৭ জুন বারাসাত ২নং ব্লকের কীর্তিপুর ২নং গ্রাম পঞ্চায়েতের কামদুনি গ্রামের ২০ বছর বয়সি কলেজ-ছাত্রী শিপ্রা ঘোষকে দিনেরবেলায় ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। এরকম ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু যেটা সকল সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়, তা হল, এই ঘটনার পরে শিপ্রার পরিবার সরকারি অর্থ ও চাকরিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং সরকারের কাছে সুবিচার প্রার্থনা করে। তাঁদের এই দৃঢ় মনোভাবকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে জনআন্দোলন এবং ‘কামদুনি প্রতিবাদী মঞ্চ’। গত চারমাস ধরে এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে বিপথগামী করার জন্য সরকার ও শাসকদল সর্বোতভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে। ইদানীং দুর্গাপুজোর ঠিক আগে মিডিয়া মারফত সকলে জানতে পারে যে ওই পরিবার সরকারি অর্থ ও চাকরি গ্রহণ করেছে এবং গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। এই ঘটনার পর আমরা পত্রিকার পক্ষ থেকে ‘কামদুনি প্রতিবাদী মঞ্চ’-এর সভাপতি ভাস্কর মণ্ডলের সঙ্গে ১২ অক্টোবর কথা বলি। তাঁর বক্তব্যের কিছুটা অংশ এখানে প্রকাশ করা হল।
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নাম করে সোজা মহাকরণে
ওরা প্রথমে শুরু করেছিল, আমরা চাকরি বা টাকা নেব না, যার জন্য এত বড়ো আন্দোলন হল। আমরাও তাতে নেমেছিলাম। একটা দরিদ্র পরিবার, কিন্তু তাদের একটা আত্মসম্মান আছে। পরবর্তী সময়ে তাদের ভুল বুঝিয়ে চাকরি ও টাকা নেওয়ানো হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে সুবিচার অবশ্যই হবে। সেই আশায় হয়তো ওরা চাকরি নিয়েছে। কিন্তু ওরা যে চাকরি এবং টাকা প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেটাই আমাদের গর্বিত করেছিল এবং আমরা আন্দোলনটা শুরু করেছিলাম। আমার মনে হয় যে কোনো প্রকারে ওদের ভুল বুঝিয়ে ওগুলো নেওয়ানো হয়েছে যাতে আন্দোলনটাকে আর বড়ো না করা যায়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার নাম করে ওদের সোজা মহাকরণে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেদিন আমি বাড়িতে ছিলাম না, ব্যক্তিগত কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। ওনার বাবা-মায়ের শরীরটা খারাপ হয়েছিল। বাইরে থেকে গাড়ি এসেছিল। ওরা গেল, প্রথমে ওদের আরজিকর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর থেকে ওদের ফোনের সুইচ অফ রয়েছে। পুলিশ আমাদের ওদের বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি। ওরা যখন চাকরি আর টাকা নিয়ে ব্যাক করল, আমাদের প্রতিবাদী মঞ্চের ৪৬ জন আমরা মিটিংয়ে বসেছিলাম। বসার পর ওদের ফ্যামিলিকে ডাকতে গিয়েছিলাম। পুলিশ আমাদের ঢুকতে দেয়নি। পুলিশ বলল, যদি ওদের সঙ্গে কথা বলতে হয় ফোনে কথা বলো। আমরা বললাম, আপনাদের পারমিশন নিয়ে ঢুকছি। ওরা বলল, কোনো পারমিশনই নেই তো আপনারা ঢুকবেন কী করে? যখন ফোন করলাম, ফোনের সুইচ অফ বা রিঙ হয়ে যাচ্ছে, কল রিসিভ হচ্ছে না। তারপর থেকে ওদের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। ওরা রাস্তায় বেরোচ্ছে না। বাড়ির থেকে গাড়ি করে ওরা চলে গেছে, কোথায় গেছে কেউ জানে না। তা সত্ত্বেও দোষ দেওয়া হচ্ছে যে আমাদের প্রতিবাদী মঞ্চ ওদের হুমকি দিয়ে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। চাকরি ও টাকা নেওয়ার ব্যাপারে গ্রামবাসী ওদের ওপর ক্ষুব্ধ এই কারণে যে ওরা এতদিনই তো নিতে পারত। গ্রামকে এত দূর নিয়ে গিয়ে এখন পিছিয়ে পড়াটা ওরা মনে হয় ঠিক করেনি। ওদের প্রতিবেশীরা ওদের সঙ্গে কথা বলছে না। শান্তিরক্ষা কমিটির ব্লাড ডোনেশন প্রোগ্রামের সম্ভবত দু-দিন আগে এবিপি-র প্রোগ্রামে ওর ভাই এসেছিল, সেখানে ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল। ও বলে, ‘আমাদের কেউ বাড়িছাড়া করেনি। আমরা স্ব-ইচ্ছায় বাড়ি থেকে চলে এসেছি। আমরা আগামীকাল বাড়িতে যাব।’ পরবর্তী সময়ে ও বাড়িতে এসেছিল, ব্লাড ডোনেশন ক্যাম্পে ছিল। সেইদিনই ওরা আবার বাড়ি থেকে চলে যায়। ৭ জুন ঘটনাটা ঘটেছিল, প্রতিমাসের ৭ তারিখ আমরা গ্রামে একটা স্মরণসভা করি। এরপর ৭ অক্টোবরের স্মরণসভার জন্য আমরা ওদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পাইনি। আগামীদিনেও আমরা স্মরণসভাটা চালিয়ে যাব। ওদের ডাকব। এবারের স্মরণসভায় বৃষ্টির মধ্যে সারা গ্রামবাসী এসেছে, বাইরের প্রতিবাদী মানুষও এসেছে। প্রায় এক হাজার লোক হয়েছিল।
