অলকেশ মণ্ডল, বাগনান, ২৭ জুলাই##
আমি কাঠের কাজ করি। ঠিকাদারি আর কি। এই ঠিকাদারির সুবাদেই দীঘার কাছে একটা জায়গায় যাওয়ার কথা হয়েছিল। কথা হওয়ার দশদিন পরে আজকে গিয়েছিলাম। যিনি ফোন করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন, আপনি যেদিন আসবেন, সেদিন গন্তব্য বলে দেব। দীঘা যাওয়ার বাস রুটে বাজাবেরিয়ায় নামতে হল। সেখানে আমাদের জন্য একটা মোটরসাইকেল অপেক্ষা করছিল আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিন চার কিমি ভেতরে গ্রামের মধ্যে। মাঠের মধ্যে একটা দোতলা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে কাজের কথা যখন পারছি, তাতে তেমন আগ্রহ দেখছি না। আমি কাজ করব, ক্যাটালগ দেখাচ্ছি, কিন্তু তেমন কোনো আগ্রহ দেখছি না। আমাকে আগেভাগে তো বলাও হয়নি। এই পরিস্থিতিতে আমি বললাম, আমি তো না খেয়ে এসেছি। আমি খেয়ে আসি, তারপর কাজের বরাত নিয়ে যাব। তখন আরেকজন আমার মতো লোককে ডেকে আনার জন্য নির্দেশ দেওয়া হল মোটর সাইকেল আরোহীকে। আমাকে চা খেতে দেওয়া হল।
আরেকজন ব্যক্তি, যাকে আমার মতোই নিয়ে আসা হল, তিনি একটু বয়স্ক, ধুতি পাঞ্জাবী পরা। আমার মতোই তাকেও কিছুক্ষণ পরে চা দেওয়া হল। তারপর বাড়ির মালিকই হবেন সম্ভবত, তিনি বেরিয়ে এসে ওই বয়স্ক লোকের থেকে দু-লাখ টাকা নিলেন। পাঁচশো টাকার চারটে বান্ডিল। তারপর একটা টেবিলের পাশ থেকে একটা বাক্স খুলে সেখান থেকে একটা প্যাকেট বের করলেন। তার থেকে দুই বাই এক ফুট প্লাস্টিকের মোড়কের মধ্যে সিল করা কয়েকটি দশ টাকা এবং একশো টাকার বান্ডিল বের করলেন। এবং আমাদের কাছে কোনো গোপন না করে ওই ধুতি পাঞ্জাবী পরা ভদ্রলোককে দেওয়া হল। দু-লাখ টাকা দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। আমরা দেখলাম। ভদ্রলোক চলে গেলেন। তখন আমাকে একটি একশো টাকার নোট এবং একটি দশ টাকার নোট দিয়ে বাড়ির লোকটি বললেন, দেখুন তো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আমাকে জাল নোট দিয়ে পরীক্ষা করছেন? ভদ্রলোক মৃদু হাসছেন। ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন। বললেন, আপনি কেন, কেউ বুঝতে পারবে না। এটা আমরা বানিয়েছি। পনেরো বছর ধরে এই কারবার করছি। মোটামুটি হাফ পয়সায় পাওয়া যায়। পঞ্চাশ টাকা দিলে একশো টাকা পাওয়া যায়। আর এই কাগজগুলো একদম অরিজিনালের মতো। আমরা যে নম্বর ব্যবহার করি, সেটা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে পেয়ে যাই। সুতরাং আমাদের নোটকে জাল বলার ক্ষমতা কারো নেই। আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম, কারণ এ ধরনের জিনিস দেখব বলে ভাবিনি। ভদ্রলোক আমাদের অফার করলেন, আপনি তো সাইড বিজনেস হিসেবে এটা করতে পারেন।
আমরা খুব অবাক হলাম। একটা গ্রামের মধ্যে, চারিদিকে মাঠের মধ্যে একটা ঝাঁ চকচকে বাড়ি, দেখেই মনে হবে এটা পয়সাওয়ালা লোকের বাড়ি, সেখানে বসে ইনি এই কারবার পনেরো বছর ধরে করছেন। আশ্চর্য লাগল। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে কাটা ফাটা নোটের নম্বর পেয়ে যান ইনি, ফলে এই ধরনের নোটকে জাল বলা যাবে না। ভদ্রলোক আরও গুণগান করছিলেন তাঁর এই নোটের। বলছিলেন, পাকিস্তান থেকে যে জাল নোট আসে, সেগুলি নখ দিয়ে খুঁটলেই আরবিআই-এর সিল উঠে যায়, কিন্তু এই নোটে ওঠে না, ডাবল পেপার থাকে — এইসব। এই ধরনের ব্যবসা আমাদের অফার করায় আরও আশ্চর্য লাগল। মূল কাজের কথা আর হল না তেমন করে। আগামী দিনে কী করব না করব, ক্যাটালগ নিয়ে আবার যাব কি না, ফার্নিচারের কাজ কী হবে না হবে, সে প্রসঙ্গ যেন আউট হয়ে গেল কথা থেকে। আমাদের অনাগ্রহ দেখে তাড়াতাড়ি ইনি মোটর সাইকেল আরোহীকে ফোন করে দিলেন যে এনারা যাচ্ছেন, এঁদের পৌঁছে দিয়ে আয়।
এটা খবই সন্দেহজনক বিষয়। আমি কাঠের কাজ করি, আমাদের বাগনান এলাকার কিছু ছেলে কাজ করে, তাদের থেকে হয়ত নম্বর পেয়ে আমাকে ফোন করেছিল। ফোনে বলেছিল, অনেক টাকার কাঠের কাজের কন্ট্রাক্ট। কিন্তু আমাকে এসব কিছুই জিজ্ঞাসা করা হল না। কাজের থেকেও এই জাল নোটের কারবারে আমার অংশ নেওয়ার প্রবণতা নেই, এটা তাদের খুব আক্ষেপের বিষয় হল।
আমার সঙ্গে যে ছেলেটি গিয়েছিল, সে সেদিনের কাগজের শব্দসন্ধান ছক পূরণ করবে বলে একটা পেন কিনতে একটা দোকানে গিয়েছিল বাজাবেরিয়ায়। সেই দোকানে কেউ নাকি তাকে বলেছিল, আপনারা দেখবেন, এক্ষুনি একটা মোটর সাইকেল আসবে, আপনাদের নিয়ে যাবে। ওই জায়গাটা ভালো নয়, এরকমও সব মন্তব্য করেছিল। আর বলেছিল, আপনারা যাঁর কাছে যাচ্ছেন, তাঁর সাথে সাবধানে কথাবার্তা বলবেন। আমার সঙ্গী প্রিয়রঞ্জন আমাকে পরে জানাল। সে একটু সাবধান হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের মধ্যে এরকম একটি জাল ব্যবসা যথেষ্ট উদ্বেগের।
সংযোজন : একদিন বাদে আমি বাগনানের কিছু ছোটো কারবারীদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, ওটা জাল নোটের কারবার নয়, জাল নোটের কারবারের লোভ দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কারবার। এতে অনেকেই ঠকেছে, কিন্তু ঠকে যাওয়ার পর বাইরে প্রকাশ করে না। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওই গ্রামটির নাম সুলতানপুর, বাজাবেরিয়ার পশ্চিম দিকে।
Leave a Reply