অমিতা নন্দী, কলকাতা, ১৪ মার্চ#
২০১২ সালের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর সারা দিনরাত ধরে ইডিনথাকারাই গ্রাম সরগরম। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে তৈরি হয়ে সবাই জড়ো হলাম গির্জার সামনে সভাপ্রাঙ্গণে। সেখান থেকে এক বিশাল বর্ণাঢ্য পদযাত্রা শুরু হল। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ, প্রায় আট থেকে আশির কোঠায় — কেরালা-ঝাড়খণ্ড-হরিপুর-ভূপাল-দিল্লি-চেন্নাই-গোয়া-কর্নাটকের সাথিরা সবাই শামিল সেই পরিক্রমায়। এদের মধ্যে উপকূলবর্তী ও মৎস্যজীবী সমাজের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। কারও কারও হাতে ব্যানার। কেরালার বন্ধুদের অংশগ্রহণই সবথেকে বেশি চোখে পড়ার মতো। ঢাক-ঢোলের মতো বাজনা বাজিয়ে তাঁরা গান গাইতে গাইতে চলেছেন। একবার তামিলে, একবার মালয়ালম ভাষায়, একবার হিন্দিতে কী অপূর্ব সেই সমবেত গান —
হাওয়া চল্ সাগর ভী চল্ এক বাদল লে আয়ে,
আজ সাজানে ইন্দ্রধনুস কো ঘন বাদল লে আয়ে …
মাঝেমাঝেই পাড়ার বিভিন্ন মোড়ে দাঁড়িয়ে শ্লোগান-গান আর তার তালে তালে নাচ হচ্ছিল, বাচ্চা ছেলে-মেয়ে এবং বয়স্করাও অনেকে নাচছিল পরস্পরের হাত ধরে, মেয়েদের অংশগ্রহণ ও উৎসাহ ছিল নজরকাড়া। প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা ধরে গোটা গ্রাম পরিক্রমা শেষে আবার যখন গির্জার সামনে হাজির হলাম, সেখানে নারকেল পাতার ছাউনির নিচে তখন আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে। মেয়েরা অনেকে ওখানে বালির ওপর বসে বিড়ি বাঁধছে। দুপুর ও রাতের খাওয়ার সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাদিন ধরেই অনুষ্ঠান চলল। সন্ধ্যাবেলায় ছিল মূলত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান — নাচ-গান-মূকাভিনয় প্রভৃতি।
কুডানকুলাম পরমাণু প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন এবং ইডিনথাকারাই
যে দু-তিনদিন ওখানে ছিলাম নানা লোকের সঙ্গে আলাপ করে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কীভাবে একটা গোটা গ্রাম এই আন্দোলনে এমনভাবে শামিল হয়ে গেল, আর আমাদের এখানে বড়ো মিডিয়ায় যে প্রচার বেশ জোরদার ছিল যে ‘বাইরের টাকায় (বিদেশি মদতে) এই লড়াই চলছে’ সেটাই বা কতটা সত্যি? আমরা যাদের ঘরে ছিলাম, সেই শশী এবং তার মামার কাছেও অনেকটা জানা গেছে।
পরমাণু শক্তির বিপদ নিয়ে এই গ্রামের লোকজন অনেকদিন পর্যন্ত বেশ নির্লিপ্ত-উদাসীন ছিল। ১৯৮৮ সালে যখন এই প্রকল্প নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয় স্থানীয় মানুষকে চাকরি-বাকরি আর অনেক লোভ দেখানো হয়েছিল। প্রথমে এই প্রজেক্ট হওয়ার কথা ছিল কেরালায়। কিন্তু সেখানকার জনসাধারণ এবং সমস্ত রাজনৈতিক দলের তাতে প্রবল বিরোধিতা ছিল। আর তামিলনাড়ুর মানুষ পরমাণু-প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত ছিল। তাই কেরালা থেকে সরে এসে প্ল্যান্টের স্থান নির্বাচন করা হল তামিলনাড়ুর সমুদ্র উপকূলবর্তী গ্রাম কুডানকুলামে। সে সময় রেভারেন্ড ওয়াই ডেভিডের নেতৃত্বে কিছুটা প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। ১৯৮৯ সালের ১ মে কন্যাকুমারিতে মৎস্যজীবীদের পদযাত্রার ওপর গুলি চলে, ছয়জন মৎস্যজীবী আহত হয়।
জাপানের ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর সমস্ত গ্রামের চোখ খুলে গেল। মানুষ টিভিতে দেখল পরমাণু চুল্লির ভয়াবহতা। তারপর ২০১১ সালের আগস্ট মাসে কুডানকুলাম কর্তৃপক্ষ যখন ‘মক ড্রিল’ (নিরাপত্তা মহড়া) করল, গোটা গ্রাম ভয় পেয়ে গেল। শশীকলা যেমন বলছিল, ‘প্ল্যান্ট থেকে সাইরেন বাজিয়ে দেওয়া হল। চারিদিক কাঁপতে শুরু করল। … সেইদিনই ২৩ জন মেয়ের গর্ভপাত হয়। …’
