অমিতা নন্দী, কলকাতা, ১২ ফেব্রুয়ারি#
সুনামি কলোনিতে যাওয়ার আগে ৩০ ডিসেম্বর সকালেই শশীর বাড়িতে আলাপ হয়েছিল ওর মামা গাভাসকারের সঙ্গে। গাভাসকার কর্মসূত্রে কন্যাকুমারীর কাছে থাকে। ইংরেজিটা একটু ভালো জানে আর বেশ মিশুকে, চটপটে। এখানে নববর্ষ উদযাপনের কর্মসূচিতে যোগ দিতে সে গ্রামে এসেছে। এসেই নানা কাজে হাত লাগাতে শুরু করল। আমাদের সুনামি কলোনিতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা ওই করেছিল। কোয়েম্বাটুর থেকে নিশীথা নামে একটি মেয়ে ওইদিন সকালে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। ওরও থাকার ব্যবস্থা হল শশীর বাড়িতে। নিশীথা কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি একটি এনজিও-তে কাজ করে এবং তামিল ছাড়াও ইংরেজি ও হিন্দি বেশ ভালো জানে। ওর সঙ্গে শশীকলার আগেই পরিচয় ছিল, কারণ আগেও কুডানকুলাম পরমাণু প্রকল্প বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচিতে ও ইডিনথাকারাই গ্রামে এসেছে। এই দুজনের সাহায্যে শশীর বাড়িতে বেশ কিছুটা কথাবার্তা বলা গেল। আমরা জানতে পারলাম যে উদয়কুমারের ঠাকুর্দা ও ঠাকুমা দুজনেই ক্যানসারে মারা গেছেন। আর জানলাম ইডিনথকারাই নামের অর্থ। লোককাহিনী অনুসারে, তামিল দেবতা মুরুগান এই সমুদ্রতটে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এবং ‘ইডিন’ অর্থাৎ তটভূমি বিদীর্ণ হয়। ইডিনথাকারাইয়ের আর এক অর্থ ভাঙা তট।
দুপুরে খাওয়ার আগে একটু স্নান করার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু ওই গ্রামে জলের খুব টানাটানি। নগদ পয়সা দিয়ে জল কিনতে হয়। ভেবেছিলাম সমুদ্রে স্নান করা যাবে। কিন্তু ওখানকার জনসমাজের নিয়মমতো বছরে নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন ছাড়া মেয়েদের সমুদ্রে স্নান করা নিষেধ। পুরুষেরা যেহেতু মাছ ধরতে সমুদ্রে যায়, তাই তাদের কোনো বাধা নেই। আমি ‘একটু মাথায় জল ঢালতে চাই’ বলায় শশী আর গাভাসকার দুজনে পরামর্শ করে ওখানে ওদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে গেল। তাদের দোতলা পাকা বাড়ি, ছাদে জলের ট্যাঙ্ক এবং বাথরুমে জলের কলও আছে। আমার খুবই লজ্জা করছিল ওদের বিব্রত করতে। যাই হোক, দ্বিতীয় দিন থেকে দেখি শশীর বাড়িতেই বড়ো চৌবাচ্চা জলে ভরে রেখেছে, আমরা পাঁচজন অতিথিই যাতে স্নান সারতে পারি। খাওয়ার জন্য ওখানকার ওয়েডিং হলে গিয়ে আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ হল। ইতিমধ্যে বিনায়ক সেনও ওখানে পৌঁছে গিয়েছেন। দুপুরে ভাতের পাতে টাটকা সুস্বাদু মাছভাজা পেলাম। হলের বাইরের চত্বরে সকালে দেখেছিলাম বেশ কয়েকজন মানুষ সদ্য ধরে আনা মাছ কাটছেন সমবেতভাবে। আর কিছু মহিলাকে দেখেছি একনাগাড়ে নারকেল কুড়তে। অত শতশত লোকের খাবার বন্দোবস্ত করা, তিনবেলা, প্রায় প্রতিটি পদেই নারকেলের ব্যবহার, কী সুশৃঙ্খলভাবে সবকিছু চলছে দেখে অবাক হয়েছি।
বিকেলের দিকে ভার্গবী ঘোষণা করল, বাসে দুই দিকে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে, একটা দল যাবে সুনামি কলোনিতে, আর একটা দল যাবে কুথানকুলি গ্রামে। আমরা সকালে সুনামি কলোনিতে ঘুরে এসেছি, তাই দ্বিতীয় দলে ভিড়লাম। আন্দ্রিয়া আর স্টেফি সকালে অন্য কোথাও যায়নি, এখানেই বাচ্চাদের সঙ্গে নাচ-গানের মহড়া দিচ্ছিল। বাচ্চারাই ওদের টেনে নিয়ে গেল সুনামি কলোনিতে, পায়ে হেঁটে। পরে জানলাম, মধু সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে আর মেহেরদা একটা গাড়ি নিয়ে চলে গেছিল কুডানকুলাম প্ল্যান্টের একদম কাছের গ্রামে। ওখানে যারা প্ল্যান্টে কাজ করে, তারা খুব একটা মুখ খুলছিল না। তবে আন্দোলনের প্রতি ভেতরে ভেতরে সমর্থন আছে অনেকেরই। ওদের সঙ্গী ছিল হরি।
