের রাশিয়ানদের পাঠানো পাইপ এবং যন্ত্রাংশগুলির গুণমান যাচাই করার জন্য তদন্তের নির্দেশ দেওয়া উচিত। যদি এইসব পাইপগুলি একবছর সমুদ্রের জল সহ্য না করতে পারে, তাহলে সেগুলি কীভাবে নিরাপদে ৪০-৬০ বছর চলবে?
৪) আকাশছোঁয়া খরচ, পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি
রাশিয়ার সঙ্গে ভারত যতগুলি চুক্তি করেছে, প্রতিটিই বিপর্যয় এবং ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইএনএস বিক্রমাদিত্য/অ্যাডমিরাল গোরশকভ এয়ারক্র্যাফট বাহকের বেলায় পাঁচ বছর দেরী হয়েছিল, এবং খরচ দাঁড়িয়েছিল ২.৯ বিলিয়ন ডলারের মতো। সময় পেরিয়ে যাওয়া এবং খরচ ছাপিয়ে যাওয়া আরেকটি নিদর্শন ভারত-রাশিয়া সুরক্ষা চুক্তি, মিগ-২৯ ফাইটার প্লেন উন্নতিকরণ। কুদানকুলাম পরমাণু প্রকল্প আরেকটি বিপর্যয়।
কুদানকুলাম ১ এবং ২ নং চুল্লির জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি এবং এনপিসিআইএল দাবি করে, তারা আরও ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। কেউ জানে না কুদানকুলাম প্রকল্পে এখনও অবদি মোট কত খরচ হয়েছে, এবং কোন কোন খাতে তা গেছে। প্রাক্তন এইআরবি প্রধান ড. এ গোপালকৃষ্ণন দাবি করেছেন, ২০০৬ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াটের হালকা জল চুল্লি (লাইট ওয়াটার রিয়াক্টর) আমদানি করার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন বা ওই ধরণের কোনও সংস্থার কোনও প্রাযুক্তিক-অর্থনৈতিক মূল্যায়ন ছাড়াই করা হয়েছিল। গোপালকৃষ্ণনের মতে, ণ্ণএই সিদ্ধান্ত, দরদাম, এবং সরবরাহের শর্তাবলী তাড়াহুড়ো করে নির্ধারণ করেছিল ইউপিএ-২ সরকার। তার কারণ ছিল, যাতে প্রধানমন্ত্রী এইসব বিদেশি সরকারগুলি ও তাদের কোম্পানিগুলি দেওয়া কথা রাখতে পারেন তাঁর সময় শেষ হওয়ার আগেই। এটা ছিল একটা ব্যবসায়িক লেনদেন, যাতে ওইসব দেশের চুল্লি নির্মাতারা ভারতকে পরমাণু সরবরাহকারী গোষ্ঠী বা নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপ-এর ছাড়পত্র পেতে সাহায্য করে।
রাশিয়ান পরমাণু কোম্পানি, অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট সম্প্রতি তার অর্থনৈতিক বিবৃতি (২০১১ সালের) প্রকাশ করেছে। তাতে দাবি করা হয়েছে, ২০১১ সালের ক্ষতি ২০১০ সালের দ্বিগুণ। এবং এই কোম্পানিটি দেউলিয়া হবার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। এর ফলে ইরানের বুশের এবং ভারতের কুদানকুলামে রাশিয়ান পরমাণু প্রকল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে (http://www.interfax.ru/business/txt.asp?id=283928)। আমাদের সন্দেহ, ভারত সরকার গোপনে রাশিয়ান কোম্পানিটিকে ক্ষতি এবং দেউলিয়া হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচতে সাহায্য করছে কিনা।
এনপিসিআইএল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, কুদানকুলামে বাড়তি যে ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে, তার কারণ ণ্ণনির্মাণের সময় সুদের হার বেড়ে যাওয়া’, কাজ বেড়ে যাওয়া, কন্ট্রাক্টরদের ওভারহেড এবং এস্টাবলিশমেন্ট চার্জ (RTI reply dated February 20, 2013)। একথা এখানে উল্লখ করা দরকার, রাশিয়ান সরকার ভারত সরকারকে এইসব বিলম্ব এবং বাড়তি খরচের জন্য কোনও ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না। বদলে, এইসব গোলোযোগ ব্যাখ্যা করে ভারতের রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার কাদাকিন ভারতবাসীকে বিভ্রান্ত করেছেন, দেশের আভ্যন্তরীন বিষয়ে অবাঞ্ছিত মন্তব্য করেছেন।
৫) প্রতি ১৫ দিনে একবার করে কুদানকুলাম প্রকল্প কমিশনিং করার কথা বলা
