শোভা ধনী, শান্তিপুর, ৩০ আগস্ট#
গত সংখ্যায় সুন্দরবন শ্রমজীবী হাসপাতাল সম্বন্ধে জানার পর আপনাদের মনে এই প্রশ্নের উদয় হওয়া খুব স্বাভাবিক যে হাসপাতালের পরিষেবা দেওয়ার জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তা আসে কোথা থেকে। কোনো সরকারি বা বেসরকারি অনুদান অথবা দেশি-বিদেশি কোন এজেন্সি বা কোনো কর্পোরেট হাউসের দেওয়া অর্থেই কি তাহলে হাসপাতালের সমস্ত ব্যয়ভার মেটানো হয়?
এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, না। হাসপাতাল চলে আমার আপনার মতো মানুষের পয়সায় আর স্থানীয় বেশ কিছু ছেলেমেয়ের স্বেচ্ছাশ্রমে। এভাবে হাসপাতাল তৈরির একেবারে গোড়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষের মধ্যে বেশ কিছু মাটির ঘট বা ভাঁড় বিলি করেছিল। গ্রামের গরিব মানুষেরা তাদের সাধ্যমতো পয়সা সেই ভাঁড়ে ফেলে। বছর শেষে সেই ভাঁড় তাদের থেকে ফেরত নেওয়া হয়। এইভাবে গ্রামবাসীর ক্ষুদ্র অনুদানকে সম্বল করে হাসপাতাল গড়ার কাজ শুরু হয়। কিছু অর্থবান গ্রামবাসী অবশ্য এর থেকে বেশ বেশি কিছু অর্থ দান করেছিলেন। কিন্তু এই অর্থ সব খরচ মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকার মানুষজনও হাসপাতালের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, অর্থ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে। বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতালের সংগঠকেরাও বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন।
২০০২ সাল থেকে হাসপাতাল সম্প্রসারণের কাজও একইভাবে চলে আসছে। যখনই নতুন কোনো পদক্ষেপ হাসপাতাল গ্রহণ করে, এলাকার মানুষজনের কাছে সাধ্যমতো সাহায্যের আবেদন জানানো হয়। দূরের বন্ধুরাও এগিয়ে আসে। তারাও অনেক মানুষের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করে। উদাহরণ স্বরূপ ২০০৭ ও ২০০৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা ৮৫০০০ টাকা দান করে। তারা এই অনুদান সংগ্রহ করেছিল তাদের বাবা-মা বন্ধুবান্ধব শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রভৃতিদের কাছ থেকে। তাদের দান হাসপাতালে একটি ঘর তৈরি ও এক্স-রে মেশিন কেনার কাজকে ত্বরান্বিত করেছিল।
একটা নতুন পদক্ষেপ গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক মানুষের অংশগ্রহণ তুলনামুলক ভাবে সহজ। কিন্তু কঠিন কাজটি হল প্রতিদিনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে চলা। হাতের ওপর হাতটি রাখা সহজ, হাত ধরে চলাটাই কঠিন। আর সেই কঠিন কাজটি বিগত বারো বছর ধরে সুন্দরভাবে অনুষ্ঠিত করে চলেছে সুন্দরবন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য-প্রকল্প। এখানে কেবলমাত্র ডাক্তারদেরই নিয়মিত পারিশ্রমিক দেওয়া হয়, যদিও সেটা তুলনামুলক ভাবে অনেক কম। আবার অনেক ডাক্তার আছেন যাঁরা সেটুকুও গ্রহণ করেন না।
অন্য সমস্ত প্যারামেডিকাল কাজকর্ম চালায় হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীরা যারা স্বেচ্ছায় মানুষের সেবার কাজ করে চলেছে এবং এই কাজকে তারা তাদের সামাজিক দায়িত্ব বলে মনে করে। বেশিরভাগই কৃষক পরিবার থেকে আসা এই ছেলেমেয়েরা বেশিমাত্রার প্রথাগত শিক্ষার সুযোগও পায়নি। বেলুড় শ্রমজীবী হাসপাতাল থেকে এরা হাসপাতালের ট্রেনিং নিয়েছে। বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষা করা, ইঞ্জেকশন দেওয়া, ওষুধ দেওয়ার মতো কাজে এরা যথেষ্ট দক্ষ। হাসপাতালের সমস্ত ওয়ার্ডগুলোকে তারাই পরিষ্কার করে। এরা কেউই হাসপাতাল থেকে মাস-মাইনা পায় না এবং বেশিরভাগই হাসপাতালেই থাকে। একটি রান্নাঘরেই সকলের রান্না, এই ব্যয়ভার মেটানো হয় হাসপাতালের তহবিল থেকে।
কৃষিচক্রের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য কাজ, যেমন ধানচাষ, সবজিচাষ, মাছচাষ, পোলট্রি, মৌমাছি পালন, মশলা পেশাই ও প্যাকেটিং এবং আচার তৈরি ইত্যাদি কাজের দায়িত্ব এই স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেই ভাগ করে দেওয়া আছে। এই সমস্ত ক্ষেত্র থেকে উপায়িকৃত অর্থের খুব সামান্য একটা অংশই তাদের আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ চালানোর জন্য দেওয়া হয়। দু-তিনজন সদস্যের ওপরে কৃষিচক্রের নির্ধারিত কিছু দায়িত্ব থাকলেও বেশিরভাগরাই প্রয়োজন মতো সব কাজ করে থাকে। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় কৃষি চক্রের সদস্যেরা একসাথে সারাদিনের কাজের পর্যালোচনা করে, পরেরদিন হাসপাতাল ও কৃষিখামারের কে কোথায় কাজ করবে তাও স্থির হয় এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে। চক্রাকারে তাদেরকে হাসপাতালে নাইট ডিউটিও দিতে হয়। তবে যে কোনো আপৎকালীন মুহূর্তে সবাই সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসে।
Leave a Reply