কাজল মুখার্জি, কলকাতা, ৩০ অক্টোবর#
হ্যামলেট : ডেনমার্ক এক কারাগার
রোজেন : তবে পৃথিবী-ও তাই
হ্যামলেট : নিশ্চয়ই সুকঠিন এক কারাগার, যার মধ্যে বহু বেষ্টনী, বহু অন্ধকূপ; ডেনমার্ক এদের মধ্যে জঘন্যতম গুলির একটি।
(উৎপল দত্তের শেকসপিয়ারের সমাজচেতনা থেকে অনুবাদটি গৃহীত)
হায়দার : কাশ্মীর এক কারাগার
হায়দার যখন একথা বলে, তখন কাহিনীচিত্রর খণ্ড খণ্ড দৃশ্যে আমরাও বুঝতে শুরু করেছি কারাগার শব্দের ব্যঞ্জনা। এ এক অন্য কাশ্মীর, ‘কাশ্মীর কি কলি’, ‘এক ফুল দো মালি’ বা কয়েকশো বলিউডি ফিল্মের হাস্যময়ী, লাস্যময়ী দর্শকদের উপভোগ ধন্যা কাশ্মীর নয়। ‘রোজা’র বা বিধুবিনোদ চোপড়ার কাশ্মীরও নয় যেখানে শুধু পাকিস্তানের প্রক্সি-ওয়ার আর ভারতীয় সেনানীর বীরত্বের লড়াই। কাশ্মীরের জনগণের এক নিষ্ক্রিয় উপস্থিতি আর আমাদের জাতীয়তাবাদের জয় উল্লাস। এই কাশ্মীরে অমলিন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে লেগে থাকে মানুষের হাহাকার, রক্ত, মানুষের অপমান, স্মৃতির কাতরতা। এই কাশ্মীরের মানুষ বিদায়ী সূর্য্যের আলোয় ডাল লেকে নৌকা চালাতে চালাতে মৃদুস্বরে গায় ব্যাথার গান ‘লাল লাল হুয়া ঝিলম’। এই প্রেক্ষাপটের মধ্যে ভরদ্বাজ গ্রথিত করে মানুষের প্রেমকে, মানুষের হিংসাকে, লোভকে, মহত্বকে, বীরত্ব, বিশ্বাসঘাতকতাকে, নিচতাকে, মানবসত্ত্বার আলো অন্ধকার খেলতে থাকে কাশ্মীরের উপত্যকায়, প্রেক্ষাগৃহের পর্দায়।
প্রথম দৃশ্যেই আমরা শ্রীনগর শহরকে দেখি। এ শহর ট্যুরিস্টের শহর নয়। সকালের মায়াবী আলো। বোবা হয়ে তাকিয়ে আছে শহরের দিকে। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু ‘মিলিটেন্ট’। একটা ঘরে ভারতীয় সেনার গুলিতে আহত এক ‘মিলিটেন্ট’-এর চিকিৎসা করছেন কাশ্মীরি ডাক্তার। হায়দারের বাবা এই ডাক্তার, প্রতিষ্ঠিত, সম্মানিত। নিজের জীবনের সমস্ত কিছুকে বাজি ধরে এই ‘মিলিটেন্ট’কে ডাক্তার নিয়ে আসে নিজের বাড়িতে শল্য চিকিৎসার জন্য। মাকড়সার জালের মতো রাষ্ট্রের চোখ, কান জড়িয়ে আছে কাশ্মীরের ঘরে ঘরে। খবর পৌঁছে যায় রাষ্ট্রের কাছে, রাষ্ট্র মানে ভারতীয় সেনা। ধরা পরে ডাক্তার। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ডাক্তারের বাড়ি। ডাক্তারকে নিয়ে যাওয়া হয় সেনা ক্যাম্পে। হারিয়ে যায় ডাক্তার চিতদিনের মতো। বাড়িতে চিকিৎসার আগে স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তরে ডাক্তার জানিয়েছিল, ‘সে জীবনের পক্ষে’। হাজার হাজার লাশের দুই দিকে শুধু দুটো পক্ষ। কাশ্মীরি মানুষের বহু চিহ্ন মুছে গিয়ে শুধু দুই পক্ষের এ পরিচইয়ই এখন নিয়তি। হারিয়ে গেছে জীবন শব্দটা, ডাক্তারও হারিয়ে যায়।
হারিয়ে যাওয়া সব কিছুকেই খোঁজা আলিগড় থেকে কাশ্মীরে ফিরে এসে হায়দারের যেন নিয়তি। হারিয়ে গেছে তার বাবা, অগ্নিদগ্ধ হয়ে হারিয়ে গেছে তার বাড়ি, কাকার দুহাতের বেষ্টনের মধ্যে হারিয়ে গেছে তার মা-ও। তার পরিচয়ও হারিয়ে গেছে, প্রেমিকার বাবা, দাদার কাছে সে শুধু এক হারিয়ে যাওয়া ‘মিলিটেন্ট’ ডাক্তারের ছেলে। হায়দার নেমে আসে রাস্তায়, দেখা যায় হায়দারের নিয়তি মিশে গেছে কাশ্মীর উপত্যকার হাজার হাজার মানুষের সাথে। মায়েরা চাইছে সেনার হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সন্তানের খোঁজ। এক নতুন শব্দ, যা শুধু কাশ্মীরেই শোনা যায়, হাফ-উইডো বা অর্ধ-বিধবা — যাদের স্বামীরা সেনা হেফাজতে, স্ত্রীরা জানেনা তাদের জীবন মরণের খবর। সেই হাফ-উইডোরা অর্ধেক বৈধব্যের ধূসরতা নিয়ে খোঁজ চাইছে তাদের স্বামীর। যে সব সন্তানরা বাবাকে সেনারা ধরে নেওয়ার পর জন্মেছে, বাবাকে দেখেওনি, তারা চাইছে বাবার খোঁজ।