ভারতবাসীকে কুদানকুলাম পরমাণু পার্কের কী হাল সে সম্পর্কে অবহিত না করে প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ আফ্রিকা গিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতিকে কুদানকুলামের কমিশনিং-এর ব্যাপারে আশ্বাস দিয়ে আসেন। যখন প্রধানমন্ত্রী মস্কো গিয়ে ১৫ ডিসেম্বর ২০১১ রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে আশ্বাস দিয়ে এসেছিলেন, দু-সপ্তাহের মধ্যে কুদানকুলামের কমিশনিং হয়ে যাবে, আপনি (তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী) অখুশী হয়েছিলেন।
কুদানকুলামের কমিশনিং-এর তারিখ গত এক বছরে প্রায় ২০ বার বদলেছে রাজনীতিকরা, আমলারা, আর পরমাণু কর্তাব্যক্তিরা। বাস্তবে, এই ণ্ণকমিশনিং-এর তারিখ’ প্রক্রিয়াটি ২০০৫ সাল থেকে চলছে, যখন ভারত সরকারের রাষ্ট্রমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী নিজে হিসেবনিকেশ করে বাজে কথা বলা এবং ভুলভাল তথ্য প্রচারের রেকর্ড করেছিলেন। এইসব লোকে দেশকে মিথ্যে কথা বলে চলেছে বারবার এবং বেপরোয়াভাবে। তাই আমরা এইসব কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের এবং আমাদের পরিবারের নিরাপত্তা ও সুস্থতা সঁপে দিতে পারি না। যদি ভারতবর্ষের লোকতন্ত্রে সত্য এবং নীতির কোনও ব্যাপার থাকে তাহলে এইসমস্ত অফিসিয়ালদের এক্ষুনি পদত্যাগ করা উচিত।
৬) তথ্য নেই, দায় নেই, দূষণ থেকে সুরক্ষা নেই
ভারত সরকার এবং ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি আমাদের কুদানকুলাম পরমাণু প্রকল্প বিষয়ে কোনও তথ্য দেয়নি। কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশন তাদের নির্দেশ দিয়েছে, তবুও তারা সাইট এভালুয়েশন রিপোর্ট এবং সেফটি অ্যানালিসিস রিপোর্ট আমাদের দেয়নি। তারা আমাদের মত শোনেনি, পরিষ্কার জলের বন্দোবস্ত বিষয়ে আমাদের ভয় ও চিন্তা দূর করেনি, চুল্লির প্রেশার ভেসেলের ডিজাইন এবং তরল ও কঠিন বর্জ্য প্রভৃতি বিষয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা তারা পাত্তা দেয়নি।
ভারতের পরমাণু কর্তৃপক্ষ রাশিয়ান সরকারের বা কোম্পানিগুলির কাছ থেকে কুদানকুলাম ১ ও ২ নং চুল্লি বিষয়ে কোনও দায়বদ্ধতার আশ্বাস পায়নি। ২০০৮ সালে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে যে আন্তঃ-সরকার গোপন চুক্তি হয়েছে সে বিষয়েও তারা লোককে কিছু জানায়নি। আমরা ১ ও ২ নং চুল্লি নিয়ে কথা বলছি যখন তখন ভারত সরকার তামিলনাড়ু তথা স্থানীয় জনগণের অনুভূতির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে কুদানকুলামে ৩ ও ৪ নং প্রকল্পের কথা ঘোষণা করে দিয়েছে।
তামিলনাড়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সমুদ্রে ব্যাপক পরিমাণ ময়লা, আবর্জনা, সমুদ্র-জল পরিশোধন কারখানা থেকে বেরোনো বর্জ্য, দ্রবীভূত ও অদ্রবীভূত কঠিন পদার্থ, স্টিম জেনারেটরের বর্জ্য, জল থেকে খনিজ নিষ্কাশনের বর্জ্য এবং অন্যান্য বর্জ্য সমুদ্রে ফেলার ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এই বর্জ্যের তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি নির্ধারণ করেছিল, তারপর তা কমিয়ে ৩৬-৩৭ ডিগ্রি করেছে। তারা কুদানকুলাম কর্তৃপক্ষকে বিশাল পরিমাণ সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, আরও কিছু কণা এবং ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় দূষক বাতাসে ছাড়তে অনুমতি দিয়েছে। কেউই সমুদ্র, সমুদ্রের খাবার, সমুদ্রের প্রাণী, গবাদি, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং আমাদের ও আমাদের সন্তানসন্ততিদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার ওপর এসবের প্রভাব নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়।
এমনকি আমরা যখন সুপ্রিম কোর্টের কুদানকুলাম নিয়ে মামলার রায়ের অপেক্ষায় আছি, তখন প্রকাশ পাচ্ছে, এনপিসিআইএল তামিলনাড়ু কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোস্টাল রেগুলেশন জোন নোটিফিকেশন ২০১১ বিষয়ক ছাড়পত্র নেয়নি।
৭) তামিলরা পাচ্ছে দুর্ভোগ, অন্যরা পাচ্ছে শক্তি!