এবার শুরু হল গণআন্দোলন। ১১ আগস্ট গির্জার ঘণ্টা বাজিয়ে হাজার হাজার গ্রামবাসী জড়ো হল গির্জার সামনে। উদয়কুমার, পুষ্পরায়ন এবং পিপল্স মুভমেন্ট এগেনস্ট নিউক্লিয়ার এনার্জির নেতা-কর্মীদের ডাক পড়ল সেখানে। সেদিন থেকে ইডিনথাকারাইয়ের মৎস্যজীবী সমাজ, বিশেষত ঘরের মেয়েরা, হয়ে উঠল এই আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এবং নেতা। বাইরের বুদ্ধিজীবী কর্মীরা তাদের সহযোগী।
শশীর কাছে জানলাম, এই আন্দোলনের তহবিলে প্রত্যেক পরিবার সপ্তাহে ২০০ টাকা করে জমা দেয়। যারা গ্রামের বাইরে বা বিদেশে থেকে রোজগার করে তারা তিনমাস অন্তর একটা মোটা টাকা পাঠায়। ৫০০ দিন অনশন ও অবস্থান চলাকালীন প্রতিদিন কমপক্ষে ২০টা পরিবার সেখানে হাজির থাকে। শশী যায় প্রত্যেক শুক্রবার। আর জেভিয়ার আম্মা, মেলরিটের মতো বেশ কিছু কর্মী তো চোদ্দোমাস যাবৎ দিনরাত সেখানে পড়ে রয়েছেন।
৩১ ডিসেম্বরের সভা
সকালে গ্রাম পরিক্রমার পর সভামঞ্চে উঠে প্রথমেই সবথেকে জোরালো বক্তৃতা দেন মৎস্যজীবী পরিবারের মহিলা মেরি পিটার। অত্যন্ত নিরীহ শান্ত রোগা চেহারা, কিন্তু গলায় আর বক্তব্যে কী জোর! বললেন, পুরুষদের যদি বাইরে কাজে যেতে হয় তারা যাক, মহিলারাই এই প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে। প্রচণ্ড হাততালি দিয়ে সমবেত জনতা তাঁকে সমর্থন জানালো, যার মধ্যে অধিকাংশই মহিলা। একে একে মঞ্চে উঠে কখনো গান গেয়ে, কখনো বক্তৃতা দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সংগঠন-কর্মী ও ব্যক্তিবর্গ তাঁদের নিজের নিজের আন্দোলনের কথা এবং কুডানকুলাম আন্দোলনের প্রতি সহমর্মীতার কথা জানালেন। যেমন, ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের জঙ্গলের অধিকার নিয়ে যারা লড়াই করছে সেই ‘জোহার’ সংগঠন, ভূপাল গ্যাস পীড়িতদের সংগঠন, মধ্যপ্রদেশের ইন্দিরা সাগর ড্যামের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সাথিরা, এনএপিএম কর্নাটক শাখার প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধি, মৎস্যজীবীদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘ন্যাশনাল ফিশ ওয়ার্কার্স ফোরাম’-এর নেতা, এমন অনেকে। সভা চলাকালীন কেরালা থেকে আরও কিছু মানুষ শ্লোগান দিতে দিতে এসে যোগ দিলেন। তার মধ্যে একজন সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েই হাজির হয়েছেন। কিছু আইনজীবী এবং অন্য বুদ্ধিজীবীরাও বক্তব্য রাখলেন। তাঁদের সব কথা এই পরিসরে জানানো যাবে না, তবে নানা দিক থেকে যে মানুষ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তেমন অনেক কিছু জেনে সমৃদ্ধ হলাম। যারা যে ভাষায় বক্তব্য রাখছিলেন সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে ইংরেজি-হিন্দি বা স্থানীয় ভাষায় তরজমা করে দেওয়া হচ্ছিল। আর এই সভা পরিচালনার কাজে আন্দোলনের নেতা পুষ্পরায়ন বা উদয়কুমারকে মঞ্চে উঠতে দেখলাম না, সেই কাজ অত্যন্ত দক্ষভাবে চালাচ্ছিল ভার্গবী এবং তার মতোই তরুণ প্রজন্মের কয়েকজন মিলে। অন্য রাজ্য থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে আসা দুটি বাচ্চা মেয়ে গেয়ে উঠল, ‘হাম হোঙ্গে কামিয়াব একদিন’।