সেনা গাড়ি ভর্তি লাশের পাহাড় শুধু চুপ করে থাকে। দ্রুততালে সঙ্গীত বেজে ওঠে, ‘লোহু, লোহু খুন হুয়া রে’। সমগ্র কাশ্মীরই যেন একটা দৃশ্যে আমরা দেখি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘হাম হ্যায় কি হাম নেহী’।
রহু, সেনা ক্যাম্পে হায়দারের বাবার সহবন্দী, হায়দারকে বলে, ভয়ঙ্কর অত্যাচারে তার বাবার মৃত্যুর খবর। তার বাবাকে ধরিয়ে দিয়েছিল তার ভাই, হায়দারের কাকা, তার মায়ের হবু স্বামী। রহুর বর্ণনায় দৃশ্যায়িত হয় অত্যাচারের নিষ্ঠুরতা, বন্দুকের সামনে বন্দীদের বলতে বাধ্য করা, ‘জয় হিন্দ’। ভারতের জাতীয়তা যেন নিজেকে নগ্ন করে মেলে ধরেছে এইসব দৃশ্যে। রহু হায়দারের হাতে তুলে দেয় আগ্নেয়াস্ত্র, মনে করিয়ে দেয় বাবার শেষ ইচ্ছা, ‘দুই চোখের মধ্যে ভরে দিতে হবে গুলির দানা’। যে ধরিয়ে দিয়েছে তাকে, সেই তার ভাইকে। হায়দার রহুর নির্দেশিত কবরস্থানে বাবার কবরের কাছে দাঁড়ায়। বরফে ঢেকে আছে সমগ্র উপত্যকা, আর সার সার সংখ্যা দিয়ে, শুধুমাত্র সংখ্যা দিয়ে চিগ্নিত নামহীন মানুষদের কবর। নিয়তি তাকে নিয়ে আসে এক আগুন থেকে আরেক আগুনে, প্রতিহিংসার আগুন। পাগল হয়ে বা সেজে, সত্যিকারের অথবা অভিনয় করে হায়দার যখন চৌমাথায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে, ‘ম্যায় কা চাহেতে, আজাদি’, চকিতে আমাদের মনে উঁকি দিয়ে যায় কিছু আগেই রহির কন্ঠস্বর, আমরা শুনি,
ম্যায় হুঁ ঝিলম
ম্যায় হুঁ চিনার
ম্যায় হুঁ পণ্ডিত
ম্যায় হুঁ শিয়া
ম্যায় হুঁ সুন্নি
ম্যায় হুঁ কাশ্মীর
এক প্রাচীন রূপকথার মতো, অতিকথার মতো এক স্বপ্নের কাশ্মীর জেগে ওঠে রহুর উচ্চারণে। রহু মানে বোধহয় আত্মা।
তারপর হিংসা, প্রতিহিংসা, খুন আর খুন। রক্ত মাখা হাজার হাজার মানুষের কবরের ওপর দাঁড়িয়ে হায়দারের মা আত্মঘাতী হবার আগে একবার উচ্চারণ করে, ‘ইন্তেকাম সে আজাদি’, অর্থাৎ এই প্রতিহিংসা থেকে স্বাধীনতার কথা।
রিভলবার এগিয়ে আসে ‘গদ্দর’ কাকার চোখের ওপর। শরীর আর মনে ছিন্নভিন্ন কাকা মৃত্যুকে আকাঙ্খা করে হায়দারের কাছে। হায়দার প্রতিজ্ঞা পালনে, প্রতিশোধে ট্রিগারে হাত রাখে। এক অদ্ভুত বিপন্নতা আর বিষণ্নতায় যেন ক্লান্ত সে। ট্রিগার টেপা হয়না, এগিয়ে চলে। এই কবরখানা, মৃত্যু আর ধ্বংস ছেড়ে। একদম একা। শীতের বরফে মোড়া কাশ্মীরেরই মতো রিক্ত হায়দার। হারানো স্বজন, স্বদেশ খোঁজা দিয়ে যে হায়দারের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আরো আরো শূণ্যতায় ভরে যায়। কাশ্মীর যেমন তার প্রিয় সন্তান হাজার হাজার কাশ্মীরি সে মুসলমান হোক, পণ্ডিত হোক, মৃত হোক, পলাতক হোক, শূণ্য করে দিয়েছে তাকে, হায়দারও তার প্রেমিকা, মা, বহু বন্ধু, শ্ত্রু হিসেবে মিত্র হিসেবে হারিয়ে রিক্ত হয়ে এক শূণ্যতার মহাদেশ থেকে যাত্রা করে।
‘সেই সব হলুদ পাতা ছাওয়া জঙ্গলের দিকে, ওই হলুদ মরে যাওয়া পাতাগুলিই আমার দেশ। বেদনায় পুঞ্জিভূত আমার এই যে দেশ, সেই দিকে।
‘সেই দুঃখিত মায়ের কাছে
সেই বিধবার কাছে
সেই ছাত্রদের কাছে
বর্তমানের দিকে
বর্তমানের দুঃখের কাছে’
ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের এই কবিতাটি গান হয়ে প্রেক্ষাগৃহে ছড়িয়ে পরতে থাকে। ছবি শেষ হয়। প্রতিহিংসা ঘনিয়ে আরও এক মহৎ প্রয়াসের দিকে কি সেই অভিযাত্রা?
Leave a Reply