৬ আগস্ট হিরোশিমা দিবসে স্টুডেন্টস হলের সভায় দুই মহিলা প্রতিনিধির বক্তব্য বাংলায় অনুবাদ করেন বারুইপুরের সমাজকর্মী শশী আপ্পান#
সকলকে নমস্কার। আমার নাম জেভিয়ার আম্মা। আমার গ্রাম হল ইদিনথাকারাই। সবাই ভাবছে, কুডানকুলামে এখনই আন্দোলন শুরু হয়েছে। এটা ভুল। ১৯৮৮ সালে, যখন আমার বয়স ২৪ বছর, রাজীব গান্ধীর সঙ্গে রাশিয়ার পরমাণু চুল্লি নিয়ে চুক্তি হল, তখন থেকে আন্দোলন শুরু হয়েছে। তখন ঘরে ঘরে টিভি ছিল না। সংবাদপত্রে যা ছাপা হত, তা সরকারের ছাড়পত্র পেয়ে ছাপতে হত। ফলে আন্দোলনের খবর লোকে পেত না। কিন্তু যখন জাপানে সুনামি হল, ফুকুশিমায় চুল্লিতে বিস্ফোরণ হল, সবাই টিভিতে দেখতে পেল পুরো ঘটনাটা, তাতে আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে উঠল।
কেরালায় রাশিয়ান প্ল্যান্ট হওয়ার কথা ছিল। কেরলের মানুষ তা হতে দেয়নি। সেখানকার মানুষ শিক্ষিত। আমাদের ওখানকার সমুদ্র উপকূলের মানুষের শিক্ষার মান কম, তাই ওখানে ওরা চুল্লি বসাবে বলে ঠিক করল। আমরা সরকারের কোনো ক্ষতি করিনি। অহিংস পথে আন্দোলন চালাচ্ছি। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা আমাদের গ্রামে এসে বলেছিলেন, তোমরা আন্দোলন করো, আমি তোমাদের পাশে আছি। কিন্তু যখন তিনি ভোটে জিতে গেলেন, আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেলেন। আবার আমাদের জেলায় একটা বাই-ইলেকশনে ভোটের জন্য এসেছিলেন, সেখানেও যখন জিতে গেলেন, আমাদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ালেন। এই জয়ললিতা একসময় আমাদের আন্দোলনে পুলিশ প্রোটেকশন দিয়েছেন। পরে ভোটে জিতে গিয়ে আমাদের ওপর পুলিশি অত্যাচার শুরু করলেন। আমাদের গ্রামে বাচ্চাদের দুধ বন্ধ করে দিলেন। পুলিশ দিয়ে গ্রামে খাবারদাবার, ওষুধপত্র আসা বন্ধ করে দিলেন। রাস্তা বন্ধ, মৎস্যজীবীরা নৌকা নিয়ে সমুদ্রপথে অন্য শহরে গিয়ে খাবার সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে। আমরা সরকারের কাছে বলছি না, আমাদের খেতে দাও, পয়সা দাও।
আমরা আমাদের মাটিকে রক্ষা করতে চাই, যাতে আমরা নিজেদের জমিতে কাজ করে খেতে পারি। আমাদের ভবিষ্যত রয়েছে এই মাটির মধ্যে। আমরা বলছি, আমাদের মাটিকে নষ্ট করে দিও না, আমাদের স্বাস্থ্যকে বরবাদ করে দিও না। আমাদের জীবন-জীবিকা সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। মাছ ধরে আমরা জীবিকা নির্বাহ করি। পরমাণু চুল্লির তেজস্ক্রিয় বিকিরণ তো বাতাসে যাবে, সমুদ্রে যাবে। পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে সমুদ্রের মাছ তো ধ্বংস হয়ে যাবে। বাজারে সেই মাছ বিক্রি করলে তেজস্ক্রিয়তা মানুষের মধ্যে যাবে। আমাদের জীবিকা একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে।
প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, আমি একটা গ্রুপ তৈরি করব। সেই গ্রুপ এসে আপনাদের মতামত নেবে। যদি আপনারা বলেন, আমরা পরমাণু চুল্লি চাই না। আমি জায়গাটা ছেড়ে দেব। তারপর এখন কেন্দ্রীয় সরকার, কিছু বিজ্ঞানী আর রাশিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে কিছু পয়সাকড়ি দিয়ে চুল্লি বসানোর কথা বলছে।
যখন ২০০৭ সালে সুনামি হল, জল এখানে সমুদ্র থেকে দু-কিমি ভিতরে চলে এসেছিল। পরমাণু চুল্লিতে জল দরকার। এখন আমরা গ্রামে এক কলসি জল আড়াই টাকা দিয়ে কিনি। খাবার জলের অভাব এখানে। সুনামি হলে যখন জল ভিতরে ঢুকে যাবে, তখন চুল্লির জন্য জল কোথা থেকে পাবে? এখন যে কোনো ভালো জিনিস কিনতে গেলে ণ্ণমেড ইন জাপান’ লেখা থাকলে আমরা কিনি। জাপান টেকনোলজিতে উন্নত। তা সত্ত্বেও সুনামি হওয়ার পর জাপানের চুল্লিতে বিস্ফোরণ ঘটেছে। এখন আমাদের সরকার বলছে, তোমাদের দু-তলা তিনতলা বাড়ি তৈরি করে দিচ্ছি। সুনামি হলেও তোমাদের কিচ্ছু হবে না। আমাদের ওরা বোকা বানাচ্ছে।
