২০ জুন ২০১২ নোনাডাঙার বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ধর্মতলায় প্রতিবাদে শামিল আন্দোলনকারীদের প্রথমে গ্রেপ্তার, পরে পুলিশ হেফাজত ও জেল হেফাজতে থাকার সময়ে জেলের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জেলের অবস্থা সম্পর্কে জানিয়েছেন রঞ্জন#
বিগত প্রায় তিন মাসের বেশি সময় ধরে নোনাডাঙায় বস্তি উচ্ছেদের প্রতিবাদে শামিল হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু কোনোভাবেই আন্দোলনকারীরা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারছে না। এদিকে ২৪ মে-র ডেপুটেশনের পর সরকারের তরফে কোনো আলোচনা শুরু না হওয়া এবং বর্ষা এসে পড়ায় আন্দোলনকারীদের মধ্যেও সর্বশেষ অবস্থা বুঝে নেবার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। নোনাডাঙার উচ্ছেদ হওয়া বস্তিবাসীদের মধ্যে যারা মাঠের মধ্যেই ঠিকানা গড়েছিল তাদেরকে ক্রমশ মিটিং মিছিলে আসা বা যোগ দেওয়ার ওপর প্রায় প্রতিদিনই চলছিল ভয় দেখানো ও হুমকি। এই অবস্থায় ২০ জুন উচ্ছেদ হওয়া বস্তিবাসী এবং এই আন্দোলনের সমর্থকদের যৌথ সিদ্ধান্তে ধর্মতলায় অবস্থান বিক্ষোভের কর্মসূচি হয়।
ধরনার সকালে প্রথম থেকেই নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান বিক্ষোভের পরিবর্তে পুলিশের দেখানো ধর্মতলার ণ্ণওয়াই’ লেনে বসতে বলা হয় আন্দোলনকারীদের। ছোটো ছোটো উপদলে জমায়েত হওয়া বস্তিবাসীদের নিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয় এগারোটার পরিবর্তে দুপুর প্রায় দেড়টা নাগাদ। ধরনা চলাকালীন উচ্ছেদ কমিটির এক প্রতিনিধি দল মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চায়। এ ব্যাপারে পুলিশের পক্ষ থেকেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২৬ জুন তারিখে মন্ত্রী দেখা করার লিখিত প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর আন্দোলনকারী বস্তিবাসীদের কমিটির তরফে নোনাডাঙার মাঠে ঢোকার সামনে ময়লা ফেলার ভ্যাটটিকে তুলে দেবার আবেদন নিয়ে একটা সংশোধনী দাবিপত্র মন্ত্রীকে দিলে মন্ত্রী পুলিশ মারফৎ জানান যে কোনো লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে না। ফলে আন্দোলনকারীরা সন্ধ্যের পরও তাদের ধরনা চালিয়ে যায়। রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ পুলিশ ১৫ মিনিটের মধ্যে আন্দোলনকারীদের স্থান খালি করে দিতে বলে। কিন্তু তাতে রাজী না হওয়ায়, হঠাৎ পুলিশ প্রচণ্ড মারমুখী হয়ে লাঠি চার্জ শুরু করে।
সঞ্জয় বলে একজন বস্তিবাসী প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায়। তাকে পরে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। আমরা ৩২ জন গ্রেপ্তার হই। সাথে রঞ্জন গুপ্তা বলে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এর সাথে ধরনায় অংশগ্রহণকারী আন্দোলনকারীদের কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো কিছু না করেই ছেলেটি ভারত রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার দ্বারা ১৭ দিন জেল খাটল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ণ্ণওয়াই’ লেনে পুলিশ প্রশ্ন করে করে পথচলতি সাধারণ মানুষকে আসতে বাধা দিচ্ছিল এবং লাঠিচার্জের সময় মৃণাল জানা বলে একজন ক্যামেরাম্যানের ক্যামেরা কেড়ে নেয়। পুলিশের মারমুখী মেজাজের ছবি যে ক্যামেরায় তোলা হয়েছিল তার থেকে প্রয়োজনীয় রিলগুলি খুলে নিয়ে পরে তারা ক্যামেরা ফেরত দেয়।
পুলিশের লাঠিচার্জের সময় আহত সঞ্জয়কে রাতে পুলিশ মেডিকেল কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু তার খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পরের দিন লালাবাজারের লকআপে জেলের ডাক্তার দেখে তাকে হাসপাতালে না পাঠিয়ে কিছু ওষুধ দেন। কিন্তু তাতেও সে খাওয়া শুরু করতে পারে না। পরে রাতের দিকে অনেক চেঁচামেচির পর ডাক্তার দেখে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন।
লালবাজারের লকআপ জেলের কয়েদিদের যে পোশাক দেওয়া হয় তা কোনো সভ্য মানুষের জন্য হতে পারে না। একটা কাপড়ের টুকরো যার মাথার দিকটা কাটা। শরীরের নিচের অংশের জন্য হুক বা বোতাম বিহীন একটা প্যান্ট। টানা পাঁচ দিন সেই একই কাপড়ে কাটাতে হত। কোনোরকম কাচা ধোওয়ার ব্যবস্থা নেই। এমনকী স্নান করা বা দাঁত মাজার জন্য কোনোরকম সাবান, তেল বা মাজনের ব্যবস্থা থাকে না। পরে অনেক বলা কওয়ার পর শৌচালয়ে সাবান ও দাঁত মাজার জন্য নুন-তেলের ব্যবস্থা হয়। তাহলে কি কয়েদিদের জন্য সাবান ও দাঁত মাজার মাজনের ব্যবস্থা আছে, অথচ তা কয়েদিদের দেওয়া হয় না? না অন্য কিছু?
লালবাজার লকআপ জেলে আমাদের সাথে গ্রেপ্তার হওয়া সত্তরোর্ধ মোহন মণ্ডল নামে একজন ব্যক্তির মেঝেতে শোয়ার কারণে ঠান্ডা লেগে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন আমরা সকলে চেঁচামেচি করলে মোহন মণ্ডলের জন্য একটা কম্বলের ব্যবস্থা করা হয়। জেলের খাবার খেয়ে এবং মেঝেতে শুয়ে অনেককেই সাইনাস, সর্দি-কাশি, পেট খারাপ, শ্লেষ্মায় ভুগতে দেখা যায়। আমি নিজেও প্রতিদিনই পেটখারাপে ভুগতাম। পরে জানতে পারি সেটা জলের কারণে। কারণ জেলের সকলেই বাইরে থেকে জল এনে খায়। আর আমাদের খেতে হত শৌচাগারের মধ্যে আসা কলের জল। প্রসঙ্গত বলা দরকার জেলের শৌচাগারগুলি উন্মুক্ত। এ জাতীয় ব্যবস্থায় অনেকেই অভ্যস্ত নয়।
Leave a Reply