যদিও আপনি প্রধানমন্ত্রীকে ৩১ মার্চ, ২৫ এপ্রিল এবং ১৯ আগস্ট ২০১২ তে চিঠি লিখেছিলেন, কুদানকুলাম থেকে প্রাপ্য সমস্ত বিদ্যুৎ যাতে তামিলনাড়ু পায় তার জন্য, প্রধানমন্ত্রী এবং তার দপ্তর কখনও আপনার চিঠির প্রাপ্তিস্বীকার করেনি। আগে আপনি কেন্দ্রীয় পুল থেকে বেশি বিদ্যুৎ চেয়েছিলেন, বিভিন্ন শক্তি কেন্দ্রের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু ইউপিএ সরকার সবসময় আপনার ন্যায্য দাবি অবজ্ঞা করে এসেছে। বাস্তবে ২০১২ সালের মার্চ মাসের আগে আমাদের বেশিরভাগ মিছিল মিটিং হয়েছিল আপনার বিভিন্ন স্কিম ও দাবিগুলিকে নিয়ে।
যদি এভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের একজন মুখ্যমন্ত্রী ও তামিল জনগণের জনপ্রিয় নেত্রীকেই হেলাফেলা করা হয়, তাহলে গরীব-গুর্বো আমরা যারা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে দু-বছর ধরে লড়াই করে যাচ্ছি, তাদের প্রতি ওদের কী দৃষ্টি তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনি। দিল্লির কুলীন-রা তামিল মৎস্যজীবী, তামিল মহিলা, তথা সামগ্রিক তামিল জনগণের প্রতি কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই।
এটা আরও অবাক করার মতো ব্যাপার, আমাদের প্রতিবেশি রাজ্য আমাদের এমনকি প্রাকৃতিক সম্পদ নদীর জলটুকুর ভাগ দেবে না, আর আমাদের তামিল জনগণকে পরমাণু বর্জ্য, তাপ দূষণ, নোনা বর্জ্য, এবং সবথেকে বড়ো কথা, পরমাণু বিকীরণ সহ্য করতে হবে আর ঝুঁকি ব্যতিরেকে নিদ্যুতের ভাগ নিয়ে যাবে অন্যরা। কী অন্যায় কথা, কেরালার কংগ্রেস সরকার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ভাগ চেয়েছে কুদানকুলাম থেকে; ত্রিবান্দ্রমের এবং দিল্লির কংগ্রেস সরকার পরামর্শ করে কেরালায় কিছু পরমাণু কেন্দ্র খুলতেই পারে। কিন্তু কেরালার বুদ্ধিমান ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ কক্ষনও রাজনৈতিক দলগুলিকে, কংগ্রেস-কমিউনিস্ট-বিজেপি বা অন্য যে কেউ হোক, তাদের তা করতে দেবে না।
এই অবস্থায় আমরা আপনাকে অনুরোধ করতে পারি, আপনি কুদানকুলামের নির্মাণ, যন্ত্রাংশ, গুণমান, এবং দক্ষতা ও আয়ব্যায়ের হিসেব নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিন। ১ নং চুল্লির কোর থেকে জ্বালানি দণ্ড বার করে আনার দাবি তুলুন। কুদানকুলামকে একটি নতুন জনমুখী প্রকৃতিবান্ধব শক্তি পার্ক হিসেবে বদলে দিন। নবীকরণযোগ্য শক্তি প্রকল্পগুলিকে রাজ্যে জায়গা করে দিন। বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং বন্টনের বিষয়গুলিকে ঠিকঠাক করুন। তামিল জনগণ ও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ এবং তাদের ভালোভাবে বাঁচার স্বার্থ সুরক্ষিত করুন।
আমরা যদি এই ভেজাল, নিচুমানের, অনিরাপদ, এবং দুর্নীতি-ঋদ্ধ পরমাণু প্রকল্পকে ছেড়ে দিই এবং আমাদের তামিল জনগণের জন্য আমাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য করতে ব্যর্থ হই, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলির সুরক্ষা করতে না পারি, ভবিষ্যতে জন্ম নিতে চলা তামিলনাড়ুর মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে না পারি, তবে ভবিষ্যতের বিপর্যয় ও ব্যাপক ক্ষতির জন্য আমরা দায়ী থাকব।
……
এস পি উদয়কুমার
Leave a Reply