অমিতাভ সেন, কলকাতা, ১২ অক্টোবর#
মোবাইলের দৌলতে চলন্ত যানবাহনগুলো যেন একটা নাট্যশালা হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন যাত্রী বিভিন্ন সিটে যেন রঙ্গমঞ্চের বিভিন্ন কোণে বসে নানারকম দৃশ্যের অবতারণা করে চলেছে। অবশ্যই এগুলো বেশিরভাগ শ্রুতি নাটক। তবু প্রত্যেকের একক অভিনয়ে এক-একটা ঘটনা অনুমান করে নেওয়া যায়। যেমন ঢাকুরিয়া-বিবাদিবাগ মিনিবাসে এই সন্ধ্যেবেলা :
পিছনের সিটের ডানদিকের কোণে এক যুবতীর উদ্বিগ্ন মুখ, গম্ভীর গলা, — কানে ধরা কালো মোবাইলে সে বলছে, ‘সেজো মামা ট্রেনে উঠেছে, বড়ো মামা আসছে, আমি তো এই বাসে, হ্যাঁ, খারাপ তো বটেই, আমি আর কিছু জানি না, হ্যাঁ ঠিক আছে, … তুমি যা পারো করো, দেখছি দেখছি …’। এতটা দেখে শুনে আমার মতো দর্শক – শ্রোতা অনুমান করে নিতেই পারে যে ওই মেয়েটার কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে বা অন্য কোনো বিপদ হয়েছে।
ওদিকে বাঁদিকে আমার সামনের সিটে অফিস ফেরত যুবক। ফুলহাতা বুশশার্ট গুঁজে পড়া, কোলে ঢাউস ব্যাগপ্যাক, ডান হাতে ঘড়ি, অনামিকায় পলার আংটি সোনায় বাঁধানো, সাদা ঢাউস মোবাইলে স্ক্রীন ছুঁয়ে ফোন করল, ‘কাল সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে বারোটা চেষ্টা করেছি। কার সঙ্গে কথা বলছিলি।’ ফোনের ওপাশে একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর আমার সীট থেকে শোনা যাচ্ছে, যদিও কথাগুলো বোঝা যাচ্ছে না। যুবক উত্তেজিত, ‘এটা কিন্তু লাস্ট ওয়ার্নিং। রাত দশটার পর অন্য কোনো লোক — বন্ধু-ফন্ধু কারো সঙ্গে এনগেজমেন্ট রাখা চলবে না।’
নাট্যমঞ্চের আলো সরে গিয়ে পড়ল ডানদিকে সামনের সিটে। মোটা-সোটা, কায়দার চশমা পরা একজন বয়স্ক লোক। তার ঘ্যাড়ঘেড়ে গলায় সংলাপ শুরু হয়, ‘দুর্গাপুরের কেস আলাদা, কলকাতা থেকে ওখানে মাল পাঠাতে হলে নটরাজকে ধরতে হবে। আর, নটরাজকে তোমাদের নিজেদের মধ্যে নিয়ে নিতে পারলে না। ওর হাতেই সব। ঠিক আছে, ছাড়ো আমি কথা বলে নিচ্ছি।’
পিছনের সিটের উদ্বিগ্ন যুবতী দেশপ্রিয়তে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল। সামনের সিটের যুবকের কথা ভেসে উঠল, ‘আমায় ফোন করলি কেন? পারবি, পি.জি. হাসপাতালের সামনে চলে আয়। ক্ষমতা থাকলে হাওড়া স্টেশনে এসে দেখা কর্। পারবি না তো? আরে, আমাকে তো কথা বলতেই হবে। এ ফোনটা তো কাজের ফোন, অফিসের সঙ্গে যে কোনো সময়ে যোগাযোগ করতে হবে। আবার বলছি, আমি কিন্তু রাত দশটার পর অন্য কাউকে অ্যালাও করব না।’ অনুমান করা যায় না কি যে, যুবকটি প্রেমিকা বা ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলছে? বান্ধবী তাকে ফোনে পায়নি — এরকম পালটা অভিযোগে অফিসের কাজের কারণ দেখাতে হয়েছে — এবং তা সত্ত্বেও পৌরুষের-দাপট প্রেমের অধিকারবোধ যুবকটির কথা শুনে আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় কি?
হয় না। সামনের ডানদিকের বয়স্ক মানুষটির ব্যবসা সম্পর্কিত কথাবার্তা থেকেও আন্দাজ করা যায়। বিশেষত যখন তিনি তাঁর দ্বিতীয় ফোনে ‘নটরাজ’ নামক ব্যক্তিটিকে ধরে আধো হিন্দি আধো বাংলায় প্রচুর হেঁহেঁ করে তেল লাগানো কথাবার্তা বলতে থাকেন এবং গলার স্বরটা অনেকটা নামিয়ে আনেন ও পাশের যাত্রীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুখ বিড়বিড় করেন তখন মতলব আঁটার একটা দৃশ্য তো স্পষ্টই ফুটে ওঠে। আমাদের চোখ-কান এবং অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার একটু খোলা রাখলে রোজই তো এমন জীবন্ত নাটক কতই দেখতে পাই চলতে চলতে।
Leave a Reply