কুথানকুলি গ্রাম
দুটো বাসে করে কুথানকুলি গ্রামে আমরা পৌঁছালাম কুড়ি মিনিটে। পথে আরও কয়েকটা ছোটো ছোটো গ্রাম এবং দুপাশে আবার সেই শতশত উইন্ড মিল চোখে পড়ল। এই কুথানকুলি গ্রামটিও সমুদ্রের তীরে। এখানেও বিশাল একটি গির্জা। তার কাছেই একটি দপ্তর। সেখানে প্রথমে আমাদের সকলকে বসিয়ে জল এবং চা-বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করা হল। ওখানকার ফাদার আমাদের কাছে আন্দোলন সম্পর্কে বললেন।
অতীতে এই গ্রামের লোকজন খুব মারকুটে ছিল, বোমা বানাত আর নিজেদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে খালি লড়াই করত। উদয়কুমার এসে যখন প্রথম অহিংস আন্দোলনের কথা বললেন, লোকে ভয়ানক রেগে গেল। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা শান্ত হল এবং অহিংস আন্দোলনের তাৎপর্য বুঝতে শিখল। আন্দোলন তাদের একসূত্রে বেঁধে দিল। এখন ইডিনথাকারাই আর কুথানকুলি — পরমাণু শক্তি বিরোধী আন্দোলনের দুটো শক্ত ঘাঁটি। মাঝে আরও যে দুটো ছোটো ছোটো গ্রাম আছে, হিন্দু ও মুসলমান প্রধান, সেখানে প্রতিরোধ দুর্বল। কারণ সেগুলি সমুদ্রের ধারে নয়। প্রশাসন যখন খাবার, জল আর দুধের সাপ্লাই আটকে দিয়ে আন্দোলন ভাঙতে চেয়েছিল, ইডিনথাকারাই ও কুথানকুলির মানুষ সমুদ্রপথে জরুরি জিনিসপত্র এনে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছিল। ওই দুটো গ্রাম সেটা পারেনি।
এরপরে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আমরা জড়ো হলাম গির্জার সামনে সমুদ্রের ধারে এক বিশাল প্রাঙ্গণে। কেরালার বন্ধুরা উদাত্ত কণ্ঠে সমবেত-গান শুরু করলেন, সঙ্গে ছোটো ড্রামের মতো একটা বাজনা। আমরা, ভারতের নানা জায়গা থেকে আন্দোলনের সমর্থনে আসা মানুষেরা গোল হয়ে বসে, দাঁড়িয়ে, আমাদের চারপাশে গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে গেলেন। আমরা কেউই ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না, ভাষার সমস্যায়। ফলে ভার্গবী, লক্ষ্মী ইত্যাদিরা মধ্যস্থ বা দোভাষীর ভূমিকা পালন করছিল। এই প্রোগ্রামটায় মূলত নানা জায়গার সাথিরা সংগ্রামের গান গাইলেন, কেউ কেউ ছোটোখাটো বক্তব্যও রাখলেন। যেমন ভূপাল থেকে আগত বয়স্কা দুই মহিলা কৃষ্ণা বাঈ এবং গিরিজা বাঈ বলে উঠলেন, ‘লড়াই করলে আমরা জিতবই’। ইন্দিরা সাগর ড্যামে কৃষ্ণা বাঈ টানা পনেরো দিন জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। তাঁর পায়ের ঘা আমাদের দেখালেন। গিরিজা বাঈ ওঙ্কারেশ্বর ড্যামে টানা সতেরো দিন জল-সত্যাগ্রহ করে জিত হাসিল করেছিলেন। কেরালা, ঝাড়খণ্ডের সাথিদের গানে অনেকেই গলা মেলালেন, খুবই উদ্দীপনাময় এক আবহ তৈরি হল। ওই গ্রামের একজন তো কাগজে নিজের লেখা একটা গান গেয়ে শোনালেন, তাঁর দেখাদেখি আরও একজন গাইলেন। আমার একটু লজ্জা করছিল যখন ভার্গবী আমাদের পশ্চিমবাংলার সাথিদেরও গান গাইতে বলল, আর আমরা ওখানে কিছু শোনাতে পারলাম না। এই জমায়েতের অন্তরঙ্গতায় আমাদের মন ভরে গেল। সমস্ত ভৌগোলিক ও ভাষাগত দূরত্ব ঘুচে গিয়ে সারা ভারত যেন এক হয়ে গেল।
ইডিনথাকারাইয়ে ফেরার পর খাওয়ার হলে সবার সঙ্গে দেখা হল, যে যেখানে গিয়েছিলাম সেখানকার অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হল। খাওয়ার পরে অনেক রাত অবধি গির্জার সামনে সভা-প্রাঙ্গণে গান-বাজনা চলল। আমরা যারা একটু ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়ছিলাম, গানের তালে বা শ্লোগানে-বক্তৃতায় তেমন তালি বাজাতে পারছিলাম না তাদের উদ্দেশ্যে মাঝেমাঝেই ভার্গবী বলে উঠছিল, ‘কেয়া আপলোগ শো গয়ে কেয়া? নিদ আ গয়া হ্যায়?’ রাত প্রায় বারোটা নাগাদ আমরা ঘরে ফিরে এলাম। পরদিন খুব সকাল থেকে অনুষ্ঠান শুরু হবে।
ক্রমশ
Leave a Reply