নাগেরকয়েল থেকে এসে উদয়কুমার এখানে আমাদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা সরকার বা কারও ক্ষতি করবে না। ওঁর কথা মেনে আমরা মাসের পর মাস অনশন করেছি। অথচ উদয়কুমারের ওপর একটার পর একটা মোট ৮৩টা কেস চাপিয়ে দিয়েছে ওরা। তিনি আজ কন্যাকুমারি, নাগেরকয়েল বা থুথুকড়ি কোথাও যেতে পারবেন না। গেলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে। যারা আন্দোলন করছে, সেই মেয়েদের ওপরও কেস চাপিয়েছে। আন্দোলনকারীদের ওপর অনেক মিথ্যা অভিযোগ করা হচ্ছে।
ওরা বলছে, এতদিন আন্দোলন চলছে, তার টাকা কোথা থেকে আসছে? নিশ্চয় বিদেশ থেকে টাকা আসছে। থুথুকুড়িতে একটা সামাজিক সংগঠন আছে, সরকার তার অ্যাকাউন্ট সিল করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা বিদেশ থেকে টাকা নিই না। আমরা যখন মাছ ধরতে যাই, পাঁচশো টাকা রোজগার হলে তার থেকে পঞ্চাশ টাকা আমরা আন্দোলনের তহবিলে দিই। এইভাবে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। গতবছর ১৫ আগস্ট তালপাতা দিয়ে একটা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে, সেটাই এখনও আছে। আমাদের স্বামীরা মাছ ধরতে যায়, আমরা সপ্তাহের রান্না করে রাখি। বাচ্চারা স্কুলে যাবে, তাই সকালে ওদের জন্য রান্না করে দিই, ওটা ওরা দুপুরে খায়। তারপর সকাল আটটা-নটা থেকে আমরা আন্দোলনের মঞ্চে চলে আসি। গত একবছর আমরা দুপুরের খাওয়া খাইনি। আজ কলকাতায় এসে প্রথম দুপুরে খেলাম।
মেলট্রেড : পরমাণু কেন্দ্রের বিষে পেটে যে বাচ্চা হবে, সেও ধ্বংস হবে
আমাদের কথা শোনার জন্য আপনারা এসেছেন, সবাইকে নমস্কার জানাই। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করার জন্য আপনারা সবাই লড়ছেন, ভারতবর্ষের সবাই মিলে একসঙ্গে আমরা যদি লড়াই করি, পরমাণু কেন্দ্র আমরা বন্ধ করে দিতে পারব।
আমরা একবেলা না খেয়ে কাটাতে পারি। কিন্তু আমাদের জীবনটাই যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে কী থাকবে? এখন আমার কত বয়স? আমার জীবনটা ধ্বংস হবে বলে জানতে পারছি। আমার পেটে যে বাচ্চা হবে, সেও ধ্বংস হবে। তাই পরমাণু কেন্দ্র বন্ধ করতে হবে। এই পৃথিবীতে অনেক জাত আছে। কিন্তু আমি মনে করি, দুটোই জাত, পুরুষ আর নারী। আর কোনো জাত নেই। তাই পরমাণু চুল্লিটা যেখানেই হোক আমাদের বন্ধ করতেই হবে। প্রত্যেকেই আমরা অনশন করেছি। পনেরো দিন অনশন করার পর শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। তখন সরকার আমাদের দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সেখানে চিকিৎসা ঠিক মতো হয়নি। ওরা মরেই যেত। আমরা বললাম, আমাদের যদি মরতেই হয়, নিজের মাটির ওপর মরব। সেইজন্য হাসপাতাল থেকে অসুস্থদের নিয়ে আসা হয়েছে।
প্রথমে সরকার দশজনের বিরুদ্ধে কেস করেছে, তারপর তিনশো পনেরো জনের ওপর কেস চাপিয়েছে, তারপরে তিন হাজার মহিলার ওপরে কেস চাপিয়ে দিয়েছে। এই প্রথম আমি গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসেছি। যেখানেই পরমাণু চুল্লি হবে, আমাদের সেখানে গিয়ে বন্ধ করতে হবে। আমরা এক জায়গায় বসে আন্দোলন করিনি। পনেরো কিলোমিটার হেঁটে সমস্ত গ্রামে গিয়ে সেখানকার মানুষকে নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছি। \par
জয়ললিতা-মনমোহন সিং বলছে, কোনো অসুবিধা নেই। তাহলে কেন দিল্লিতে বা চেন্নাইয়ে চুল্লি বসানো হচ্ছে না? আমরা গরিব মানুষ, লেখাপড়া শিখিনি বলে তোমরা আমাদের ওপর পরমাণু চুল্লি চাপিয়ে দিতে চাইছ? আগে ওরা নিজেদের বাড়ির পাশে চুল্লি বসাক, তারপরে আমাদের বোঝাতে আসুক। আমরা আন্দোলন করে এখনও কোনো ফল পাইনি। আমার বয়স এখন একচল্লিশ। এই একচল্লিশ বছরেই আমার জীবনটা যাতে শেষ না হয়ে যায়, সেইভাবে আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে। যেখানেই পরমাণু চুল্লি বসানো হবে, সেখানেই আমাদের সবাই তা বন্ধ করতে যাব। আপনাদের সকলেই জানাই ধন্যবাদ।
Leave a Reply