দুপুরের বিরতিতে খাওয়ার হলে গিয়ে আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ হল। সেরকম একজন সিস্টার ক্ল্যারিবেল, তিরুনেলভেলি জেলার ইউবারি গ্রাম থেকে এসেছেন। তিনি একজন স্বাস্থ্যকর্মী। আমাদের বললেন, ‘আপনারা এখানে সমুদ্রের জলের রঙ দেখেছেন? কীরকম ঘোলাটে লাল জল? এখানে আশপাশে বেশ কয়েকটা কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে বালি থেকে একটা আকরিক নিষ্কাশনের কাজ চালাচ্ছে। কন্যাকুমারি থেকে শুরু করে টানা সমুদ্রতট জুড়ে এই কাণ্ড চলছে। সেই আকরিক ফ্যাকট্রিতে শোধন করা হচ্ছে আর সমস্ত দূষিত জল গিয়ে মিশছে সমুদ্রে। বর্জ্য বালি যখন এনে ফেলা হয় সমুদ্রতটে, তার ধারণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। এখানকার পরিবেশের পক্ষে এটা ভয়ানক ক্ষতিকর। জানেন, মানাবালাকুর্চি নামে একটা গ্রাম ক্যানসার আক্রান্ত মানুষে ভর্তি। …’ সত্যিই আমাদের আধুনিক জীবন সমুদ্রের জল, বালি, মাটি কোনো কিছুকেই রেহাই দিচ্ছে না।
সন্ধ্যাবেলার অনুষ্ঠান
সন্ধ্যাবেলায় অনুষ্ঠান মঞ্চের সামনে তখন শয়ে শয়ে লোক। প্রথমেই স্থানীয় বাচ্চাদের সমবেত নাচ, গান — বাজনার তালে তালে। মাত্র দুদিনের রিহার্সালে বাচ্চারা এত সুন্দর অনুষ্ঠান করল যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তারপর বিভিন্ন প্রদেশের নাচ-গান, গোয়ার মেয়ে আন্দ্রিয়া আর স্টেফির যৌথ কোরিওগ্রাফ এবং সবচেয়ে উপভোগ্য ছিল আমাদের কলকাতার ছেলে সুশান্ত দাসের মূকাভিনয়। একটি মাছের চোখ দিয়ে কুডানকুলাম পরমাণু প্রকল্প, সেখানকার আন্দোলন, নিপীড়ন, রাজনীতি এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল সেই নাটকে। মৎস্যজীবী পরিবারের বাচ্চা-বুড়ো-মহিলা সকলেই দিব্যি বুঝতে পারল সেই নাটক। প্রচুর হাততালি পেল সুশান্ত।
রাত সাড়ে এগারোটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত বিরতি। সেই সময়ে গির্জার অনুষ্ঠান — মধ্যরাত্রির প্রার্থনা (midnight mass) চলল, গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে সাদা পোশাকে এসে অনেকেই গির্জার সেই প্রার্থনায় যোগ দিল। আর বাইরের ছাউনির নিচে সবাই তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে, বাচ্চারা অনেকেই দেখি কিছুটা ঘুমিয়ে নিল। তারই মধ্যে কয়েকজন হতদরিদ্র চেহারার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দেখলাম বালির ওপরে বসে সেই প্রার্থনাসংগীতে গলা মেলালেন, প্রার্থনা করলেন। একটা অদ্ভুত ভাবগম্ভীর পরিবেশ। রাত দেড়টার সময় আবার সবাই সজাগ হয়ে উঠল, একজায়গায় জড়ো হয়ে গেল। বাচ্চারা আমাদের সবার হাতে একটা করে কাগজের কাপ আর মোমবাতি ধরিয়ে দিল। প্রথমে ভাবলাম, বুঝি কাপে এবার চা বা কফি দেবে। তারপর দেখি সবাই মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই কাপের মধ্যে ফুটো করে এমনভাবে ধরছে যাতে হাওয়ায় বাতিটা নিভে না যায়। কেউ কেউ মশাল জ্বালিয়ে নিল। এবার সমস্ত গ্রামের মানুষ এবং বাইরের অতিথিরা মোমবাতি আর মশাল হাতে নানারকম শ্লোগান দিতে দিতে একসঙ্গে গ্রাম পরিক্রমা করে উপস্থিত হল সমুদ্রের তীরে। সে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। গভীর রাতে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন আর তাকে ছাপিয়ে সমবেত জনতার ঐকতান। প্রথমে তামিলে তারপর হিন্দিতে নতুন বছরের জন্য শপথ নেওয়া হল : আমাদের বেঁচে থাকার শপথ, ধরিত্রীকে বাঁচিয়ে রাখার শপথ।
দেশের এক এক প্রান্তে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা, ভিন্ন ভিন্ন আন্দোলন — কুডানকুলামে পরমাণু, গোয়ায় মাইনিং, ঝাড়খণ্ডে আদিবাসী জীবন, ভূপালে গ্যাসপীড়িত মানুষের লড়াই, মধ্যপ্রদেশে বড়ো বাঁধ — সব যেন একসূত্রে গাঁথা, সমগ্ররূপে মাতৃস্বরূপা বসুন্ধরা আজ বিপন্ন, আমরা সকলেই সেই বিপদ থেকে মুক্তির প্রত্যাশী।
গভীর রাতে আমরা অনেকে ঘরে ফিরে এলাম, আবার অনেকেই সমুদ্রের ধারে থেকে গেল, নতুন বছরের সূর্যোদয়কে স্বাগত জানাতে।
Leave a Reply