কামদুনি শান্তি রক্ষা কমিটিতে গ্রামের বাইরের লোকই বেশি
আমাদের প্রতিবাদী মঞ্চ নারী নির্যাতন বিরোধী। আমরা চাই, পশ্চিমবাংলার যেখানে এই ধরনের ঘটনা ঘটবে, আমরা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াব। আমরা চাই তারা সুবিচার পাক। পরবর্তীকালে চাকরি, টাকা এগুলো তো তাদের পাওনা। … প্রথম থেকে সমস্ত গ্রামবাসীরা মিলে আমরা আন্দোলনটা শুরু করেছিলাম। কামদুনিতে আমাদের চারটে পাড়া আছে। সমস্ত গ্রামবাসীকে আমরা ডেকেছিলাম। তারা সকলে মিলে ঠিক করেছিল, কারা কোন পদে থাকবে। আমি সভাপতি, মৌসুমি কয়াল সম্পাদক। আমরা কোনো চাঁদা তুলিনি। যার যেরকম সামর্থ নিজের নিজের পকেটের পয়সা খরচ করেই আমরা সব কাজ করেছি। পরে যখন মাননীয় খাদ্যমন্ত্রী এসে শান্তি রক্ষা কমিটি গঠন করলেন (গত মাসে), আমাদের বিরুদ্ধে রটনা হচ্ছে আমরা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি। আসলে আমাদের আন্দোলন তো সরকার বিরোধী না। আমাদের উদ্দেশ্য হল নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং তাদের সুবিচার পাইয়ে দেওয়া। আমরা নাকি লক্ষ লক্ষ টাকা বাজার থেকে তুলেছি, নিজেদের আখের গোছাচ্ছি, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমরা নন-পলিটিকাল, কোনো পার্টির সঙ্গে আমরা যুক্ত না। সমস্ত পার্টির লোক আমাদের সঙ্গে আসতে পারে, কোনো ব্যানার নিয়ে নয়। বর্তমানে যাঁরা সরকারে আছেন, ওনারাও আসতে পারেন। ওনারা যদি কোনোভাবে আগ্রহী হন, আমাদের ডাকেন, অবশ্যই আমরা যাব। শান্তি রক্ষা কমিটি আমাদের সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। আমাদের নামে কেচ্ছা রটিয়েছে, আমরা লক্ষ লক্ষ টাকা কামিয়েছি, দিল্লি গিয়ে টাকা নিয়ে এসেছি। ওদের পরিবারকে দেখিয়ে বাজার থেকে অনেক টাকা রোজগার করছি। এগুলো আমাদের ছোটো করা এবং প্রতিবাদী মঞ্চকে থামিয়ে দেওয়া। … আমি শুনেছি যে কমিটিতে আমাদের গ্রামের একজন প্রাক্তন মাস্টারমশাই আছেন, ওনার নাম শেখ সিরাজুদ্দিন আহমেদ। ঘটনাটা ঘটার পর শান্তি রক্ষা কমিটি গঠন হওয়া পর্যন্ত উনি আদৌ গ্রামে আসেননি বা ওদের পাশে দাঁড়াননি। হঠাৎ করে যখন কমিটি গঠন করা হল, তখন ওনাকে প্রেসিডেন্ট করা হল। কমিটিতে গ্রামের বাইরের লোকই বেশি, গ্রামের লোক কয়েকজন আছে। আমি যতদূর শুনেছি, ওই কমিটিতে ১২ বা ১৫ জন সদস্য আছে।
অনেক ছেলে আন্দোলনের জন্য কাজ ছেড়ে দিয়েছিল
এখন শাসন পুলিশ ফাঁড়িটা থানা হয়েছে। গ্রামে পুলিশ ক্যাম্প আছে, মোড়ে মোড়ে পুলিশ আছে। আর আমার ওপর প্রেশার তো আছেই। আমার বাড়িতে পুলিশ গিয়েছিল, সার্চ করেছিল, আমাকে খুঁজছিল। আমি কোনো রাজনীতি করি না। আইনত কারও বাড়িতে সার্চ করতে গেলে একটা অর্ডার লাগে। সকাল সাড়ে এগারোটা পৌনে বারোটা নাগাদ কোনো অর্ডার ছাড়াই ওরা আমার বাড়িতে ঢুকে সার্চ করেছে। আমি পুলিশকে পরে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম।
আগে আমি রাজারহাটে ডিএলএফ-এ কাজ করতাম। এখন কোথাও করছি না। ঘটনা ঘটার দিন থেকে আমি চাকরি থেকে রিজাইন দিয়ে দিই। আমি তিনমাস কাজ ছেড়ে আছি। আর্থিক দিক দিয়ে তো ক্ষতি হয়েছেই। বাবা মাছের বিজনেস করেন। বাড়িতে মা, বাবা আর ভাই আছে, বোন দুটো ছিল, বিয়ে হয়ে গেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ঘটনায় নাড়া খেয়েছিলাম। এখন আমাকে কাজে ফিরতে হবে। দেখি কী পাওয়া যায়। অনেক ছেলে সেইসময় কাজ ছেড়ে দিয়েছিল আন্দোলনের জন্য। কেউ কেউ কাজে ফিরে গেছে। এখনও তিন-চারজন আছে।
আমাদের মন যে শক্ত ছিল তা ওনাদের জন্যই। কিন্তু ওদের ফ্যামিলিটা যখন চলে গেছে, একটু দুর্বলতা তো আসবেই। তবে আগে গ্রামে মেয়েদের ওপর যেসব ঘটনা হত, অনেকটা কমে গেছে।
Leave a Reply