শোভা ধনী, ৮ আগস্ট#
কলকাতা থেকে প্রায় ৬৫ কিমি দূরে সুন্দরবনের প্রবেশপথে রয়েছে সরবেরিয়া গ্রাম। গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ৩০০০। গ্রামটি সন্দেশখালি ব্লকের এক নম্বর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ব্লকের অন্তর্ভুক্ত। ২০০১ সালের আদমসুমারি অনুসারে ব্লকটির জনসংখ্যা ১ লক্ষ চল্লিশ হাজার চারশো ছেচল্লিশ। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ বাস করে দারিদ্র্য সীমার নিচে। এরা মূলত তপশিলি জাতি ও মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। সরবেরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে মাছ চাষের ভেড়ি। এরই মাঝে কোথাও ফুটে উঠেছে কিছু শহুরে সংস্কৃতির ছাপ। দারিদ্র্য অশিক্ষা অসুস্থতা ও অপরাধপ্রবণতার সুনাম এই অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই বহন করে চলেছে। তবে একথাও সত্য দেরিতে হলেও বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে সুন্দরবনের এলাকাগুলোতে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। আয়ের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতসব সত্ত্বেও এটি রাজ্যের গরিবতম অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম। কাজের সন্ধানে গ্রামের অনেক মানুষকেই বাইরে চলে যেতে হয়। আবার নারী ও শিশু পাচারের মতো ঘটনাও এখানে নিত্যদিন ঘটে। গ্রামবাসীদের প্রধান জীবিকা মাছধরা ও কৃষিকাজ। খুব অল্প মানুষেরই অবশ্য চাষের জমি আছে। বেশিরভাগ মানুষই জীবিকা নির্বাহ করে অন্যের জমিতে ভেরিতে বা ইটভাটায় দৈনিক মজুরিতে কাজ করে। ব্লকটিতে দুটি শাখা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাথে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রও রয়েছে। তবে এলাকার স্বাস্থ্য পরিষেবার চিত্রটি বড়োই করুণ। ফলত অপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রাম্য ডাক্তার, যাদের চলতি কথায় হাতুড়ে ডাক্তার বলা হয়, তারা রমরমা পসার ঘটিয়েছে। তবে একথাও ঠিক, বিপদের সময়ে এই হাতুড়ে ডাক্তারদেরই হাতের কাছে পাওয়া যায়। এই সমস্ত ডাক্তারদের মতে, বেশিরভাগই অবশ্য মানবিকতার ধার ধারে না। রোগীর অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তারা সর্বদাই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চিকিৎসা করে। এতে রোগীর স্বাস্থ্য ও পকেট, উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এরকম এক অন্ধকারময় পরিস্থিতিতে এলাকার কয়েকজন যুবক — যাদের পুঁথিগত শিক্ষা খুবই কম এবং আর্থিক সংগতি একেবারেই নগণ্য নেই বললেই চলে, তারা ১৯৯৯ সালে একটি সমবায় কৃষিক্ষেত্র গড়ে তোলে, যার নাম সরবেরিয়া কৃষিচক্র। এই কৃষিচক্রের মূল লক্ষ্য ছিল পুরাতন প্রথায় চাষবাস করা। এরা রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সারের মাধ্যমে চাষবাস শুরু করে। এই সময় তাদের পাশে এসে দাঁড়ান এলাকার একজন বৃদ্ধা, নাম রেবা সেন। তিনি তাঁর ১০ বিঘা জমি বার্ষিক ন্যূনতম ভাড়ায় কৃষিচক্রকে চাষের কাজে ব্যবহার করতে দেন। তাঁর ছেলে অরুণ সেন ছিলেন এই কৃষিচক্রের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। প্রায় ১২ জন পুরুষ ও স্ত্রীলোক সমবেত হয় এই সংগঠনে। সমবেতভাবে জীবিকা অর্জনের একটী নতুন পরীক্ষা শুরু করে তারা। এদের মধ্যে বেশিরভাগই এসেছিল চাষি পরিবার থেকে। সরবেরিয়াতে চারপাশের ধানের জমিকে ভেরিতে রূপান্তরিত করার কাজ তখনও চলছে। ফলত দরিদ্র কৃষকদের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। অসুখবিসুখে তাদের ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত হতে হচ্ছে। কারণ বেসরকারি ক্ষেত্রে এই পরিষেবা খুবই ব্যয়বহুল এবং সরকারি ক্ষেত্রে তা অনিয়মিত এবং অপর্যাপ্তও বটে। এর সাথে একটি অতিরিক্ত সমস্যাও যুক্ত হয়েছিল। পাশের গ্রাম থেকে যারা কাজের সন্ধানে বাইরে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ফিরে এসেছিল নানাধরনের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে। এদেরও সঠিক চিকিৎসা হচ্ছিল না। এইরকম একটি জটিল পরিস্থিতিতে কৃষিচক্রের সংগঠকেরা কলকাতার কিছু সহানুভূতিশীল ডাক্তারদের সহায়তায় পনেরো দিনে একটি করে মেডিক্যাল ক্যাম্প চালাতে শুরু করে। তাদের ক্যাম্পে যে ডাক্তাররা আসতেন, তাঁরা শুধুমাত্র যাতায়াত ভাড়া ছাড়া আর কিছুই নিতেন না। তথাপি এই ন্যূনতম অর্থ সংগঠকেরা সংগ্রহ করতে না পারায় ক্যাম্প কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়।
