অমিত মাহাতো, ১৪ জুলাই#
অবশেষে আষাঢ়ের তৃতীয় শনিবার পাহাড়পুজো উপলক্ষ্যে বন্ধু মৃণালকান্তি মাহাতোর সাথে বেরিয়ে পড়লাম কানাঈশ্বরের বাড়াঘাটের মেলায়। সকাল ন-টা পনেরোর খড়গপুর টাটা আপ লোকাল ট্রেনে চাকুলিয়ার টিকিট কেটে, ও খড়গপুর আর আমি খাটকুড়া থেকে চড়ে বসলাম। আগের দিন অর্থাৎ পাহাড়পূজার দিন বৃষ্টি হওয়ায় রবিবারের দিনটি ছিল ঠান্ডা। সাড়ে এগারোটা নাগাদ নামলাম চাকুলিয়া স্টেশনে। বেশ ভিড় এবং বেশিরভাগ যাত্রীই আদিবাসী। ওদের ঠিকানা একটাই। বাড়াঘাটের মেলা। চাকুলিয়া থেকে উত্তরে দশ কিমি দূরে এই মেলার গ্রাম। ছোটো গাড়ি অটো পিক আপ টেম্পো এইসব গাড়ি এখন স্টেশন আর মেলা ডাক দিচ্ছে, বাড়াঘাট কুড়ি টাকা কুড়ি টাকা। অবশ্য চাকাওয়ালা পিক আপ ভ্যানের থেকে সাইজে ছোটো চারচাকার গাড়িতে সওয়ারি হওয়ার পূর্বে পঁচিশ টাকার বিনিময়ে সবজি ভাত স্টেশনের পলিথিন ঘেরা হোটেলে খেয়ে নিলাম। তবে মেদিনীপুরের স্বাদ পেলাম না। রান্না যে বেশ তাড়াহুড়া করে হয়েছে, তা খেয়ে বুঝলাম। চাকুলিয়া পুরাতন বাজার চৌরাস্তা লোহামেলিয়া জরাম অবধি পাকা রাস্তার ওপর ছুটল আমাদের ছোটো গাড়ি। জরামের বাম দিকে বাড়াঘাটের মেলায় যাওয়ার কাঁচা রাস্তা। দেখলাম মেলার গেট। এবং বাঁশ দিয়ে বানানো তোরণ। সবুজ কাপড়ে মোড়া। তীর ধনুক প্রতীকে ছয়লাপ। অর্থাৎ এটি এখানকার স্থানীয় রাজনৈতিক পার্টি ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার তোরণ। কিছুটা যেতে মেলার গ্রাম শান্তিনগরের আগে একই রকম কাপড়ে মোড়া বাঁশের তোরণ। শুধু রঙ আলাদা। এখানে তীর ধনুকের বদলে পদ্মফুলের বাহার। মেলায় স্বাগত জানানোর কথা লেখা। এবং এই অঞ্চলের বিজেপি সাংসদ বিদ্যুৎবরণ মাহাতোর বড়ো ছবি। জরামের কাছেই পশ্চিমমুখো একটি পিচ রাস্তা গেছে বালিবাঁধ গ্রাম অবধি। এই বালিবাঁধ গ্রামই মাননীয় মন্ত্রীর জন্মভিটে। বর্তমান বিজেপির এমপি অবশ্য এর আগের নির্বাচনে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার হয়ে এখান থেকেই এমএলএ হয়েছিলেন। কাঁচারাস্তা নিচু হয়ে নেমে ধানজমিন হয়ে মেলার মাঠমুখো। এ মেলায় শহরের মেলার মতো অতটা আলোর ঝলকানি না থাকলেও আদিবাসী তরুণ তরুণীর চোখেমুখে এমনকী শরীরেও অন্যরকমের আলোর আভাস। অন্যরকমের মাদকতা। আদিমতা আর চ্ছ্রজম আবন ঞু আবন রেস্কোরে দাহেন আবন’ অর্থাৎ খাও দাও ফুর্তিতে থাকো — এই জীবনদর্শনই এই মেলার স্বকীয়তা। মেলার একটা বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে আম কাঁঠালের পসরা। দোকানদানি খাবার হোটেল হাঁড়িয়া মদ এবং দূরান্তে রিজার্ভ করে আসা (বর্ধমান হুগলী) লোকজনের রান্নাবান্না খাওয়া দেখলাম। আদিবাসী পুরুষ ও মহিলা কিশোর কিশোরী থেকে তরুণ তরুণী হাত ধরাধরি করে পরব পাতা এনেছে। মাঠের পুরোনো কাঁঠালগাছকে মধ্যে রেখে সার বেঁধে নাচ। নাচ থেকে ক-পা দূরে দেখা মিলল, দুপাশে সার সার আদিবাসী বইয়ের দোকান। গুনে দেখলাম ছোটো বড়ো মিলে পঞ্চাশ খানার ওপর বই ও পত্রপত্রিকার স্টলও রয়েছে। এই আদিবাসী বইমেলা অন্য মাত্রা যোগ করেছে। বাঁকুড়ার তালডাঙরা থেকে আগত মুর্মু বুকস্টল। পুরুলিয়া মানবাজারে ইবিল সাহিত্যপত্রিকা। স্বপন প্রামাণিকের খবরের কাগজ লাহান্তি পত্রিকা। এবং ছিল কলকাতার বইয়ের দোকান। ঝাড়গ্রামের মার্শাল বামবের বইয়ের দোকানও ছিল। আদিবাসী মার্কেটে কালীপদ হেমব্রম জানালেন, এই মেলায় বই অন্য মাত্রা পায়। সে কারণেই প্রতি বছর আসি। স্টল দিই। আমরা গেলাম পরবর্তী যেখানে স্থানীয় জিনিসপত্রের বাজার বসেছে সেখানে। পাহাড়ের কোলের গ্রাম থেকে যেমন এসেছে পাহাড়ি কাঠের বাঁশি। জোড়া সত্তর টাকা। কেন্দুরি বানাম সাড়ে ছশো টাকা। পাতার তৈরি টুপি পঞ্চাশ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে দেখলাম। পাশেই বিক্রি হচ্ছে লাহান্তি পত্রিকা। ওখানে বছর তিরিশের কালীচরণ হেমব্রম বসেছেন টুপি ও ঘোঙ নিয়ে। বাড়ি পাহাড়ের কোলে মলিবনী গ্রামে। কথা বলি। মৃণাল ওর অনেক ছবি তোলে। জিজ্ঞেস করলাম,
— টুপি তো পাতা দিয়ে তৈরি। এগুলো কী পাতা? উত্তরে কালীচরণ জানালেন,
— আমরা বলি লাড়সাকাম। সাকাম মানে পাতা। বাংলায় ঘোঙ পাতা।
— কোন সময় কেমন চাহিদা থাকে?
— তা সারা বছরই বানাই। বর্ষার সময় চাষ লাগলে বেশ বিক্রি হয়।
— কত করে বিক্রি করেন?
— চল্লিশ পঞ্চাশ যেটা যেমন। ছোটো বড়ো আছে তো।
— এতে সারা বছর চলে?
— না না, বাকি দিন অন্য কাম করি। যেমন চাষের সময় ধান লাগাতে যাই। কাটার সময়ও যাই।
— নামালে?
উত্তরে মাথা ওপর নিচ করলেন কালীচরণ।
কথা প্রসঙ্গে জানালেন, তিনি বিয়ে করেছেন। এবং স্ত্রী ঘর থেকে টুপি জোগান দিচ্ছেন এই মেলায়। মৃণাল ফোন নাম্বার চাইতে স্বীকার করে নিলেন যে মোবাইল এখনও কেনেননি। সূর্য মাঝ গগন ছাড়িয়ে কখন যে পশ্চিমে পাহাড়ের মাথায় লাল হয়েছে, টের পাইনি। তবুও সময়ের হিসেব করতেই হয়। বাড়ি ফিরব তো!
Leave a Reply