এর ঠিক কয়েক মাস পরে, বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালের সহায়তায় আবার নতুন করে একটি প্রচেষ্টা শুরু হয়। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার, বেলুড়ে এই হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিল স্থানীয় একটি বন্ধ কারখানার শ্রমিকরা। এই শ্রমিকরা এই কারখানাটির বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধেও লড়েছিল। খেটে খাওয়া মজুররা নিজেদের উন্নয়নের স্বার্থে গঠনমূলক কাজে প্রবৃত্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করেছিল ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার সংগ্রাম থেকে। এই সংগ্রামের কর্ণধার ছিলেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী যিনি শেষ পর্যন্ত শিল্পপতি পুঁজিপতি ও রাজনীতিকদের চক্রান্তে নিহত হন। নিয়োগীর সেই বিখ্যাত আহ্বান, ‘সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ অনুপ্রাণিত করেছিল বেলুড়ের শ্রমিকদের। এটা প্রকৃতপক্ষে সরকারি অবহেলার বিরুদ্ধে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের আত্মশক্তি অর্জনের লড়াই। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নাগরিক সমাজের একটি অংশও। হাসপাতাল গঠনের এই কাজ মোটেও সহজ ছিল না। সংগঠকদের প্রতি পদক্ষেপে বহু প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
ইতিমধ্যে কৃষিচক্রের সংগঠকেরা উপলব্ধি করে যে পনেরো দিন অন্তর এই মেডিক্যাল ক্যাম্প এলাকার গরিব মানুষদের দীর্ঘদিনের স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাব ঘোচাবার জন্য যথেষ্ট নয়। তারা একটি গ্রামীণ হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা করতে থাকে, যেখানে খুব সামান্য হলেও ইনডোর পরিষেবার সুযোগ থাকবে। ২০০২ সালের ১২ মে তারা সেই দুঃসাহসিক কাজটি করে ফেলে। চারটে খড়ের চালের ঘর, কোনোরকমে কাজ চালানোর জন্য কিছু আসবাবপত্র, আর প্রাথমিক কিছু যন্ত্রপাতি — ব্যস্ এই নিয়ে হাসপাতাল শুরু হয়ে যায়। হাসপাতাল শুরুর একেবারে প্রথম দিন থেকেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সর্বক্ষণের জন্য একজন দক্ষ অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারকে নিয়োগ করার ব্যবস্থা করেন। সরবেরিয়ার মতো প্রত্যন্ত গ্রামে এইরকম পদক্ষেপ শুধুমাত্র অকল্পনীয় নয়, দুঃসাহসিকও বটে। অনেক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিপুল অর্থব্যয় করা সত্ত্বেও এখনও সরকার এই পরিষেবা দিয়ে উঠতে পারেনি।
এইভাবেই শুরু হয় সরবেরিয়ার শ্রমজীবী হাসপাতালের পথচলা। হাসপাতালের বয়স যখন মাত্র ছয়মাস (২০০২ সালের ২১ নভেম্বর), তখন পাকা দেওয়াল ও টিনের চাল দেওয়া চারটে ঘর তৈরি হয়। বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালের অনুকরণে সংগঠকরা এই হাসপাতালের নাম ঠিক করে, সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতাল। পরে কিছু আইনগত জটিলতার কারণে এর নতুন নামকরণ করা হয় সুন্দরবন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্প (এসএসএসপি)। ২০০৭ সালে হাসপাতালের আরও কিছু বিস্তার ঘটে। তিনটি নতুন পাকা ঘর বানানো হয়। আজ এখানে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য দুটি পৃথক ওয়ার্ডের সুবিধা রয়েছে। সেখানে দুটি ওয়ার্ডে দশজন করে মোট কুড়িজন রোগীকে ইন্ডোর পরিষেবা দেওয়া হয়। এর সাথে হাসপাতালে রয়েছে একটি ছোট্ট প্যাথোলজি, ওষুধ ঘর, এক্স রে, ইউএসজি, অ্যামবুলেন্স পরিষেবা এবং চব্বিশ ঘন্টার জন্য জরুরি পরিষেবা, ডাক্তার, অক্সিজেন এবং বেশ কিছু জীবনদায়ী পরিষেবাও। সুন্দরবনের কাছে এই সব অঞ্চলগুলিতে এই রকম জীবনদায়ী পরিষেবা খুবই জরুরি। কারণ, এখানে সাপে কামড়ানো, বিষ খাওয়া, আর ডায়রিয়ার আক্রমণের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে হাসপাতালে ডাক্তারের সংখ্যা মোট চোদ্দো জন। জেনারেল ফিজিশিয়ানসহ শিশু চক্ষু স্ত্রীরোগ চামড়া দাঁত হাড় ফিজিওথেরাপি ও মানসিক রোগ বিভাগে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা রয়েছেন। তাঁরা প্রতি মাসে নির্দিষ্ট দিনগুলিতে আউটডোর পরিষেবা দিয়ে থাকেন। ২০১৩-১৪ আর্থিক বর্ষে হাসপাতাল জেনারেল বিভাগে আউটডোর পরিষেবা দিয়েছে মোট ২১,১৩৭ জনকে; বিশেষজ্ঞ বিভাগে ৫,৩১১ জনকে। আর ইনডোর পরিষেবা দিয়েছে চারশো উনিশ জনকে। প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূরের গ্রাম থেকেও রোগীরা এই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসে। বেসরকারি ক্ষেত্রে এর চেয়ে অনেক নিকৃষ্ট মানের পরিষেবা কিনতে যে মূল্য তাদেরকে দিতে হয়, তার থেকে অনেক অনেক কম মূল্যে তারা এই পরিষেবা পেয়ে থাকে। অনেক সময় এই ন্যূনতম মূল্যও অনেকে দিতে পারে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তবুও কক্ষনো তাদেরকে ফিরিয়ে দেয় না।
Leave a Reply